. মাল্টিলেভেল মার্কেটিং মূলত ডিস্ট্রিবিউটরদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বিক্রি করার একটি প্রক্রিয়া (A process of selling of goods and services through a network of distributors) । এ প্রক্রিয়ায় আপলাইন ও ডাউনলাইন নামে বহু স্তরের (Multi level) ডিস্ট্রিবিউটর তৈরি হয়।
ডাউনলাইনের কোন ব্যক্তি (চাই সে এক হাজার স্তর নিচের ডিস্ট্রিবিউটর হোক এবং সর্বোচ্চ আপলাইনের ডিস্ট্রিবিউটর তাকে নাই বা চিনুক) কর্তৃক বিক্রিত পণ্যদ্রব্যের একটি কমিশন আপলাইনের ডিস্ট্রিবিউটররা পেয়ে থাকে। এই স্ট্রাকচারটি দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো।
কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত ব্যবসা ও শ্রম নীতির সাথে প্রচলিত মাল্টি লেভেল মার্কেটিং এর বিরোধ বেশ কয়েকটি দিক থেকে। এগুলোকে সাধারণত দু’টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে – (১) ভিত্তিগত (substantive and theoretical), (২) পদ্ধতিগত (procedural) ।
ভিত্তিগত দিক (substantive and theoratical aspect) :
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং এর ‘পদ্ধতি’ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের হলেও এর তত্ত্বগত ভিত্তিটি (theoretical basis) সবসময়ই এক রকম। আর তা হলো, নিম্ন লেভেলের ডিস্ট্রিবিউটর কর্তৃক বিক্রিত পণ্যের একটি কমিশন সর্বোচ্চ লেভেল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। এই নীতিটি ইসলামের সাথে কতটা সাংঘর্ষিক তা বুঝার জন্য ইসলামের শ্রম নীতিটি প্রথমে ভালোভাবে বুঝে নেয়া প্রয়োজন। সূরা নাজমের ৩৯ নং আয়াতটি (وان ليس للانسان الا ما سعي অর্থাৎ মানুষ ঠিক ততো টুকুরই ফল পাবে যততুকু সে নিজে করেছে) শ্রমনীতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। এর পরের আয়াতে বলা হচ্ছে (لا تزر وازرة وزر اخري অর্থাৎ একজন আরেকজনের বোঝা বহন করবেনা) । এ দু’টি আয়াত অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তির আয় ও দায় (income and liability) সবসময় ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। তবে, শরীয়ত প্রণেতা নিজেই অন্যান্য আয়াত ও হাদীসে এ সাধারণ নীতিটির (general principle) কয়েকটি ব্যতিক্রম (exceptions) উল্লেখ করে দিয়েছেন। তন্মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধনী লোকদের সম্পদে অভাবী মানুষের অধিকার এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সদকায়ে জারিয়া, গোনাহে জারিয়া ও জীবিত লোক কর্তৃক কোন ভালো কাজের সওয়াব মৃত ব্যক্তির নিকট পাঠানো (ঈসালে সওয়াব) অন্যতম। এখানে উল্লেখ্য যে, শরীয়ত প্রণেতা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সকল ব্যতিক্রম উল্লেখ করেছেন সেগুলো বাদ দিলে সুরা নাজমের ৩৯ নং আয়াতটি ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও শ্রমনীতির একটি প্রতিষ্ঠিত নীতি (established rule) ।
নাজমের ৩৯ নং আয়াত থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, মানুষ কেবল তার নিজের শ্রমের প্রত্যক্ষ ফল লাভের অধিকারী। কারো নিযুক্ত কর্মচারী** না হলে একজন আরেকজনের শ্রমের ফলে অংশীদার হতে পারেনা। একই ভাবে মানুষ তার শ্রমের ফল কেবল নিকটবর্তী লেভেল থেকেই আশা করতে পারে; কোন ক্রমেই তা বহুস্তর (multi level) পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারেনা । ইসলামের এই নীতিটি মানবীয় বুদ্ধি বিবেচনার সাথে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। এমনকি যারা আল্লাহতে বিশ্বাস করেনা, তারাও অবচেতন ভাবে এই নীতিটি অনুসরণ করে চলছে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার ভাবে বুঝা যাবে।
মানুষ সামাজিক জীব (social being)। কথাটির পেছনে মানবিকতার তুলনায় অসহায়ত্বের দিকটিই প্রবল। অর্থাৎ, মানুষ পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় প্রাণী। তার এই অসহায়ত্ব তাকে বাধ্য করে সামষ্টিক জীবনযাপন করতে। তার পরিধেয় এক টুকরো বস্ত্রের পেছনে অসংখ্য বনী আদমের শ্রম জড়িত। অগণিত লোকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিশ্রমের ফলে এক মুঠো ভাত তার খাবার প্লেটে হাজির হয়। এক কথায়, মানুষ তার মৌলিক প্রয়োজনের একটিও অসংখ্য মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শ্রম ছাড়া পূরণ করতে পারেনা। এখন একজন ব্যক্তি কতজন লোককে পারিশ্রমিক দিতে নীতিগতভাবে বাধ্য ? মানবীয় সুস্থ বিবেক বলছে তাকে কেবল ঐ ব্যক্তির পারিশ্রমিক দিতে বাধ্য করা যেতে পারে, যে তার পেছনে প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়েছে; পরোক্ষ শ্রম নয়। আর এই নীতিটিই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে সুরা নাজমের ৩৯ নং আয়াতটিতে (وان ليس للانسان الا ما سعي অর্থাৎ মানুষ ঠিক ততো টুকুরই ফল পাবে যা সে নিজে করেছে) ।
একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক তার প্রত্যক্ষ শ্রমের ফল দাবী করতে পারে, যা সাধারণত তাকে বেতন আকারে প্রদান করা হয়। কিন্তু কোন চুক্তি মূলে শিক্ষকের এ দাবী বৈধ হিসাবে বিবেচিত হতে পারেনা যে, তার ছাত্ররা যত জনকে শিক্ষিত করে কর্মক্ষম করে তুলবে এবং তারা ভবিষ্যতে যাদেরকে যোগ্য করে তুলবে তাদের প্রত্যেকের আয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ উর্ধ্বতন শিক্ষককে কমিশন আকারে দিতে হবে।
**কারণ এ ক্ষেত্রে মূল মালিক বেতন – ভাতা দিয়ে কর্মচারীর শ্রম টুকু কিনে নেয়। ফলশ্রুতিতে ঐ শ্রমের ফলের উপর মালিকের অধিকার জন্মায়। পক্ষান্তরে ডাউনলাইনের কোন ডিস্ট্রিবিউটর (বিশেষ করে অনেক নিম্ন পর্যায়ের) আপলাইনের ডিস্ট্রিবিউটরদের বেতনভুক কর্মচারী (paid employee) নয়।
(পরবর্তী কিস্তি পড়ুন)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১০ সকাল ৮:১২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




