somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া অথবা পাঁচকড়ি গুছাইতের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হাতের গল্প...

০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ রাত ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গতমাসের ১৩ তারিখ থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ভারতের পঃবঙ্গের বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়িয়েছি। গিয়েছিলাম অসুস্থ মাকে দেখতে, আমার মা থাকেন মুর্শিদাবাদের কান্দীতে। কান্দী সুন্দরপুরের কিছু বর্ণনা আপনারা ইতিমধ্যেই মনজুরুল হকের সদ্য প্রকাশিত বই 'আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস'য়ে পড়েছেন। খোঁজাখুজি করে সুন্দরপুরের মনজুভাইদের সেই আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছিলাম... বোঝার চেষ্টা করেছি অধিকাংশ পঃবঙ্গের বাঙালি মুসলমানেরা কেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকদের অপছন্দ করতেন, পাকিস্তান ভাঙার দায়ে আমাদের নিন্দা করতেন।

মুর্শিদাবাদ কোলকাতা শিলিগুড়ি কালিমপং সহ পঃবঙ্গের বিভিন্ন শহরে আমার ঘুরে দেখার সেই বর্ণনা নিয়ে শুরু করলাম, আমার নতুন সিরিজ। প্রথম পর্ব কান্দী...


পাঁচকড়ি গুছাইত বাসে করে গঞ্জের হাটে যাচ্ছিল, আর এমন সময় ঘটে যায় দুর্ঘটনাটি...

কান্দী থেকে বহরমপুরের যাওয়ার এই রাস্তায় চোখে পড়ে বিস্তর দেব দেবীর থান — মা শেতলা, মা কালী থেকে ত্রিশুল পোঁতা শিব- মায় ঘোর শনিদেব পর্যন্ত। কিছুটা জায়গা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো, তার ওপর লেপটে রাখা সিঁদুর- কখনো সখনো দুই এক গাছি ফুল বেলপাতা। দেবদ্বিজে অচলা ভক্তি পাঁচকড়ি চলতি পথের মাঝে ঠাকুরের থান দেখলেই হাত দুটো জড়ো করে কপালে ছুইয়ে প্রণাম জানায়। এটা তার বরাবরের অভ্যাস।

কান্দীর রাস্তা ততটা প্রশস্ত নয়, কিন্ত তাই বলে উল্টোদিক থেকে আসা ট্রাকটা বাসের এত কাছ ঘেঁষে যাবে, এতটা ভাবা যায় নি। পুরন্দরপুর ব্রীজের ঢালুর মুখে ফি বছর শিবের গাজনের মেলা বসে, স্থায়ী একটা শিবের থানও আছে — পাঁচকড়ি তখন হাত উঁচু করে শিবের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাচ্ছে, বেখেয়ালে ডান হাতের কনুই যে জানালার বাইরে- টেরই পায় নি। হুড়মুড় করে কেমন একটা আওয়াজ হলো, বাসের লোকজন সভয়-বিস্ময়ে দেখলো জানালার ধার ঘেঁষে বসা পাঁচকড়ি গুছাইত রক্তাক্ত কনুই চেপে বাসের মেঝেতে বসে কাতরাচ্ছে। তার কনুইয়ের নিচে হাতের কোন অংশ আর নজরে পড়ে না — তার ডান হাতটি যেন আচমকা খাটো হয়ে গেছে...

বিস্তর হৈ চৈ এর মাঝে ড্রাইভার সোজা বাস চালিয়ে এনে তোলে বহরমপুর হাসপাতালে। ব্যাবসায়ী হিসাবে পাঁচকড়ি গুছাইতএর যথেষ্ট সুনাম আছে। কান্দী বাজারে রয়েছে তার বেশ জমকালো থান শাড়ী আর কাটা কাপড়ের পাইকারি দোকান। টাকা পয়সার চিন্তা ছিল না, ডাক্তাররা যত্ন নিয়েই চিকিৎসা দিলো। শুরুতেই চেষ্টা হলো রক্ত বন্ধ করার, তারপর শুরু করে দেওয়া হলো, ক্ষতের চিকিৎসা।

প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে উঠার পর ডাক্তার জানিয়ে দেয়- তাদের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব, তারা তা করেছে, এখন উন্নত চিকিৎসা দিতে চাইলে রুগীকে চেন্নাই বা ব্যঙ্গালোরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। দুর্ঘটনার সাতদিনের মাথায় টানা দুই রাত্রি ট্রেন যাত্রার পরে যখন চেন্নাই পৌছে পাঁচকড়ি গুছাইতকে ডাক্তারের হাতে সঁপে দেওয়া হলো তখন জানা গেল সেই আফসোসের ঘটনাটি। ট্রাকের ঘঁষা খেয়ে ছিড়ে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হাতটা পাওয়া গেলে, সেটা নাকি ডাক্তারেরা শরীরের সাথে দিব্বি জুড়ে দিতে পারতেন। ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞান নাকি এতটাই এগিয়ে গেছে।

সাথে সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হোল কান্দীতে, ছিঁড়ে আলাদা হয়ে যাওয়া সেই হাতটি খুঁজে পাওয়া যায় কিনা — পথের পাশের লোকালয় আর গ্রামগুলিতে শুরু হলো খোঁজাখুঁজি। শেষে খবর গেলো স্থানীয় থানায়, তাদের কাছে কোন খোঁজ আছে কিনা- জানা গেল ঘটনার পরপরই কয়েকজন গ্রামবাসী কাটা একটা হাত থানায় জমা দিয়েছিল বটে, মালখানায় সেটা একরাত পড়ে থাকার পর সর্ব সম্মতি ক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে পুরোহিত ডেকে ধর্মীয় বিধান মোতাবেক সেই কাটা হাতের সৎকার করা হবে।

উপস্থিত কেউ কেউ দাহ করার প্রথার কথা তুলেছিল বটে, কিন্ত ঠাকুর মশায় (পুরোহিত) তার স্থির সিদ্ধান্তে অটল থাকলে — এরপর হুবহু মৃত মানুষের আদলে রীতিমত শ্রাদ্ধ শান্তি স্বস্ত্যয়নের পরে, মাটিতে গর্ত খুড়ে সেই কাটা হাত সমাধিস্ত করা হয়।

হাতকাটা পাঁচকড়ি এখন পুরো সুস্থ্য। কান্দীর দোহালিয়া বাজারে তার কাপড়ের ব্যাবসায় আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ডান হাতের কনুইএর প্রান্তভাগ দিয়ে টাকার বান্ডিল চেপে ধরে বাঁম হাতে টাকা গুনতে গুনতে দোকানে উপস্থিত মাল কিনতে আসা গ্রাহকদের সে শোনায় চেন্নাই এর হাসপাতালের সেই সার্জনের নিপুন দক্ষতার কথা... শরীরের যে কোন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রত্যঙ্গের নিপুন হাতে ফের শরীরে জুড়ে দেওয়ার অত্যাধুনিক চিকিৎসার সাফল্যের কথা। ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞান যে কত এগিয়ে গেছে এটা নিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে কোন মতান্তর চোখে পড়ে না। জাতীয় গর্বে কান্দীবাসীর বুক ফুলে উঠে।

শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তার সেই ডান হাতটির কথা ইদানিং পাঁচকড়ির মনেও পড়ে না।


সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ রাত ২:১১
৯টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×