বাংলাদেশ এখনও কৃষি ভিত্তিক একটি দেশ। একবিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্ব যেখানে শিল্প, প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে-তখনও বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর একটি দেশ হওয়া সত্বেও কৃষিতে আধূনিকতা দিয়ে উন্নয়ন করতে ব্যার্থ হয়েছে। তারপরেও এখনও আমাদের জাতীয় উন্নয়নে ৭০ শতাংশ অবদান রাখছে। বিষয়টি দেশের জন্য প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় অন্তত তিনটি দিক সরকারের নজর রাখতে হবে-
১. আমাদের দেশে কৃষি পরিসংখ্যানে নানা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। দেশের কৃষি উত্পাদন, পণ্যমূল্য, জিডিপি, ব্যাংকের আয়-ব্যয় হিসাব এমনভাবে গ্রন্থনা করা হয় যাতে আমলা ও ব্যবসায়িক সমাজ উপকৃত হয়। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, কৃষক এখন আগের চেয়ে সচেতন। তাদের চিন্তাশক্তির উন্মেষ ঘটছে এ বিষয়টা আমলারা আমলে নেন না। নিলে অমুক দেশের চেয়ে আমাদের দেশে পণ্যমূল্য অনেক কম, এসব ব্যাখ্যা দিতেন না। সবাই জানে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে এদেশে কৃষকের আয় কম। গম, আলু, লবণসহ দেশীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি মনোভাবে কৃষক সমাজ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আগামীতে এগুলো উত্পাদনে তাই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
২. বাংলাদেশের অধিবাসী হিসেবে কৃষকের নিশ্চয়ই কিছু অধিকার রয়েছে। রয়েছে সঠিক তথ্য পাওয়ার অধিকার। নিজের জমিতে পছন্দমত ফসল ফলানোর অধিকার, তাদের পণ্য রফতানির অধিকার, আমদানি পণ্যে ভর্তুকি না দেওয়ার দাবি করার অধিকার, সরকারি প্রতিষ্ঠানের চার্টার প্রণয়ন ও চার্টার অনুসারে সেবা প্রাপ্তির অধিকার, নির্ভেজাল উপকরণ প্রাপ্তির অধিকার ইত্যাদি। বর্তমানে বাংলাদেশে নতুন-পুরানো মিলে প্রায় ৮৭টি আইন, অধ্যাদেশ, প্রবিধি/সংবিধি, নীতিমালা, রুল-রেগুলেশন, বিজ্ঞপ্তি, কর্ম-কৌশল, জরুরি করণীয় প্রভৃতি রয়েছে। এসব দলিল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন যে এগুলোতে কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় সক্ষম হচ্ছে না।এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত কৃষিবিদের নেতৃত্বে কর্মসম্পাদন করতে হবে। কৃষি ও কৃষকের বাজেট বিষয়টিও অত্যাবশ্যকভাবে এখানে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
৩. বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দুনিয়ার মানুষ ও প্রতিষ্ঠান বলছে- নিজস্ব বা দেশীয় উত্পাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু উত্পাদন বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে খুব কম। দেশে কৃষি উত্পাদন বাড়ানোর একমাত্র উপায় হল উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে হেক্টরপ্রতি উত্পাদন বাড়ানো। কিন্তু এখন পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না দেশে কী পরিমাণ উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে এবং কী পরিমাণ কৃষক পর্যায়ে ব্যবহূত হচ্ছে।
২০০৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের (বার্ক) মাধ্যমে একটি প্রযুক্তির তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে তিনশ’র মত প্রযুক্তির শিরোনাম ছিল। এসব প্রযুক্তি কোন এলাকায় কী পরিমাণ জমিতে ব্যবহার হচ্ছে তারও কোনো উল্লেখ ছিল না। এখনো হয়ত পূর্ণাঙ্গ তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন কৃষক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তাই প্রয়োজন হচ্ছে মাঠপর্যায়ের বিস্তারিত তথ্য জেনে প্রযুক্তি প্যাকেজ করে এবং এর উপযুক্ত এলাকায় বা জমিতে সম্প্রসারণ ঘটানো। যাতে করে উপকারভোগী কৃষক বাস্তবিক উপকৃত হতে পারে । ষাট-সত্তর দশকে বলা হয়েছিল বাংলাদেশে ২০০০ সালের পর কী হবে তা কেউ জানে না। কিন্তু বাস্তবে ২০১১ সালেও ১৬-১৭ কোটি মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচে আছে-কিন্তু মানুষ সুখে নাই। এদেশের মানুষ আগামী ২০২০-৩০ সালেও থাকবে। তবে বর্তমান থাকাটা আগের চেয়ে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তন, জমি কমে যাওয়া, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়া, ব্যবসায়ী দুর্নীতির আগ্রাসন ইত্যাদি।
কঠিন বাস্তবতা হছে-বর্তমান কৃষি মন্ত্রী কৃষকদের যেসব সুযোগ সুবিধা প্রদানের কথা(বিনা মূল্যে/স্বল্প মূল্যে সার, কীট নাশক প্রদান, সেচের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ, বিনে পয়শায়/ কম দামে উন্নতমানের বীজ সরবরাহ, সেচের জন্য কল মূল্যে জালানী সরবরাহ, সহজ ব্যাংক ঋণ-ইত্যাদি) প্রতি নিয়ত বক্তৃতা বিবৃতিতে বলেছেন-তা প্রায় সবই হাওয়াই কথা। বাস্তবতা সম্পূর্ণই ভিন্ন। এজন্য সরকারকে কেবল একটি কথার কাজ, একটি নীতিগত কাজ এবং একটি কারিগরি কাজ করতে হবে। কথার কাজটি হল- সরকারকে স্বীকার করতে হবে যে কৃষির প্রতি অতীতের মত বর্তমানেও চরম অবহেলা চলছে। আর অবহেলা করা হবে না। কৃষির ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হবে। সেবক জনবল বাড়ানো হবে। মাঠপর্যায়ে সেবা কাজের পরিবেশ তৈরি করতে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে। নীতির কাজটি হল- বর্তমানের কম বেশি ৮৭টি আইন নীতিতে সমন্বয় এনে তাতে কৃষি ও কৃষকের দায়িত্বমত অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কৃষক তার জমিতে তার নিজের চাহিদা/পছন্দ মোতাবেক কাজ করতে পারবে।
কারিগরি কাজটি হল- উন্নত কৃষি প্রযুক্তি হিসেবে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহ প্যাকেজ করে যথাস্থানে প্রয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। পরিবর্তিত জলবায়ুর উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। আশা করি সরকারের ২১ এর পরিকল্পনায় এ বিষয়গুলো বিবেচিত হবে। ফলস্বরূপ দেশে দুর্নীতি প্রশমিত হয়ে দারিদ্র বিমোচন হবে। কৃষক হাসবে। কৃষক হাসলে দেশ হাসবে। অর্জিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা।
(এই লেখাটি "বেসরকারী কৃষি সহায়ক পণ্য বিপনণ প্রতিষ্ঠান এসোশিয়েশনে"র পক্ষ থেকে সরকারের নিকট প্রদান করা হয়েছে-যা এগ্রো কন্সাল্টেন্ট হিসেবে আমার লেখা। লেখাটি এখানে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



