মূল গল্পটি পড়ার আগে আগে পড়ে নিতে হবে নিচে গল্পটি।
অসংজ্ঞায়িত সম্পর্ক, বাক্সবন্দী স্মৃতি!
=========
মৃন্ময়ী-অতনু আজ সকালেই এসে পৌঁছেছে কক্সবাজার। ২৫তম বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করতে এসেছে। কথা ছিল এই দিনে তারা দু'জনেই দুজনার না বলা এক অধ্যায়ের কথা বলবে। প্রকৃতি সব সময়ই উদার তবে উদারতা, বিশালতায় পাহাড় এবং সাগরের তুলনা হয় না। ওরা তাই বেছে নিয়েছে আজকের এই দিনের জন্যে সাগরকে। আজকের এই দিনটি উদযাপনের জন্যে আরো অনেক আয়োজন করা যেতো। অতনু চেয়েছিল দেশের বাইরে দূরে কোথাও না হোক ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে আসতে যেহেতু দু'জনের-ই ছুটির সমস্যা নেই। কাশ্মীর দু'জনার-ই পছন্দের জায়গা এবং মানালী মৃন্ময়ীর পছন্দ। ও বরাবরই ঠান্ডা পছন্দ করে, ঠান্ডায় যদিও অনেক রকম সমস্যা দেখা দেয় তবুও ঠান্ডা পাগল। কাশ্মীর-মানালি যাবার খরচের টাকা থেকে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনের খরচ রেখে বাকীটা এক এতিমখানায় দিয়ে এসেছে তারা।
আজকের সারাদিন-রাত এবং কালকের দিন সেন্টমার্টিন কাটিয়ে বিকেলের জাহাজে ফিরবে তারা। সেন্টমার্টিন আসার পথে জাহাজে পুরোটা সময় মৃন্ময়ী খুব উচ্ছসিত থাকলেও বারবার আনমনা দেখাচ্ছিল অতনুকে। দ্বীপে নেমে রুমে ঢুকেই অতনুকে উদ্দেশ্য করে বলে
= তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে, কোন সমস্যা?
=> কই, নাতো...
= লুকিয়ো না আমার কাছে, তোমার প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাস আমার চেনা, আমি অন্তত তাই দাবী করি। জাহাজে আনমনা ছিলে...তুমি চাইলে আমরা যে উদ্দেশ্যে এসেছি সেটা বাদ দিতে পারি, প্রতিবারের মতন আনন্দ করে কিছু স্মৃতি নিয়ে ফিরবো...
=> না..না...আজকের দিনটা অনেক দিন, অনেক বছর আগে থেকেই প্ল্যান করা। এটা বাদ যাবে না। আমার ভয় হচ্ছে মৃন্ময়ী...কেন ভয় হচ্ছে সেটার কারন পুরোটা শুনলেই বুঝতে পারবে, যদিও এর ভিত্তি নেই...
ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে খেয়ে ভর দুপুরে দু'জন দুটো সাইকেল ভাড়া করে পুরো দ্বীপ চক্কর দিয়ে এলো। মৃন্ময়ীকে অতনু-ই সাইকেল চালানো শিখিয়েছিল এই সেন্টমার্টিন এসে। মাঝে পঁচিশ বছর পার হলেও দুজনের তেমন পরিবর্তন নেই, বাড়তি মেদ খুব একটা জমেনি, বলা যায় মৃন্ময়ীর অতি সচেতনতায় জমতে পারেনি, না তার শরীরে, না অতনুর শরীরে। বন্ধু মহলে অবশ্য এই কারনে এই জুটি ঈর্ষনীয়। ওরা দু'জনেই এটাকে বেশ উপভোগ করে।
সন্ধ্যায় রিসোর্টের সামনে হেঁটে এসে বসেছে দুজনে। কে আগে শুরু করবে এই নিয়ে কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলির পরে মৃন্ময়ী-ই শুরু করল। পঁচিশ বছর আগে যেই বাক্সের ডালা আটকে দিয়েছিল খুলতে গিয়ে দেখল তা যত্ন না করলেও মরচে পরেনি! রাতের নিরবতার মাঝে কেবল সমুদ্রের ঢেউ এর শব্দ আর মৃন্ময়ীর গলার শব্দ পাচ্ছিল অতনু। দুজনার মাঝে কথা ছিল যখন বলা শুরু করবে তখন কেউ কোন কথা বলবেনা। একেবারে দু'জনার বলা শেষ হলেই তবে যা জিজ্ঞেস করার করবে। মৃন্ময়ী বলে গেল তার নীল শাড়ীর কথা যা পঁচিশ বছরে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেও সে ফেলতে পারেনি। তার-ই চার বছরের ছোট বন্ধু উপলের দেওয়া শাড়ীটি সে এতদিন যত্নে রেখেছিল। কেউ কখনো কাউকে বলেনি ভালোবাসে বা কোন কাজেও প্রকাশ পায়নি। তাও যখন উপল তার প্রেমিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ভেংগেচুরে গেছিল মৃন্ময়ী। চুরমার হয়ে গেছিল যখন ওদের কমন বন্ধু মিশু'র কাছে শুনেছিল বরাবর-ই অতি লাজুক উপল চেয়েছিল মৃন্ময়ী ওকে আগে বলুক ভালোবাসার কথা। মিশুকে আর মৃন্ময়ী বলেনি সেও এটাই চেয়েছিল...চেয়েছিল উপল তাকে বলুক।
একটানা সব কথা বলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৩৭মিনিট ৪৭ সেকেন্ড লেগেছে তার বলতে! মনে মনে অবাক হয় পঁচিশ বছর ধরে জমানো বিষয় এত কম সময়েই বলে ফেলতে পারেছে!
*****************
ছোট বেলা মানে খুব ছোটবেলা...শুরু করে অতনু.... ভালোবাসার বয়স না সেটা, বরং তা বড়রা জানলে বলবে ইঁচড়ে পাকা ছেলে সেই বয়স। ভালোবাসি লিখে একটা Eclairs ক্যান্ডি মুড়ে কাগজটা দিয়েছিলাম শিখা কে। নামের কারনেই কিনা জানিনা মেজাজেও অগ্নি শিখাই ছিল। তার চোখ জোড়ার মাঝে যেন কী ছিল, দুনিয়া ওলটপালট হয়ে যেতো, অদ্ভুত সুন্দর ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহন হয়নি সেই ভালোবাসা, হবার কথাও না। একই সাথে এসএসসি পাশ করলেও আর কখনো সেই কথা উচ্চারন করা হয়নি। মাঝে এগারো বছর কেটে গেছিল, দু'জনার কোন যোগাযোগ হয়নি। ছোট্টবেলার সেই ভাল লাগাকে নিছক-ই ভাললাগা ধরেই ভুলিয়ে রেখেছিলাম মনকে। ইউনিভার্সিটি লাইফে ভালো লেগেছিল একটি মেয়েকে। মনের ভাব আদান-প্রদান হল। ক্লাস পালিয়ে প্রেম, বিশেষ দিনে ঘুড়ে বেড়ানো, খেতে যাওয়া, রঙ্গীন প্রেম যাকে বলে সব-ই করেছিলাম অল্পদিনে। কিন্তু মেয়েটির পরিবারে জেনে যায় কোন ভাবে। শর্ত দেওয়া হয় পরিবার থেকে প্রেম এবং পড়ালেখা যে কোন একটি বেছে নিতে হবে। বুদ্ধিমতীর মতই সিদ্ধান্ত নেয় সে, পড়ালেখাকে বেছে নেয় কারন তখনো আমি ছাত্র। প্রচন্ড রকম ভেংগে পড়েছিলাম। একবছর ইয়ার লস হয়। বন্ধু এবং পরিবারের সাপোর্টে আবার পরের বছর পড়ালেখা শুরু করি। মাস্টার্সের রেজাল্টের আগেই কলেজের চাকরীটা হয়ে যায়। ততদিনে দেখা হয় শিখার সাথে! চেহারা ভুলেই গেছিলাম, চোখ দুটো কেবল মনে ছিল। কোন এক অনুষ্ঠানে রিমলেস ভারী গ্লাসের আড়ালে মোটা কাজলটানা সেই চোখই পরিচয় দেয়। একথা সে কথার পরে স্বামী সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করতে বলল হয়নি এখনো। আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করতে একই জবাব। অনেক কথার ফাঁকে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান হল।
বাবা রিটায়ারমেন্টে গেছেন ততদিনে, বাড়ীর কাজ ধরা হয়েছে হিসেবের চাইতে বেশি টাকা চলে যাচ্ছে। সংসারের টালমাটাল অবস্থায় বিয়ের কথা ভাবা যাচ্ছিল না তার পরেও যেই চোখ জোড়া খুঁজে বেড়িয়েছি এখন স্বয়ং তার মালিককে পেয়ে সব হিসেব নিকেষ ওলটপালট হয়ে গেল। নিজে না বলে কমন এক বন্ধুর সাহায্য নিলাম। তার মাধ্যমেই হল দুজনার কথা। এবার আর মানা করল না শিখা। তবে শিখা বলল ওর কিছু বলার আছে, এক অতীতের কথা জানালো। জানালাম সমস্যা নেই তাতে। সমস্যা হয়েছিল অন্যখানে। আমিই দায়ী তার জন্যে। শিখা আমাকে তার আগে এবং এর পরেও বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল আমার কোন সম্পর্ক হয়নি বা প্রেম করিনি কেন? কোথায় যেন বাঁধা পড়ে যেত এই প্রসংগ আসলে। বলতে চেয়েও বলতে পারিনি এবং সবচাইতে বড় ভুল যেটা করেছিলাম সেটা হল অস্বীকার করেছিলাম। বলেছিলাম কোন সম্পর্কে যাইনি, কেবল তার-ই অপেক্ষায় ছিলাম এত বছর। আসলে হঠাৎ এভাবে পেয়ে যাবও ভাবিনি। আর যখন পেয়ে গেলাম তখন হারানোর ভয়টা তীব্র ভাবে জেঁকে ধরল তা ই বার বার বলতে চেয়েও পারিনি!
দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের কথা আগাচ্ছিল। অনেক রকম শখ এবং ঝোঁক ছিল শিখার। তখন টাই-ডাই এর কাজ শিখছিল। সে সময় কাজ শিখে এসে প্র্যাকটিসের জন্যে একপ্রকার ঝুঁকি নিয়েই রাজশাহী সিল্কের সাদা কাপড়ের উপর নীল টাই-ডাই করে। প্রথম প্রচেষ্টায় সফল হয়ে ছিল এবং সেই কাপড়ের পাঞ্জাবী হচ্ছে আমার বিশেষ বিশেষ দিনে পরা সিল্কের পাঞ্জাবীটা।
"তোমার জন্যে কাউকে ভালোবাসতে পারিনি"-এই কথাটিই কাল হয়েছিল। শিখা প্রচন্ড ভাবে বিশ্বাস করেছিল এবং ভালোবেসেছিল। আমি ভাবতাম বরাবরের মতই শিখা নির্লিপ্ত ছিল ভালবাসায়। কিন্তু আমার ভাবনায় ভুল ছিল। যখন জানলাম তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যখন জানল আমার আগের সেই সম্পর্কের কথায় খুব ধাক্কা খেয়েছিল, মানতে পারেনি। মানতে পারেনি কারন, আমি লুকিয়েছিলাম ব্যাপারটি। পরে শুনেছিলাম প্রচন্ড রকম প্রতারিত হয়েছিল বিধায় কষ্টটাও অনেক বেশি পেয়েছিল। আর তাই ভেংগে গেলেও নত হয়নি, কঠিন ব্যক্তিত্বের ফলে মুখ ফিরিয়ে নেয় আমার থেকে। সেদিন ওর ভেংগে আসা গলায় বলা শেষ কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজে, "তুমি বলেছিলে আমার জন্যে অপেক্ষা করেছিলে। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে সত্যিই ভালবাসো। ভুল চিনে ছিলাম তোমাকে, সব ভাবনা ভুল ছিল..."। কথাগুলো যখন মনে পরে যায় নিজেকে খুব বড় অপরাধী মনে হয়, আনমনা হয়ে যাই নিজের অপরাধের কথা ভেবে, কুঁকড়ে যাই ভেতরে। আমি বোঝাতে পারিনি হারনোর ভয়েই বলতে পারিনি, তবে ভয়টাই সত্যি হয়েছিল!
****************
কথা শেষ করার দুই মিনিট পার হয়ে গেলেও দুজনের কেউ-ই কোন কথা বলেনি এখনো। মৃন্ময়ী চুপচাপ অন্ধকার সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও বুঝতে পারছে চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি ঝরছে অতনুর, সেটা বুঝতে পেরেই আরো চুপ করে তাকে সামলাতে দিয়েছে। কাঁদুক, পঁচিশ বছর যাবত যা বয়ে বেড়াচ্ছে তা যখন আর বের হয়েছে কিছুটা হলেও যদি চোখের জলের সাথে চলে যায় ক্ষতি কী।
পানি মুছে অভিব্যক্তি বুঝতে বাম দিকে বসা মৃন্ময়ীর মুখের দিকে চোখের কোনা দিয়ে তাকানোর চেষ্টা করে। আবছা অন্ধকারে ডান নাকে পরা এক দানার হীরের নাকফুলটা ঝিক করে ওঠে। মনে হয় হীরে নয় কলজেটায় ছ্যাঁত করে উঠল, পঁচিশ বছর আগের সেই এক ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশংকায়....
আড়মোড়া ভেঙ্গে মৃন্ময়ী বলে উঠল, অতনু চলো রুমে যাই, আর যাবার আগে এতদিন যা আমরা জমিয়ে রেখেছিলাম তা সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে যাবো। এগুলো নিয়ে আমরা বাড়ী ফিরবো না।
অতনুর মনে হল যেন জগদ্দাল পাথর নেমে গেল বুক থেকে। নিজের বাম হাতের মুঠোয় মৃন্ময়ীর ডান হাতের আংগুল গুলো শক্ত করে ধরে হোটেলের রুমের দিকে এগুতে লাগল।
********
হাটতে হাটতে আঃ...বলে অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে ওরে অতনু
= কী হয়েছে?
=> সুড়সুড়ি দিচ্ছো কেন তালুতে!
= পঁচিশ বছরেও কেন তোমার সয়ে গেল না?
=> তুমি না...একটা যা...তা...রাগী মাস্টারনী......
******************************************
এক বছরের বেশি সময় আগে লিখেছিলাম একটি গল্প। লেখার সময় ভাবিনি সেটার কোন পর্ব লিখবো। পাঠকের চাহিদা এবং অনুপ্রেরণায় তার পর্ব লেখার কথা ভেবেছি সম্প্রতি।
ব্লগার মলাসইলমুইনা ভাইয়ার বিশেষ অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছে আবার এবং এর প্লটটি ব্লগের বাইরের একজন দিয়ে সহায়তা করেছেন। এই দু'জনের কাছে আমি বিশেষ এবং আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:১৬