somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবাকে নিয়ে তিনটি ব্যক্তিগত ঘটনার স্মৃতিচারন

২২ শে জুন, ২০২১ ভোর ৫:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
বাবাকে নিয়ে তিনটি ব্যক্তিগত ঘটনার স্মৃতিচারন



এক: স্বাধীণতার বিজয়
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আব্বার যখন বাংলাদেশের এক দুর্গম কিন্তু প্রাক্বতিক ছায়া সুনিবিড় সীমান্তবর্তী থানায় কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্ভাব্য সকাল উপায়ে সাহায্য করেছেন। স্ত্রী এবং ছোট ছোট সন্তানদের কথা ভেবেই সম্ভবত: সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন নি। তবে যথাসাধ্য সহায়তা করেছেন এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এবং তাঁর এই সহযোগিতার কথা স্থানীয় মিলিটারী ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে এবং ফলশ্রুতিতে আব্বাকে পাকিস্থানী সেনা সদস্যরা অফিস থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং ক্যাম্পে তিন দিন আটকে রেখে অনেক নির্যাতন করে তার পরে ছেড়ে দেয় (হয়তো সরকারী কর্মকর্তা বিধায় একেবারে মেরে ফেলার পরিবর্তে জীবন্মৃত অবস্থায় ছেড়ে দেয়)। যা হো'ক, আমার মনে আছে অফিস লাগোয়া আমাদের বাসার উঠোনে খোঁড়া বাংকারে থাকতাম আমরা তখন। এক রাতে ভীষন গোলাগুলো হওয়ার পরে ভোরে জয় বাংলা ধ্বণিেতে আকাশ প্রকম্পিত হতে থাকে এবং সকালে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ীর বেশে থানা সদরে প্রবেশ করে এবং আব্বার সাথে দেখা করতে আসেন। আব্বা একজন মু্ক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে একটা ষ্টেনগান নিয়ে আকাশের দিকে আনন্দে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকেন। আব্বাকে এতো আনন্দিত আর কখনো দেখিনি। তাই আব্বাকে ঘিরে আমার অন্যতম আনন্দের স্মৃতি এটা। গোপনে লুকিয়ে রাখি, মাঝে মাঝে বের করে নাড়া চাড়া করে দেখি।

দুই: সাঁতার জানো বাপু?!

আব্বার সাথে বায়না ধরে জীবনের প্রথম পুকুরে গোছল করতে গেছি। তখন আমার বয়স প্রায় আট বছর, কিন্তু তখনো সাঁতার শেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু কেন জানি আমি ভাবতাম সাঁতার আমি এমনিতেই পারবো, শেখা লাগবে না। যা হো'ক। যখন আব্বা গায়ে মাথায় সাবান মাখে যেই পানিতে একটা ডুব দিলেন, আমি সেই সুযোগে সাঁতরাতে লাগলাম (জীবনের প্রথম)। সম্ভবত: আব্বা ডুব দিয়ে উঠে আমাকে পানির উপরে দেখতে পান নি,কিম্বা হয়তো খাবি খেতে দেখেছিলেন ঠিক মনে নেই। তবে মনে আছে আব্বা আমাকে উদ্ধার করতে আরেকটু দেরী করলে সেদিনই সলিল সমাধি হতে পারতো। আমাকে সেদিন উদ্ধারের পরে আব্বা এলাকার দু:স্থ মানুষদেরকে দাওয়াত দিয়ে খাইয়েছিলেন মনে পড়ে।

তিন:পিতার অপত্য ছায়া

আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে সূর্যসেন হলে। সে জীবনের বেশীরভাগসময় জুড়ে ছিলো সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিক্ষোভের, আন্দোলনের এবং বিদ্রোহের। হলে হলে ছিলো কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় 'সশস্ত্র ক্যাডার'দের দাপট। মাঝে মাঝেই প্রতিদ্বন্দী দল বা গ্রুপের ক্যাডাররা মেতে উঠতো প্রাণঘাতী বন্দুক যুদ্ধে। সে সব বন্দুক যুদ্ধ সাংগ হলে হলে চলতো বিডিআর-পুলিশের যৌথ কক্ষ তল্লাশী। এ সবই হতো আচমকা, আগে থেকে ঠাহর করার কোন উপায় ছিলো না কখন কোন হল থেকে গোলাগুলী শুরু হবে এবং কবে কোন হলে বিডিআর পুলিশের কক্ষতল্লাশী শুরু হবে। যা হো'ক। একদিন আব্বা অফিসের কি একটা কাজে ঢাকায় এসে বললেন: তোর কাছে এক রাত থাকবো, সেই কবে ক্যাম্পাস ছেড়েছি আর থাকা হয়নি। উল্লেখ্য ,আব্বা নিজে সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। আমি আব্বার সাথে রাতেের খাবার খাওয়ার পরে আব্বাকে একা আমার রুমটি ছেড়ে দিয়ে অন্য এক ছেলের রূমে থাকতে গেলাম (সে সময়ে রাত জাগার অভ্যাস এবং ঘন ঘন সিগারেট ধরানোর বদভ্যাস ছিলো বিধায় পিতা-পুত্রের এক কক্ষে নিশি যাপনের ব্যাপারটি এড়িয়ে গিয়েছিলাম এবং আব্বাকে বলেছিলাম: এক বন্ধুর রূমে এক সাথে পড়াশুনা করবো এবং রাতে সেখানেই থাকবো। সকালে রূমে ফিরে আমরা এক সাথে নাস্তা করবো। আব্বা চুপচাপ শুনলেন, শুধু মৃদু স্বরে জানতে চাইলেন কোন রুমে থাকছিস সেই বন্ধুর রুম নম্বরটা আমাকে বলে যায় , যদি কোন দরকার লাগে...। আমি রুম নম্বরটি বলে চলে গেলাম অন্যরুমে রাত কাটাতে। ভোর রাতের দিকে হলের পন্চম তলার সেই কক্ষের দরজায় মৃদু করাঘাত এবং সেই চেনা ডাক: আব্বা মৃদু স্বরে আমার নাম ধরে ডাকছেন। ধড়মড়িয়ে উঠে দরজা খুলে জানতে চাইলাম কি হয়েছে। আব্বা বল্লেন তিনি দোতলার আমার কক্ষের জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছেন অনেক মানুষের চলাচল এবং ওনার মনে হয়েছে হলে কিছু একটা অস্বাভাবিক পরিস্হিতি হতে পারে, তাই মনে করেছেন যে আমারো এটা জানা দরকার। তখন আমি রুমের জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম নীচে অনেক মুহসীন হল এবং সূর্যসেন হল এলাকায় রেইডের প্রস্তুতি চলছে। আমি ঘুম জড়িত কন্ঠে আব্বাকে বল্লাম আব্বা সম্ভবত হলে রেইড হবে, আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন, কেউ কিছু জিগ্যাসা করলে বলবেন আপনি একজন ছাত্রের পিতা, অতিথী হিসেবে এক রাত হলে অবস্থান করছেন। আমি আবার শোয়ার উদ্যোগ করছিলাম কারন এ ধরনের রেইড তখন মাঝে মধ্যেই হতো বিধায় এটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া আমি ব্যক্তিগতভাবে অনৈতিক কোন ক্যাডারগিরিতে জড়িত ছিলাম না বিধায় আমার বিশ্বাস ছিলো যে এসব রেইডে আমার ভয় পাবার কিছু নেই। যা হো'ক, আমি আবার ঘুমানোর উদ্যোগ নিতেই দেখলাম যে আমার সেই বন্ধুটির চোখে ঘুম নেই। বেচারা অস্থির হয়ে পড়েছে। আমি অত্যন্ত অবাক হলাম এবং পরে শুনেছি যে সেই নিরীহ বন্ধুটির নিরীহ সরলতার সুযোগ নিয়ে কতিপয় অছাত্র ক্যাডার তার রুমে মাঝে মধ্যে স্পর্শকাতর কিছু জিনিসপত্র রাখতো আবার সকালে ফেরত নিয়ে যেতো। আমি এ কথা জানার পরে বলা বাহুল্য দ্রুত সে রুম ত্যাগ করে আব্বার কাছে নিজ রুমে চলে আসি। আজ কয়েক দশক পরে যখনি ফিরে দেখি সে সময়টাকে তখন মনে হয় ভাগ্যিস আব্বা জানতে চেয়েছিলেন: "কোন রুমে থাকছিস সেই বন্ধুর রুম নম্বরটা আমাকে বলে যা , যদি কোন দরকার লাগে...।" ভাগ্যিস!!
[আব্বার অনন্ত বিশ্রাম চিরশান্তিময় হোক এই দোয়া করি: রাব্বির আর হামহুমা কামা রাব্বায়্যানি সাগিরা। হে পরম প্রতিপালক, আমাদের পিতা-মাতা আমাদের শৈশবে আমাদেরকে যে রকম মায়া-মমতায় লালন পালন করেছ্বেন, আপনি তাঁদেরকে তেমন স্নেহ ছাঁয়ায় আশ্রয় দিন! আমিন!]

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০২১ রাত ২:০৫
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×