হেপাটো কোলেস্টাসিস বা Cholestasis In Pregnancy (ICP) যে নামেই ডাকা হোক না কেন যেমন গাল ভরা নাম তেমনি শরীর ভরা এক রোগ!
গর্ভাবস্থায় Bile Acid লেভেল বেড়ে গিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় একেই বলে Cholestasis in Pregnancy।
গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের জীবন দূর্বিষহ করে ফেলে এই কোলেস্টাসিস। এক গবেষণায় দেখা গেছে Uk, সুইডেন বা হিস্পানিক ব্যাকগ্রাউন্ডের ব্যক্তিদের মাঝে প্রতি ১০০০ গর্ভবতীর মাঝে ১/২ জন ICP তে আক্রান্ত হয়, অন্যদিকে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান সাবক্টিনেন্টে প্রতি এক হাজারে ৫-৭ জনকে আক্রান্ত হতে দেখা যায় (তথ্য : ইন্টারনেট)
লক্ষণ:
গর্ভবতী মায়ের হাত এবং পায়ের তালুতে অস্বাভাবিক চুলকানী, শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। রাতে তুলনামূলক চুলকানী বেড়ে যায় ।
আমার পায়ের তালুতে এবং পাতায় এত বেশি চুলকাতো যে যেই আমি পায়ের তালুতে সুড়সুড়ির কারনে হাত দিতে পারতাম না সেই আমি আংগুল দিয়ে চুলকাতে চুলকাতে আংগুল অবশ হয়ে গেলে চিরুনী দিয়ে চুলকাতাম! হাত পায়ের মাংস পেশীতে মনে হতো কেউ সুঁচ দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে। মাংস পেশী চাপ দিয়ে দিয়ে স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা করতাম। সারারাত ভেজা কাপড় গায়ে জড়িয়ে শুয়েছি এবং দিনে রাতে কম পক্ষে দুইবার বরফ ঘষেছি শরীরে কিংবা বরফ পানিতে কাপড় ভিজিয়ে সেই কাপড় গায়ে জড়িয়ে থেকেছি। এত ঠান্ডা পানিতে সবাই আমার এবং বাচ্চাদের সর্দির ভয়ে ছিল তথাপি ঐমুহুর্তে সাময়িক আরামটুকু জীবন রক্ষাকারী ছিল তাও সবাই বুঝেছিল।
আসুন একটু দেখি এই কোলেস্টাসিস কী ক্ষতি করতে পারে বাচ্চার:
Preterm birth: উচ্চ বাইল এসিডে (Bile Acid) সময়ের আগে ডেলিভারির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
Meconium staining: শিশু পেটের ভেতর টয়লেট করে দিতে পারে, এতে জন্মের সময় নানান জটিলতা দেখা দেয়। (আমার দ্বিতীয় প্রেগনেন্সির সময় এই জটিলতা দেখা দেয় ফলে ৩৫ সপ্তাহ পূর্ণ হবার দিন ইমার্জেন্সি ভিত্তিতে সি সেকশন হয়)।
Fetal distress: গর্ভের শিশুর অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়।
Stillbirth: অতিরিক্ত বাইল এসিডের কারনে গর্ভেই শিশু মারা যেতে পারে।
প্রথম প্রেগনেন্সিতে যখন জানলাম preterm birth, Stillbirh এবং প্রথম প্রেগনেন্সি তার উপর টুইন সব মিলিয়ে খুব বড় এক রিস্কে আছি , তখন মনে হল আমাকে ঢাকা গিয়ে ডাক্তার খুঁজতে হবে। যাদের জন্যে সমাধান খুঁজতে এসেছিলাম তাদের নিয়ে ফিরতে পারিনি আর! অনেকেই বলেছিল আমার জার্নি করা ঠিক হয়নি, আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যেও আমি এই সাড়ে চার বছরে সেটা মনে করিনি। আমি যেটা মনে করেছি সেটা হল I tried my best. আমার সাধ্যের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের দেশে এই সমস্যার তেমন সমাধান নেই, না মেডিসিন না কাউন্সেলিং। বাইরেও এর কার্যকরী মেডিসিন তেমন নেই। সামান্য মেডিসিন এবং ফলোআপ, কাউন্সেলিংএর মাধ্যমে নজরে রাখা হয়।
সাধারনত প্রেগনেন্সির শেষ ৩ মাস বা ২৮ সপ্তাহ থেকে এই চুলকানী দেখা দেয়। আমাদের দেশে একদমই শেষ মাসে অনেকের দেখা দেয় যা ডেলিভারির কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনের মাঝেই কোন চিকিতসা ছাড়াই চলে যায়।
আমার প্রথমবারে ডেলিভারির পরপর হসপিটালে থাকাকালীন ই টের পেয়েছিল কমে গেছে। বাচ্চাদের জীবন সাথে করে নিয়েই চলে গেছে সে! তবে পরের বার কিছুটা সময় লেগেছে, যদিও খাবারে এলার্জিজনিত সমস্যায় এরপর থেকে ভুগছি। কখনই কোন খাবারে এলার্জি ছিল না আমার অথচ দ্বিতীয় প্রেগনেন্সির পর থেকে তা দেখা দিয়েছে।
আমি যে গাইনী ডাক্তারের আন্ডারে ছিলাম তিনি কোন কূলকিনারা না করতে পেরে এক লিভারের রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এই সমস্যার একটাই ঔষধ। এটি নিরাময় যোগ্য নয় বরং Bile Acid এর লেভেল কিছুটা কম রাখতে সাহায্য করবে এটি। তবে প্রতি প্রেগনেন্সিতেই এটি ফিরে আসার সম্ভাবনা বেশি। পরবর্তীতে অন্য এক গাইনী ডাক্তারের পরামর্শ নিলে বলেন, প্রতি প্রেগনেন্সিতেই ফেরত আসবে এমন কথা নেই। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে মিলিয়ে দেখেছিলাম প্রথমবারের তুলনায় তীব্রতা পরের বার কম ছিল সে হিসেবে প্রেগনেন্সি পরবর্তীসময়ের গাইনী ডাক্তারের কথা নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছিল।
আমি ফেসবুকে প্রেগনেন্সি সম্পর্কিত এক গ্রুপ ফলো করতাম। সেখানে নানান জনের নানান সমস্যা এবং তাদের জন্যে দেওয়া সমাধান মনযোগ দিয়ে দেখতাম। এমনি একদিন একজন লিখেছিলেন তিনি এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তবে ৩২ সপ্তাহের পর থেকে শুরু হয়েছে। উনার রেগুলার ডাক্তারকে বলে আসছিলেন এটা লিভারের কোন ফাংশনে সমস্যা কিন্তু ডাক্তার গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না এবং যখন Alkaline phosphet লেভেল ৮০০+ আসে রেজাল্টে তখন সেই ডাক্তারের টনক নড়ে এবং বলেন তিনি এটা ম্যানেজ করতে পারবেন না। পিজি হসপিটালে চলে যেতে। সেই মা পিজি হসপিটালে সারাদিন ঘুরে কোন কূল কিনারা করতে না পেরে হতাশ হয়ে গ্রুপে পোস্ট করেছিলেন। সরকারী হসপিটালে এক দিনেই কূলকিনারা পাওয়া সম্ভব নয় এবং ৩২ সপ্তাহের এমন সিরিয়াস প্রেগনেন্ট এর তো আরো হবার কথা নয়। উনি জানতে চেয়েছিলেন কেউ এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন কিনা । উনার পোস্ট চোখে পড়ে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলাম, যে গাইনীর আন্ডারে ছিলাম তিনিও পিজি হসপিটালের ডাক্তার। নিজে আগ্রহ নিয়ে ঠিকানা চাইলে দিলাম। ৩৫ সপ্তাহ পূর্ণ হলে সিজারিয়ান ডেলিভারির মাধ্যমে এক কন্যা সন্তান হয় তার। দু'জনেই সুস্থ আছেন। সম্প্রতি সেই আপু ২৪ সপ্তাহের প্রেগনেন্ট এবং আমাকে নক করে জানালেন, সাথে জানালেন আমার দেওয়া তথ্যের কারনেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন, সহজ হয়েছিল সব। তিনি যে এত দিনেও মনে রেখেছেন আমার কথা এতেই অবাক হয়েছিলাম।
অনেক দিন ভেবেছিলাম নিজের অভিজ্ঞতার এসব কথা লিখবো। একজনেরও যদি উপকার হয়, একটা পরিবারও যদি বোঝেন যে হবু মা এবং অনাগত সন্তানের জন্যে এই সময় কী পরিমান সহযোগীতা, সহমর্তিতা, ধৈর্য, যত্নের প্রয়োজন তার ভয়ানক অবস্থার মাঝে তাহলেই আমার এসব বলা সার্থক।
গতকাল সেই আপুর মেসেজ পেয়ে মনে হল আসলেই সেদিনের বলা কথা সার্থক হয়েছিল।
এই লেখা যারা পড়বেন আশা করবো পরিবার, আপনজনের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। আমি দোয়া করি আমার শত্রুও যেন এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে না যান। নগন্য মানুষ আমি, আমার দোয়া হয়ত সবার জন্যে কাজে নাও লাগতে পারে তাই এমন কোন পরিস্থিতি হলে অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে পাশে থাকবেন আপনজনের।
প্রতিটি গর্ভকাল হোক সুস্থ, নিরাপদ ও উপভোগ্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ১০:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


