. (৩) অনাথ শিশুকে শিক্ষিত ও কর্মক্ষম করে তোলাঃ
কখনো কখনো তাদেরকে এ যুক্তির অবতারণা করতে দেখা যায় যে, “ধরুন, একটা অনাথ শিশু আপনার নজরে পড়ল যার কোন আইনগত দায় দায়িত্ব আপনার উপর নেই। একান্ত দয়া পরবশ হয়ে আপনি তাকে অনেক টাকা পয়সা ও শ্রম দিয়ে তাকে শিক্ষিত ও কর্মক্ষম করে তুললেন। এবার বলুন, সে যদি কোন ইনকাম করে তাহলে কি সে ইনকামে আপনার কোন বৈধ অংশ নেই ? আলবৎ আছে। অনুরূপভাবে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আপনি যখন প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়ে এবং এ ব্যবসার মাহাত্ম বুঝিয়ে কোন নতুন ব্যক্তিকে এর অন্তর্ভুক্ত করেন অমনিই তার ভবিষ্যৎ ডাউনলাইনের চুক্তিসমুহের মধ্যেও আপনার একটি বৈধ অংশ সৃষ্টি হয়ে যায়।”
সন্দেহ নেই, এই যুক্তি আবিষ্কারের পেছনে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা খরচ হয়েছে। বুদ্ধির প্রশংসা না করে উপায় নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আগের দু’টি যুক্তির ন্যায় এই যুক্তিটিও শ্রমের বহুস্তর সুবিধার (multi level benefit of labour) বৈধতা প্রমাণে সক্ষম নয়। কারণ-
অনাথ শিশুকে কর্মক্ষম করে তোলার মাধ্যমে আপনি দু’টি জিনিস অর্জন করেছেন। একটি হচ্ছে সওয়াব (যার কোন financial value নেই, অতএব তা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়) এবং অপরটি হ্ল ‘আর্থিক অধিকার / financial right’ (যেহেতু তার পেছনে আপনি নিজের অর্থ ব্যয় করেছেন)। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আপনার আর্থিক অধিকারটি বাস্তব খরচের পরিমাণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। অর্থ্যাৎ, বাস্তবে তার জন্য যত টাকা খরচ করেছেন ঠিক ততটাকাই আপনি ফেরৎ পাওয়ার (reimbursement) অধিকারী; তার বেশী নয়। এক কথায়, তার ইনকামে আপনার কোন অনির্দিষ্ট, অসীম ও স্থিতিস্থাপক (indefinite, unlimited and elastic) অধিকার নেই; বরং রয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ (definite and limited) অধিকার, যার বাড়তি একটি টাকাও আপনার জন্য বৈধ নয়।
তাছাড়া অনাথের ক্ষেত্রেও আপনার শ্রমের কোন বহুস্তর সুবিধা (multilevel effect) নেই। অর্থ্যাৎ, কেবল ঐ অনাথ শিশুর কাছেই আপনার অধিকার রয়েছে; সে যদি অন্য কারো সাথে চুক্তি করে তাহলে সেই স্তর থেকে উদ্ভূত আয়ে আপনার কোন অধিকার নেই।
মোদ্দাকথা, এই উদাহরণের মাধ্যমেও শ্রমের বহুস্তর সুবিধার (multi level benefit of labour) বৈধতা প্রমাণ সম্ভব নয়।
(৪) বাড়ী ভাড়া প্রসঙ্গ
তাদের চতুর্থ যুক্তিটি হচ্ছে, “আমি যদি একবার শ্রম দিয়ে একটি বাড়ীর মালিক হই তাহলে সারাজীবন বসে বসে ঐ বাড়ীর ভাড়া ভোগ করি। কই, তখন তো কেউ এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না ? পক্ষান্তরে আমি যদি মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ে একবার শ্রম দিয়ে একটি ডাউনলাইন তৈরী করে তাদের চুক্তি থেকে উদ্ভূত ইনকামে বসে থেকে ভাগ বসাই তাহলে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে কেন ? বাড়ী ভাড়া ক্রমাগত পেতে থাকা বৈধ হলে ডাউনলাইনের ইনকামেও ক্রমাগত ভাগ বসানো বৈধ। কারণ, নীতি সব জায়গায় একরকমই হওয়া উচিত।”
বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করা হলে এ যুক্তিটিও ধোপে টিকবেনা। কারণ, বাড়ী ভাড়ার ক্ষেত্রে বাড়ী একটি ভৌতিক বস্তু (physical object) যা ব্যাবহার করা ও ভাড়া দেওয়ার যোগ্য। সাধারনত একটি বাড়ীর পেছনে দু’ ধরনের বিনিয়োগ কার্যকর থাকে। একটি হল ‘অর্থ’ (যা বাড়ীর মালিক যোগান দিয়ে থাকে) এবং অপরটি হল ‘শ্রম’ (যা সরবরাহ করে শ্রমিক পক্ষ)। মালিকের অর্থ ও শ্রমিকের শ্রম – এ দু’য়ের যৌথ ফলাফল হচ্ছে একটি বাড়ী। সূক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করুন, যদি শ্রমের বহু স্তর সুবিধা (multilevel benefit of labour) বৈধ হতো, (মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের প্রবক্তরা যাকে বৈধ ভাবছেন) তাহলে ঐ বাড়ীর উপর মালিকের ন্যায় শ্রমিক পক্ষেরও একটি স্থায়ী অধিকার অর্জিত হতো। অর্থ্যাৎ, যতদিন বাড়ী থেকে আয় হতে থাকবে ততদিন সেই আয়ের উপর মালিক ও শ্রমিক দু’ পক্ষই ভাগ বসাতো। কারণ, শ্রমিক পক্ষের শ্রমের ফলেই বাড়ীটি অস্তিত্ত্বে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে কি শ্রমিক পক্ষ বাড়ীর আয়ে স্থায়ী অংশীদার হতে পারে ? মোটেই না। এর কারণ কী ? এর কারণ হল, সর্বাগ্রে দেখতে হবে মানুষ অর্থ বা শ্রম দিয়ে যা উপার্জন করছে তার বৈশিষ্ট্য কী ? তা কী ভাড়া** দেওয়ার যোগ্য ? যদি ভাড়া দেয়ার যোগ্য হয় তাহলে বাড়তি পরিশ্রম না করেও স্রেফ বস্তুটি ভাড়া দিয়ে বসে বসে উপকার লাভ করা যেতে পারে। এখানে মালিক পক্ষ অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি বাড়ী অর্জন করেছে (যা ভাড়া দেয়ার যোগ্য)। পক্ষান্তরে শ্রমিক পক্ষ শ্রমের মাধ্যমে অর্জন করেছে কিছু টাকা (যা ভাড়া দেয়ার অযোগ্য)। দু’ পক্ষই দু’টি স্বতন্ত্র গুণ সম্পন্ন জিনিস অর্জন করেছে। প্রত্যেক পক্ষই নিজের ইনকামের নিরংকুশ মালিক; এক পক্ষের ইনকামে (কিংবা তা থেকে ভবিষ্যতে উদ্ভূত কোন আয়ে) অপর পক্ষের কোন রকম লেজ লাগানো নেই। এখান থেকেও একই কথা প্রমাণিত হচ্ছে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার শ্রমের একস্তর সুবিধা (uni-level benefit) নিকটতম স্তর (nearest level) থেকেই পেয়ে থাকে; বহুস্তর (multi-level) থেকে নয়।
**মনে রাখতে হবে, ঐ বস্তুই কেবল ভাড়া দেয়ার যোগ্য যা ব্যবহার শেষে (ঐ বস্তুটিই) আবার মূল মালিক কে ফেরৎ দিতে হয়; এবং ব্যাবহার বাবদ কিছু বিনিময় মূল মালিক কে দিতে হয়। বাড়ী ও গাড়ী ভাড়া এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পক্ষান্তরে, এমন কোন বস্তু ভাড়া দেয়ার যোগ্যই নয় যা নিজে নিঃশেষিত না হয়ে উপকার দিতে পারে না (যেমন, টাকা-পয়সা ও খাদ্যদ্রব্য)। তবে তা ধার বা ঋণ (loan) আকারে দেয়া যেতে পারে; কিন্তু সে ক্ষেত্রে মূল বস্তুর অতিরিক্ত কোন রকমের সুবিধা নেয়া যাবেনা। কারণ, তা সুস্পষ্ট সুদ। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, كل قرض يجر منفعة فهو ربا অর্থ্যাৎ, যে ঋণ কোন প্রকার উপকার/লাভ নিয়ে আসে তা-ই সুদ (Every loan drawing any benefit is riba)।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১০ সকাল ৮:১৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




