শেষ দুপুরে ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে শুষ্ক বাতাসে শীতের আগমনী ঘ্রান নাকে আসতেই মন চনমন করে উঠল, বুক ভরে শ্বাস নিলাম। প্রতিটা ঋতুর আলাদা ঘ্রাণ আছে যা ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে টের পাওয়া যায়। এখন প্রতিটা ঋতুই সময়ের আগে চলে আসে সেই ঘ্রাণটুকও টের পাই আমি এই ইট পাথরের শহরে থেকেও। গ্রীষ্মের প্রথম বৃষ্টির সোদামাটির গন্ধ প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। বৃষ্টির পরে কামিনীফুলের ঘ্রাণ নাকে এলে বুঝতে পারি বর্ষাকাল চলছে।
শীতের আগের এবং পরের ঘ্রাণ আমাকে স্মৃতিকাতর করে দেয়। ক্ষেতভরা সর্ষেফুলের ঘ্রাণ আমি এখনো একটু কষ্ট করলেই হয়ত পাবো কিন্তু একটু বেলা বাড়লেই নাস্তা করে নানুর সাথে গামলা হাতে উত্তরের ক্ষেতে যাওয়ার দিন আর ফিরে পাবো না। ফিরে পাবো না নানুর সাথে পা টিপে টিপে পেঁয়াজ গাছ বাঁচিয়ে পটপট করে পেঁয়াজের হাই (পেঁয়াজের কলি) তোলার দিনগুলো। গামলা ভরে হাই তুলে ক্ষেত থেকে বের হবার আগে পেঁয়াজ গাছের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো কুমড়ো লতার থেকে বের হওয়া কুমড়ো মোচর দিয়ে ছিঁড়ে নানু বের হতেন আজকের মত শেষ বিধায়। ডিম দিয়ে করা পেঁয়াজ কলির ভাজিতে এখন আর সেই স্বাদ পাইনা তবে স্মৃতিগুলো অমলিন রয়েছে!
বারান্দায় পালংশাক বাছতে ডালা নিয়ে বসতেই নাকেমুখে ঝাপটা লাগল বাতাসের যে বাতাসে ভরা ফসলের মাঠের ঘ্রাণ! মুহুর্তেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম ফাল্গুনে শীত কম থাকবে তখন মেয়েদের নিয়ে কয়দিন ঘুরে আসবো গ্রামের বাড়ী থেকে। গ্রামের বাড়ী বলতে বাবার বাড়ী! ফাল্গুনে গ্রামে বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ফসলের ঘ্রাণ। বাড়ীর উঠোনে উঠোনে পাকা ধনিয়া, খেসারী, মুসুরি, গমের পালা থাকে। বাড়ী গুড়ো থেকে বুড়ো সবাই ব্যস্ত থাকে ফসল তোলার কাজে। শক্তিশালীরা বড় লাঠ দিয়ে পাকা ফসলের পালায় বিশেষ কায়দায় পেটায় যাতে ডালপালা থেকে বীজ নিচে জড়ো হয়, বয়সে বৃদ্ধরাও বসে থাকেন না, খাটো মুগুর দিয়ে অল্প অল্প করে নিয়ে তারাও পিটিয়ে কাজ আগানোয় ব্যস্ত থাকেন, বৃষ্টির আগেই ফসল শুকিয়ে হাটে পাঠাতে হবে কিংবা ঘরের পেছনের মাচার ডোলে তুলতে হবে যে!
আমার দাদীর বাড়ীতে দেখতাম বড় বড় ড্রামে ভরা থাকতো ধনিয়া, বছরে একবার মেঝেতে ঢেলে সেই ধনিয়া খুব আয়োজন করে মাপা হতো, তারপর বস্তায় ভরে ভ্যানে করে হাটে নেওয়া হতো বিক্রির জন্যে। ধনিয়ার কথা বলায় মনে হল কাঁচা ধনিয়া ফুলের কথা! ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় মিষ্টি ঘ্রাণের সাদা ধনিয়া ফুল ছিঁড়ে মুখে পুরে চিবাতে চিবাতে যেতাম! আচ্ছা এখন কী ধনিয়া বুনে না কৃষক? দক্ষিণের ক্ষেতে ধনিয়ার পাশাপাশি বীজের পেঁয়াজ লাগাতেন কৃষক যাকে "কদম" বলত। এক মানুষ সমান পেঁয়াজ কলির মাথায় কদমের মত বড় সাদা ফুল বরাবর ই আমাকে অবাক করতো এখনো খুব শখ ঐ বীজ থেকে কী করে ফসল তোলে তা দেখার! কখনো সুযোগ হয়নি দেখার। আমাকে অবাক করতো লাল হলুদের মিশেলে চমতকার কুসুম ফুলের মাঠ। ছিঁড়তে খুব ইচ্ছে হতো ঐ ফুল কিন্তু বারন ছিল ছেঁড়া কারন এই ফুল থেকে তেল হবে, আমি ফুল ছিড়ে ফেললে ক্ষেতের মালিকের ক্ষতি হবে যে!
কিছু ঘ্রাণ চাইলেও ছুঁতে পারবো না, ফিরে পাওয়া সম্ভব নয় তা আর এটা বুঝেছিলাম সেদিন যখন পূর্ব দিকের জানলা খুললে এক ঝটকায় একটা ঘ্রাণ নাকে মুখে এলো তখন। পরিচিত ঘ্রাণ টের পেয়ে বুক ভরে শ্বাস টেনে বুঝলাম লঞ্চ কিংবা ফেরিতে করে বাড়ী যাওয়ার সময় নদীর মাঝে বাতাসে পেতাম এই ঘ্রাণ! পদ্মা সেতু হওয়ায় এখন আর নদীকে স্পর্শের প্রয়োজন নেই, আর তাই সেই ঘ্রাণ ও পাবো না।
বাতাসে স্মৃতিরা উড়ে বেড়ায়, ছড়িয়ে যায় ঘ্রাণ। ভিন্ন ধরনের স্মৃতির ভিন্ন রং, রয়েছ নানারকম ঘ্রাণ যা পেছনে নিয়ে যায় এক ঝটকায়। প্রচন্ড রকম স্মৃতিকাতর করে দেয়!