পড়,পড়,পড়-৯
কী মুনির মিয়া, এসে পড়লা দেখছি!
আহসানউল্লাহ হলের গেটের সামনে রিকসা থেকে নামতে দেখা হয়ে গেল রুমি ভাই-এর সঙ্গে। তিনি সম্ভবত বন্ধে বাড়ি যান নাই। আমাকে দেখে ব্যাগ নেওয়ার সহায়তা করলেন।
কী বলবো, বুঝতে পারছি না। তাই চুপ থেকে রুমি ভাই-এর সঙ্গে হেটে ১২৭ নম্বর রুমের সামনে গেলাম। মনে হচ্ছে রুমমেটরা কেও ফিরে নাই। ব্যাগ রেখে হাত-মুখ ধুতে গেলাম। রুমি ভাই দাড়িয়ে আছে।
‘চল, তোমাকে চা খাওয়াই।”
আমি আর রুমি ভাই আহসান উল্লাহ হলের কেন্টিনের দিকে হাটা দিলাম। পথেই দেখা হয়ে গেল রুমি ভাই-এর রুমমেট। ওনাকে আমি আগেই খেয়াল করেছি। তবে, কথাবার্তা খুব একটা হয়নি। রাফু ভাই (স্থপতি কাজি আনিস উদ্দিন ইকবাল, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বিল্ডিং ফর ফিউচার) আমাকে দেখে হাসলেন। বললেন – কি, ফিরে আসলা তাইলা?
বুঝলাম রুমি ভাই আমার না ফেরার প্রত্যয় জনে জনে বলে ফেলেছেন। কী আর করা।
কেন্টিনে বসে রুমি ভাইকে বললাম – আমার ফিরে আসাতে আপনি মোটেই অবাক হোননি। আর যদি জানতেন যে আমি ফিরবো তাহলে তখন বললেন না কেন। আমার প্রায় কান্না পাচ্ছে!
“দুইটি কারণ। প্রথমত আমি চেয়েছি তুমি নিজের বোধে ফেরৎ আসো। আর আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, তুমি ফিরবা কারণ তোমার মত আমিও দুই সপ্তাহ পর বুয়েট থেকে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু জলেশ্বরীতলা যাওয়ার আগেই বুঝে ফেলেছিলাম আমার কোন বিকল্প নাই।”
যাক, আমি তাহলে একা না।
চা খেতে খেতে রুমি ভাই যে কথাগুলো বলেছিলেন তার বেশিরভাগই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়র জন্য দায়ী। আমাদের বেঁচে থাকা যে একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব সেটা আমি সেদিনই অনেকখানি বুঝে ফেলেছিলাম। তবে, সবচেয়ে বেশি বুঝেছিলাম – নিজের কাজটা করে যাওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে বড় এবাদত, সর্বোত্তম প্রত্যয়। ফলাফল নিয়ে ভাবার কিছু নাই। প্রাণপণ এবং সর্বোচ্চ চেষ্টায় যা হবে সেটাই ফলাফল।
রুমি ভাই আমাকে রুমে রেখে যাওয়ার সময় একটা আপ্ত বাক্য বলে গেলেন। পরে জেনেছি এটা ‘চিনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান’ কমরেড মাও সে তুং-এর একটা বিখ্যাত বানী
পড়, পড় এবং পড়!
তো, আমি বুঝে গেলাম আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে বুয়েটে ফেল করতে পারবো, হলের অন্যান্য আদু ভাই-দের মতো হতে পারবো কিন্তু তার চেয়ে খারাপ হতে পারবো না। অন্যদিকে পড় পড়ে আমি যদি নতুন একটা জগৎ বানিয়ে ফেলতে পারি তখন আমার নিজেরই একটা জগৎ হয়ে যাবে। তখন আমাকে কে ঠেকাবে?
এর কয়েকদিন পর, হলের কমন রুমের পাশের রুমটা খোলা দেখে সেখানে উকি মারতে দেখি সেখানে সারি সারি আলমিরা আর আলমিরা ভর্তি বই। একজন দাড়িওয়ালা চাচা মতোন (নামটা মনে নেই) বসে আছেন। তার কাছ থেকে জানলাম এটি “হল লাইব্রেরি।”
কেন যে আগে দেখলাম না।
দেখলাম আমার সব স্বপ্নের বই সেখানে।
নাম শুনেছি কিন্তু কোনদিন পড়তে পারি নাই এমন একটা চরিত্র হর্ষবর্ধন। দীর্ধদিন ধরে জেনেছি “চক্কোরবরতীরা কঞ্জুষ হয়”। কিন্তু চট্টগ্রামে কারো বাসাতে কোনদিন শিবরামের কোন বই দেখি নাই। কিরিটি রায়ের যে অমনিবাস আছে সেটাই তো জানতামই না। রবীন্দ্র রচনাবলী একটা বাসাতে ছিল। কিন্তু মানিক বন্দোপাধ্যায়ের রচনাবলী? কবর ছাড়াও মেট্রিকের ব্যাকরণ বই-এর রচয়িতা মুনির চৌধুরীর যে আরো বই আছে সেটাই বা কে জানতো।
চাঁদে অমাবস্যা নামে লাল-শালুর লেখকের একটা বইও সেখানে আছে। সেটি পড়ার পর এতো আপ্লুত হলাম যে, কয়েকদিন ধরে কিছুই মাথায় ঢুকলো না। আমার অবস্থা দেখে রুমি ভাই বললেন – আরে চাঁদে অমাবস্যাতে এই অবস্থা। আউটসাইডারে তোমার কী হবে?
আউটসাইডার? আলবেয়ার কামু? ম্যাকিয়াভেলির প্রিন্স? সামুয়লেসনের ইকোনমিক্স? চানক্যের অর্থশাস্ত্র?
এসবের মানে কি। এতসব বই আমি কেমনে পড়বো? সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত জটিল বিষয়!
কী হবে অতো ভেবে। বরং আমি পড়তে শুরু করি।
এর মধ্য রুমি ভাই একদনি খবর দিলেন ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে আরো একটা লাইব্রেরি আছ-সিডিএল। ওতো দূরে যাওয়ার সামর্থ কেমনে হবে। হল থেকে হেটে সায়েন্স ল্যাব। তারপর বাস শংকর। মেম্বার হয়ে আসলাম।
শুরু হল আমার নতুন জগতের কাজ। মুজতবা আলী আদ্রে জিঁদের কথা কেন বলেছিলেন সেটা বুঝতে শুরু করেছি। আর এর পর একদিন জানতে পারি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কথা। এই নোটের প্রথম পর্বে রয়েছে সেই কথা।
ততদিনে বুঝে ফেলেছি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস না করলেও জগত বানাতে আমার কস্ট হবে না।
ক্লাস টেস্ট কিংবা সেমিস্টার পরীক্ষা আসুক।
আসুক পরীক্ষা। পরীক্ষারে আর ডরাই না।
[যারা আমার ১০ পর্বের এই সিরিজ নোট পড়েছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। কী বোর্ড যদি কখনো ফিরিয়ে আনে তাহলে একদিন হয়তো আমার বুয়েট লাইফের অন্য গল্পগুলোও করা যাবে। স্মৃতিচারণই তো বুড়োদের কাজ! ততদিন পর্যন্ত সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক]