somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং : বৈধতার সংকট (১০)

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

. এ পর্যায়ে আমরা পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য হাঁকানো সংক্রান্ত ইসলামী বিধান আলোচনার চেষ্টা করবো। ব্যবসা বানিজ্যের রীতি-নীতি আলোচনার এক পর্যায়ে রাসূল (সাঃ) বলেন,
ان التجار يبعثون يوم القيامة فجارا الا من اتقى الله و بر و صدق (الترمذى 1210)
অর্থ্যাৎ, “ব্যবসায়ীদেরকে কিয়ামতের দিন চরম পাপীষ্ঠ হিসেবে উঠানো হবে, তবে ঐ সকল ব্যবসায়ী বাদে যারা আল্লাহকে ভয় করে, সদাচরণ করে এবং সত্য কথা বলে।” (তিরমিযি, হাদীস নং ১২১০)

আল্লাহকে ভয় করার মানে হচ্ছে আল্লাহর দেয়া নির্দেশ সমুহ মেনে চলা। ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর একটি স্থায়ী নির্দেশনা হল- “অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে না খাওয়া”। আল্লাহ বলেন,
يا ايها الذين امنوا لا تاكلوا اموالكم بينكم بالباطل (النساء 29)
অর্থ্যাৎ, “হে ঈমানদাররা! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না” (নিসা, ২৯)

“অন্যায়ভাবে” বলতে মূলত এমন সব কারবার কে বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) নিষিদ্ধ করেছেন। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহঃ) লিখেন-
অন্যায়ভাবে বলতে এখানে এমন সব পদ্ধতির কথা বুঝানো হয়েছে যা সত্য ও ন্যায়নীতি বিরোধী এবং নৈতিক দিক দিয়েও শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েয।
(তাফহীমুল কুরআন, সূরা নিসা, টীকা ৫০)

স্থানাভাব বশত আমরা ইসলাম কর্তৃক নিষিদ্ধ সব রকম ব্যবসা পদ্ধতি নিয়ে এখানে আলোচনা করছিনা। শুধু কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি যার দ্বারা বুঝা যাবে, রাসূল (সাঃ) আমাদের অর্থনৈতিক জীবনকে যেভাবে ঢেলে সাজাতে চান তার চৌহদ্দির মধ্যে মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের কারবার চলতে পারে কি না।

দ্রব্যমূল্য একটি স্পর্শকাতর ইস্যু। দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকলে স্বল্প আয়ের মানুষের ভোগান্তির অন্ত থাকে না। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দ্রব্যমূল্য ফিক্সড না করে রাসূল (সাঃ) এমন সব কার্যকারণের (factors) উপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন যেগুলোর প্রভাবে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। তন্মধ্যে একটি হল বর্ধিত মূল্যে বিক্রির উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্য আটকে রাখা। এ রকম মজুদদারীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাসূল (সাঃ) বলেন-
المحتكر ملعون (ابن ماجة , التجارة)
অর্থ্যাৎ, “অভিশপ্ত সেই ব্যক্তি যে বর্ধিত মূল্যে বিক্রির উদ্দেশ্যে পণ্য দ্রব্য আটকে রাখে।” (ইবনে মাজাহ, ব্যবসায় অধ্যায়)

দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার আরেকটি বিশেষ কারণ হচ্ছে উৎপাদক ও ভোক্তার মাঝখানে অতিরিক্ত মধ্যস্বত্ত্বভোগী সৃষ্টি হওয়া। যাদের কাজ হলো অল্প শ্রমে বেশী মুনাফা অর্জন করা। এ উদ্দেশ্যে তারা উৎপাদক ও ভোক্তার মাঝখানে অনর্থক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ উৎপাদক কে সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌছার সুযোগ দিলে স্বাভাবিক মূল্যেই পণ্য বিক্রি হয়ে যায়। তাই তারা ভোক্তার কাছে পৌছার আগেই উৎপাদক/ বিক্রেতার কাছ থেকে পণ্য কিনে পুনরায় ভোক্তার কাছে অধিক মুনাফা সহকারে বিক্রি করে। ভোক্তা ও উৎপাদকের মধ্যখানে যত বেশী মধ্যস্বত্ত্বভোগী থাকবে, ভোক্তার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে দ্রব্যমূল্য ক্রমশ ততই বাড়তে থাকবে। এই মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের চক্র ভেঙ্গে দিয়ে জনগণকে অতিরিক্ত দ্রব্যমূল্য থেকে মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন যে, “শহরে বসবাসকারী কোন ব্যক্তি শহরের বাইরে থেকে আগত কোন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পণ্য কিনে পুনরায় তা শহরের বাসিন্দাদের কাছে বিক্রি করতে পারবেনা।” (نهي رسول الله صلي الله عليه وسلم ان يبيع حاضر لباد)

এ নিষেধাজ্ঞা জারী হওয়ার ফলে শহরের ভিতরে বসবাসরত মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের হালকা পরিশ্রমে অধিক মুনাফা লাভের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। ফলে তাদের একটি গ্রুপ ভিন্ন ফন্দি আঁটলো। তারা শহর থেকে একটু বের হয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। শহরমুখী ব্যবসায়ীর দল দেখতে পেলে আগ বাড়িয়ে তাদের কাছ থেকে পণ্য কিনে শহরের বাসিন্দাদের কাছে পুনরায় বিক্রি করতো। অর্থাৎ তারা আগের তুলনায় খানিকটা বেশী শ্রম দিয়ে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে তাদের মধ্যস্বত্ত্বভোগের কারবার চালিয়ে যাচ্ছিল। এ কথা জানতে পেরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
نهي رسول الله صلي الله عليه وسلم عن تلقي الجلب والركبان
অর্থাৎ “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শহরবাসীকে শহরমুখী ব্যবসায়ীদের সাথে সাক্ষাৎ করে পণ্য কিনে পুনরায় শহরে বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন”।

এ দীর্ঘ আলোচনায় এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার যে, ইসলাম দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিয়ে থাকে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে যারা জনগণকে বর্ধিত মূল্যে পণ্য কিনতে বাধ্য করে ইসলাম তাদেরকে অভিশপ্ত ঘোষণা করে। বৃহৎ অর্থনীতির অনিবার্য ক্ষেত্র সমূহে কিছু নিয়ন্ত্রিত মধ্যস্বত্ত্বভোগীর অনুমতি দিলেও ইসলাম ভোক্তা ও উৎপাদকের মাঝখানে অযথা মধ্যস্বত্ত্বভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ঘোর বিরোধী।


এ কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালালদের বিরাট সংখ্যাটি বিবেচনা করুন। আপনি তাদের কাছ থেকে এই মুহুর্তে একটি পণ্য কিনতে চাইলে আপনার আপলাইনের কয়েক হাজার অনর্থক দালালের জন্য বরাদ্দকৃত কমিশনের অর্থ পরিশোধ করেই আপনাকে কিনতে হবে। অথচ কোম্পানীর পণ্য আপনার কাছে পরিচিত করার জন্য আপনার উর্ধ্বতন একজন দালালই যথেষ্ট ছিল। আর তখন অসংখ্য দালালের কমিশনের বোঝা না থাকার ফলে প্রচলিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে আপনাকে পণ্যটি দেয়া যেতো। অবৈধ মুনাফাখোরীর বাজার গরম করার জন্য কয়েক হাজার অনর্থক দালাল – মধ্যস্বত্ত্বভোগীর কমিশনের টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে নতুন প্রত্যেকটি ক্রেতাকে। গ্রাম পর্যায়ে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখা গেছে তাদের অধিকাংশ ক্রেতাই তাদের উর্ধ্বতন অগণিত মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালালের কমিশনের কথা কিছুই জানে না। সেক্ষেত্রে তো তা সুস্পষ্ট প্রতারণার শামিল। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, من غش فليس منا “যে প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত না” (মুসলিম ও তিরমিযি)

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্ধিত মূল্যে বিক্রির উদ্দেশ্যে তারা এমন সব পণ্য হাজির করে যার স্বাভাবিক দাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিছুই জানে না। অনেক সময় আন্দাজও করতে পারে না। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে এমন বর্ধিত মূল্যে বিক্রি সম্ভব নয়। কারণ সেগুলোর দাম সম্পর্কে মোটামুটি সবাই সচেতন। এ প্রকারের কারবারের সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “পণ্যের মূল্য সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান নেই এমন লোকের কাছে উচ্চ মূল্যে পণ্য বিক্রি করা নিঃসন্দেহে এক প্রকার জুলম”।
(ইবনে রুশদ, আল কাওয়ায়েদ, পৃষ্ঠা ৬০১)

আর ইবনে জারীর তাবারী সূরা নিসা’র ২৯ নং আয়াতে “অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ খাওয়া” –‘র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন-
يا ايها الذين امنوا لا تاكلوا اموالكم بينكم بالباطل اى نهى عن اكلهم اموالهم بالباطل اى بالربا و القمار و البخس و الظلم (جامع البيان المعروف ب تفسير الطبرى ج 4, ص 42 )
“হে ঈমানদাররা! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না” অর্থ্যাৎ, আল্লাহ এ আয়াতের মাধ্যমে একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে খাওয়াকে নিষিদ্ধ করেছেন। আর “অন্যায় ভাবে”-‘র মানে হলো- সুদ, জুয়া, অতি কম মূল্যে ক্রয় করা ও অতি বেশি মূল্যে বিক্রি করা।
(জামিউল বায়ান, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪২)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১০ সকাল ৮:১৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×