এক হিন্দুস্তানি সওদাগরের ছিল নানা জাতের পাখি পুশিবার শখ। ইরাকি এক তোতাপাখি ছিল তার বিচিত্র পাখির সংগ্রহশালার সবচে বেহতরিন সংগ্রহ। তো, তিনি একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন, হিন্দুস্তান থেকে ব্যবসা করিবার উদ্দেশ্যে ইরাকে যাইবেন। বাড়ির সবার নিকট হইতে বিদায় নিলেন তিনি। জানিয়া নিলেন, কার কি প্রয়োজন, কে কি ইরাকি তোহফা আশা করে, সওদাগরের কাছে।
সবার সঙ্গে আলাপ খতম করিয়া সওদাগর গেলেন তাহার প্রিয় তোতা পাখির কাছে। তাহাকে পুঁছিলেন, প্রানাধিক প্রিয় পাখি আমার, তোমার মাতৃভূমিতে যাইতেছি। কি আনিবো তোমার জন্যে, তোমার জন্মভূমি থেকে?
পাখি মৃদু হাসিয়া কহিল, শায়েখ, আমার এতোটুকুই কামনা, যদি কোন তোতাপাখির সঙ্গে আপনার দেখা হয় ইরাক সফরে, তাহাকে, বা তাহাদের আমার তরফ থেকে সালাম পৌঁছাইয়া দিবেন, আর দয়া করিয়া তাদের আমার বন্দিদশার কথা জানাইবেন।
সওদাগর বলিলেন, তথাস্তু।
ইরাকে সওদাগর খুব সফল এক বাণিজ্য সফর শেষে, সবার জন্যে হাদিয়া - তোহফা কেনা শেষে, সওদাগর বাড়ি ফিরবেন যেইদিন, সেইদিন ভোরবেলা, তাহার সরাইখানার বারান্দায় তিনি দেখিলেন, বেশ কিছু তোতাপাখি বসা। ইরাকি তোতাপাখি। তার বাড়ির খাঁচায় বন্দি পাখির জাতভাই।
তোমাদের এক ভাই হিন্দুস্তানে, আমার বাড়িতে খাঁচায় বন্দি। তাহার তরফ হইতে তোমাদেরকে সালাম।
সওদাগরের কথাটুকু বারান্দায় বসা সবগুলো পাখি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনিল। তারপর, ঝুপ ঝুপ শব্দে সবগুলো পাখি একসঙ্গে, ঝরা পাতার মতো মরিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল বারান্দা দিয়া, নীচে।
সওদাগর হতবুদ্ধি হয়ে বসিয়া রইলো পুরো ঘটনা অবলকন করিয়া। ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতার কথা তিনি জীবনে শুনিয়াছেন অনেক, কিন্তু এতো তীব্র ভালোবাসা, নিজের স্বজাতির প্রতি, তিনি কখনো শোনেন পর্যন্ত নি, দেখা তো দূরের কথা।
ভারী হৃদয়ে সওদাগর ফিরিয়া আসিলেন হিন্দুস্তান। সবাইকে সবার তোহফা বুঝাইয়া দিলেন। তাহার প্রিয় তোতাপাখির সম্মুখে দাঁড়ইয়া বলিবার মতো কোন কথা তিনি খুঁজিয়া পাইলেন না।
শায়েখ, আমার সালাম পৌঁছানোর ফুসরত হইয়াছিল, আমার ভাইদের কাছে?
তোতাপাখি প্রশ্ন করলো।
করিয়াছিলাম, সওদাগর ভারী হৃদয়ে উত্তর দিলেন। কিন্তু তোমার হালত শুনিবার সঙ্গে সঙ্গে তাহারা সবাই এক সঙ্গে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া মারা গেলো আমার চোখের সম্মুখে।
সওদাগর কথা শেষ করা মাত্রই তাহার প্রিয়তম তোতাপাখি আসমানের দিকে পা উঁচু করিয়া মরিয়া কাঠ হইয়া পড়িয়া রইল।
সওদাগরের মুখে রা নাই। এ কেমন ভালোবাসা, এ কেমন সহমর্মিতা, এ কেমন স্বজাতবোধ? স্বজাতির শোকের কথা শোনা মাত্রই তাহারা মুহূর্তে প্রাণত্যাগ করে?
শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে সওদাগর তাহার প্রিয় পাখির পা জোড়া ধরিয়া ছুঁড়িয়া মারিলেন বারান্দা দিয়া, বাইরের বাগানে। পাখি অনেকক্ষণ সময় নিয়া নীচে পড়িলো, মাটি স্পর্শ করিবে করিবে, এমন সময় সওদাগরের চক্ষু চড়কগাছ করিয়া দিয়ে উড়াল দিয়ে গিয়া বসলো সামনের উঁচু গাছের ডালে।
শায়েখ, প্রিয় তোতাপাখি বলল, শুকরিয়া। আমার সালাম আমার ভাইদের পৌঁছাইয়া দেয়ার মাধ্যমে আপনি আমার মুক্তির সনদ বহন করিয়া আনিয়াছেন তাহাদের তরফ হইতে। না তাহারা মারা গিয়াছিল - আমার বন্দিত্বের কথা শুনিয়া; না আমি মারা গিয়েছি তাহাদের মারা যাওয়ার কথা শুনিয়া। এসবই ছিল আমার মুক্তি লাভের উপায়। খাঁচায় বন্দী অবস্থায় মারা যাওয়ার আগেই মারা যাওয়া, বা অন্তত মারা যাওয়ার অভিনয় করা, যাহাতে আমি পুনরায় মুক্ত বাতাসে উড়িতে পারি।
নিজের নফসকে হত্যা করুন, শায়েখ - শেষবারের মতো মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে ডানা ঝাপটানোর পূর্বে তোতাপাখি মুখ খুলিল সওদাগরের প্রতি। অন্তত হত্যা করার অভিনয়টুকুই করুন, যাহাতে খোদার দিকে আপনার রুহ মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় উড়িয়া চলিতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২২ রাত ১০:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



