somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাদাকালো চিঠি

১২ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ৮:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তোর পেছনে সময় নষ্ট করতে বসব কখনো ভাবিনি। তুই একটা গার্বেজ! তোকে আমি সারাজীবন গার্বেজই বলে যাব। তুই এতোই বড় গার্বেজ, যে এই কথাটা শোনার পরও তুই দাঁত বের করে হাসবি।
যাই হোক, যা বলতে চাচ্ছিলাম- আমি কখনোই নেকা ছিলাম না। কোনো কিছুতে কান্না পেত না। কিন্তু আজ একটু কেঁদেছি। আর কান্না করায় আমি কিছুটা লজ্জিত। আচ্ছা, তুই কী পড়তে পারিস? নাকি শুধু শুধুই কলমের কালি খরচ করছি? তুই জানিস আমি ছোটবেলা থেকেই ব্যাপক কিপটে। কিন্তু তোর পড়তে পারা, না পারার উপর কিছু ডিপেন্ড করছেনা। আমার লেখার ইচ্ছে হয়েছে, তাই লিখছি।
আজকে হঠাৎ একটা কথা খুব মনে পরছে। স্কুলে আমাদের প্রথম দিন। স্কুলে যাওয়ার আগে বাবার কাছে 'অ-আ' শিখে গেছি। কিন্তু তোর বাবা তো গত হয়েছেন তোর জন্মের আগে। তোর মা পড়তে জানতেন না, তোকেও শেখায়নি। স্কুলে সুরুজ মাস্টার ক্লাস নিবেন, বাংলা। আমরা সবাই মেঝেতে বসে, স্যার ঝিমুতে ঝিমুতে বললেন 'শরু, শরা'। আমরাও বললাম সাথে সাথে। এই আমাদের 'অ-আ' শিক্ষা। শরু, শরা আর পেটা কাটা মদিনাষ্য। তোর মাথায় ওসব ঢুকবেনা জানা কথা। তিন দিনের মাথায় স্যার পরা ধরলেন। আমি বলে দিলাম ঠিকই, কিন্তু তুই পারলিনা। মনে আছে, বাকিদের মেরে স্যার বেত অর্ধেক ভেঙে ফেলেছিলেন। ঐ ফাঁটা বেত দিয়ে তোকে এক ঘা দিতেই পিঠে রক্ত। স্যার লক্ষ্য করেননি। আরেকটা দিতেই তুই দিলি ভোঁ দৌড়। এরপরে তোকে আর স্কুলমুখো হতে দেখিনি। এই হল তোর তিনদিনের ছাত্রজীবন। আমি হাই স্কুলে উঠেই শহরে চলে এলাম। তোর সাথে আর যোগাযোগ ছিলনা বাড়িতে না আসলে।
তুই নাকি সবাইকে বলে বেড়িয়েছিস আমি তোর ইশকুলের বন্ধু। আমি শুনে খুব হেসেছি।
আমার সঙ্গ তোকে আনন্দ দেয় জানি। প্রতিবারই দেখেছি গ্রামে আমাকে পেলে তুই সব ভুলে বসে থাকিস। আমি জানি তুই সবসময় আমাকে খুব ভালো বন্ধু ভেবে এসেছিস। তাও আবার ইশকুলের বন্ধু, খুব স্পেশাল ব্যাপার। কিন্তু, আমাদের বন্ধুত্বটা একটু অন্যরকম ছিল। আমার বলতে একটু লজ্জা লাগছে যে আমি তোকে কোনোদিনই আমার ভালো বন্ধু ভাবিনি। শত্রুও ভাবিনি। আসলে তোকে নিয়ে কিছুই ভাবিনি। তুই একটা তোতলা গার্বেজ ছাড়া কিছু ছিলিনা। গার্বেজ অর্থ বুঝিস তো? যাক বাদ দে।
তুই হয়তো চিঠিটা পড়লে কষ্ট পাবি। কিন্তু আমার কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করছে। কোনো কিছু হলে আমি সবসময় তোর উপরই দোষ চাপিয়েছি। কারণ তুই একটা আস্তো গার্বেজ। তুই এতটাই গার্বেজ যে আমি তোকে অপমান করলে, গাল দিলেও তুই দাঁত বের করে হাসতি। গার্বেজ কোথাকার! তুই অতি নিম্ন পর্যায়ের গার্বেজ ছিলি বলেই তোদের ঘরে দুয়েকদিন ভালো কিছু রান্না হলে তুই আমাকে ছাড়া খাসনি। কিন্তু তুই আসলে আমাকে ছাড়াই খেয়েছিস। কারণ তোর মা'র দিয়ে যাওয়া ঐ খাবারগুলো আমি একদিনও খাইনি। তোদের নোংরা রান্নাঘরটা দেখলে আমার ঘেন্না পেত।
কিন্তু এই কথাগুলো শোনার পর তুই কাঁদবি না দাঁত বের করে হাসবি আমার খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। গার্বেজ কোথাকার!
আমি তেমন নস্টালজিয়ায় কাতর হইনা। এই শহরে বসে গ্রামের কথা ভেবে কোনো বুদ্ধিমান কষ্ট পাবেনা। কিন্তু একটা কথা খুব মনে পরছে।
তোর মনে আছে? চ্যায়ারম্যানের বাগানে আম কী পরিমাণে ধরেছিল সেবার! আমি বললাম আম খাব। তুই তো তোতলাই ছিলি ছোট থেকে। ভয় পেলে যা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ত। তুই তোতলামোতে যা বললি তার সারকথা হচ্ছে ধরা খেলে উপায় নেই, পাশের গ্রামের কোন ছেলেকে নাকি উদুম পিটিয়েছে ধরা পরায়। কিন্তু আমি তো আম খাবই। আমি গাছে চড়তে পারিনা বলে তোকে পাঠালাম। আমি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। তুই আম পেরে নিচে দিচ্ছিলি। হঠাৎ কোত্থেকে ভোট-ঘরের চৌকিদার এসে হাজির। চ্যায়ারম্যান তাকে বাগান দেখভালের জন্য নাকি আলাদা টাকা দিতেন। চৌকিদারের দয়ামায়া বলতে কিছু ছিলনা। টের পেয়ে আমি তো আম হাতে দৌড়! কিন্তু তুই তখনও গাছে, টেরই পাসনি। আমি তোকে ডেকে দিলে হয়তো তুইও পালিয়ে যেতি। তোকে দৌড়ে ধরবে কার সাধ্যি। চৌকিদার আমায় পালাতে দেখেও টু শব্দটি করেনি। তোকে আগেই গাছে দেখে নিয়েছিল সম্ভবত। হাতের কাছে শিকার পেয়ে দৌড়োতে যাবে কেন!
সেবার কেমন মার খেয়েছিলি আমার মনে পরলে গা হিম ধরে যায়। আমি একটু পরে ফিরে এসে লুকিয়ে ছিলাম সদর দর্জার পাশে। দেখলাম তোকে মারছে খুব। পায়ে রক্ত ঝড়ছে এতক্ষণে। কিন্তু জানিস, তোর রক্ত আমার বুক কাঁপায়নি তখন, কাঁপাল অন্যকিছু। ওরা তোকে জিজ্ঞেস করছিল আম নিয়ে পালিয়েছে কে? আমি মনে মনে ঠিক করছিলাম আমার নাম বলে দিলে তোকে আরেক ঘা দেব। কিন্তু তুই বললিনা। তোতলামোতে কি যেন বললি বোঝা গেলনা। কিন্তু আমার নাম বলিসনি বুঝতে পেরেছি। শেষে যখন তোর প্রাণ যায় যায় অবস্থা, চ্যায়ারম্যানের বড় ছেলে এসে তোকে ছাড়িয়ে দিল। মার খেয়ে পরলি জ্বরে। সে কী জ্বর! আমার মা খুব আদর করত তোকে। দু'দিন বাদে মা আমাকে নিয়ে গেল তোকে দেখতে। তোদের ছোট্ট ঘরটাতে একটাই খাট, তুই আর তোর মা থাকিস, হয়ে যায় তাতে কোনোমতে। দেখলাম তাতে একটা কংকাল শুয়ে আছে। মা'কে দেখে তুই উঠে বসতে দিতে চাইলি, পারলি না। মা এসব দেখে সহ্য করতে পারল না। প্রায় সাথে সাথেই বেরিয়ে আসল। মা খুব কেঁদেছিল সেদিন। বাবাকে বলে চৌকিদারকেও কথা শুনাল। কিন্তু আমার কান্না পেল না। তবে আমার ভয় লাগছিল ভেবে, তুই যদি আমার নাম বলে দিতি আমারও এমন হতো।
কিছুদিন আগে খবর পেলাম তুই নাকি খুব অসুস্থ। জন্ডিসে মরতে বসেছিস। গ্রামে যাওয়া হয়না অনেকদিন। মাঝখানে তুই বিয়ে করলি, তোর মা মরল, তাও যাইনি। আমি অনেক কাজে ব্যস্ত থাকি। গ্রামে যাওয়ার কথা ভুলেও ভাবতাম না। কিন্তু তুই নাকি মরার আগে আমাকে দেখতে চেয়েছিস। গার্বেজ কোথাকার! এবার না গেলে খুব বাজে দেখাত। আমার প্রচুর কাজ। তাও গেলাম, প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম তুই মরেছিস। জনে জনে আফসোস করছে, আমাকে নাকি খুব দেখতে চেয়েছিলি।
তুই মরেই গেলি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আমার কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে। তোর মুখটা ভেসে উঠছিল বারবার চোখে। তোকে নিয়ে ভেবে আমি আগে কখনো সময় নষ্ট করিনি। এখন ভাবছি, সাদাকালো ভাবনা।
বিকেলে তোর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মনে করছিলাম ছোটবেলার কথা। তোর কথা মনে করেও যে আমার চোখ ভিজবে কোনোদিন ভাবিনি। জানিস, এখন নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে কিছুটা। এখন যদি তোর ইশকুলের বন্ধুর সামনে এসে একটু দাঁড়াতিস, এই অমানুষটা আর কিছু না পারলেও একবার স্যরি বলত।
আচ্ছা, স্যরি অর্থ জানিসতো? এটাও জানিসনা, আমি শিওর। গার্বেজ কোথাকার!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১২:৩০
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×