ছাদে একলা বসে আছে অনেক্ষণ, মওলানার ছেলে পিকথল। তার পকেটে চিঠি, মাথার উপর কালো মেঘ। বৃষ্টি নামবে। পিকথল চিঠিটা বের করে কাগজের ভাঁজ খুলল। পড়তে পড়তে মওলানার ছেলে হঠাৎ বাংলা অক্ষরের প্রেমে পরে, যেমনটা তালিব মাস্টারের মেয়ে পরে আছে তার উপর। চিঠিটা তারই দেয়া।
মেয়ের হাতের লেখা ঐশ্বরিক। পিকথল চিঠিটা পড়ল দু'বার, আর ঠিক করল এখন থেকে ওর প্রিয় যুক্তবর্ণ হচ্ছে 'ক্ষ'। আর সেই সাথে ওর মনটা হয়ে গেল খারাপ, কেন কেজানে। সে আকাশের দিকে তাকায়, চোখে মুখে কিছুটা দার্শনিক ভাব। সে ভাবে মানুষ কেন প্রেমে পরে? উত্তর নেই। সে চুপ করে চেয়েই থাকে, আকাশ দেখে। হঠাৎ মনে হয় চিঠির একটা উত্তর দেয়া দরকার। কিন্তু এতো সুন্দর করে ও লিখতে পারবেনা। পিকথলের মন খারাপ আরো ঘন হয়। ভেবে আফসোস করতে থাকে, ওর মধ্যে আসলে সাহিত্য নেই। সাহিত্যের কিছুটা থাকলে অবশ্যই আকাশের দিকে তাকালে মেঘের জায়গায় অন্য কিছু, অলৌকিক কিছু দেখতো। সে মেঘই দেখে, যেমন এখন দেখছে মন খারাপ করা কালো মেঘ। চিঠির উত্তর তবে আর দেয়া হবেনা বোধ হয়। চিঠি প্রেরকের প্রেমে পরা ব্যর্থ হতে পারে। আর সফল হওয়ার সুযোগ খুব কম, যদি পিকথল এগোয় তবুও। মেয়েটা ওর ছাত্রী, বাসায় গিয়ে কুরআন পড়ায়।
বৃষ্টির ফোঁটা পরল চিঠিতে। ভিজতে থাকে ওর মাথার পাগড়ি আর ঘেয়া রঙের আলখেল্লা। পিকথল মাথার পাগড়ি খুলল, মাথায় চিঠিটা রেখে আবার পাগড়ি পরে নিল। ও চিঠিটা আরো কয়েকবার পড়বে। এখন ও ঘরে যাবে। বৃষ্টিতে ভিজতে ওর ভালো লাগেনা।
ছাদ থেকে নামার সিঁড়িতে দেখা হয় ওর দূরসম্পর্কের চাচাতো বোনের সাথে, যার মুখ ও আজ পর্যন্ত দেখেনি। মেয়েটা বোরখা পরা, মুখ ঢাকা। পুরুষের উপস্থিতি টের পেয়ে গা কুঁচকে সিঁড়ির এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়ের বয়স ষোল হবে। পরহেজগার পরিবারের পরহেজগার মেয়ে। সে মাথা ঢেকে রাখে এমনভাবে যাতে তার সুন্দর হালকা লালচে চুলগুলো কোনো পুরুষের চোখে না পরে। চুলগুলো তার খুব প্রিয়। সে চায়না এই চুলগুলোই বিষাক্ত কোনো সাপ হয়ে তার সারা গায়ে কামড়াক। সে সাপ ভয় পায়।
পিকথল তার এই বোনের মুখ কখনো দেখেনি, কন্ঠ শুনেছে। মেয়ের কন্ঠ সুন্দর, তিলাওয়াতের গলা ভালো। ও এক মুহূর্ত থামল সিঁড়িতে, কেন থামল কেজানে, কিন্তু থামল। তার এই থেমে যাওয়া মেয়েটার বুকের পানি শুকিয়ে দিয়েছে। তার কুঁচকে রাখা শরীর আরো সংকোচিত হয়। শক্ত হাতে ধরে রাখে রেলিংটা। সেই হাত কালো মোজায় ঢাকা। পিকথল আর দাঁড়াল না। সে চলে যাওয়ার পরও কয়েক মিনিট মেয়েটা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। বুক কাঁপছিল তখনো।
আর, তখন মেয়েটা চোখ বন্ধ করে কল্পনা করছিল পিকথলের চোখ, একা থাকলে যা কল্পনা করে তার অদ্ভুত মোহভরা কিছু মুহূর্ত কাটে। আবার বরবারের মতো মনের বিরুদ্ধে তওবা করে সে। তার মাথায় পুরুষের চিন্তা, শয়তানের প্ররোচনায়, ভয়ংকর গুনাহ। সৃষ্টিকর্তার নারাজির ভয়ে সে পিকথলের কথা ভুলতে চায়। সাথে সাথেই আবার একটু আগে পাওয়া অদ্ভুত অনুভূতির কথা মনে পরে। ঈমান আর মনের লড়াই চলতে থাকে। কিছুক্ষণ সে থাকে মনের দখলে। আর মনে মনে ধন্যবাদ জানায় মা'কে। মা ছাদ থেকে কাপড় আনতে না পাঠালে এই জীবনে পিকথল হয়তো তার এতটা কাছে আসত না কখনো। একটু আগে তাদের মধ্যে দূরত্ব খুব সম্ভবত দুই ফিটও ছিলনা। ভেবে শিহরিত হয় মেয়েটা। যদিও অভিজ্ঞতাটা ভয়াবহ।
মুহুর্তে সে আবারও দুর্বল। কান পেতে শোনে ইবলিশের কুবুদ্ধি। সে ভাবে, যে কথা বলছে ভেতরে, সে কী সত্যিই বিপথগামী? এতো কেন ইচ্ছে ওর? চিন্তায় বাজেভাবে আচ্ছন্ন হওয়ার আগেই মেয়েটা কিন্তু ঠিকই আবার শক্ত হয়। কঠিন মনে ওয়াদা করে, যে ওয়াদা সে ভেঙেছেও কম করে হলেও হাজারবার; সে ওয়াদা করে পিকথলের কথা সে আর চিন্তা করবেনা। আর মনে করতে থাকে কিছু পবিত্র বাণী। পরকালের শাস্তির ভয়ে সে শিউরে ওঠে, তওবা করে আবার।
হঠাৎ বজ্রপাতে মেয়েটার চিন্তার কুয়াশা দূর হয়, কিছুটা অপ্রস্তুতভাবে। জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। শুকোতে দেয়া কাপড়গুলো ভিজে গেছে আবার। দৃশ্যটা খুব কষ্ট দিল ওকে। পিকথল ওর মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে। মনে মনে আবারও বাতিল করা হলো পিকথলকে, আর চোখ বেয়ে পরল পানি। খুব প্রিয় কিছু কুরবানি করলে যেমন হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১:০০