somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ম্যাকডোনাল্ডস

১৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এ যেন এক অন্যরকম যুগের আগমন! দুপুরবেলায় পার্ক স্ট্রিটের ধুলোবালির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দূর থেকেই রমেশের নজরে পড়ল ধনুকের মতন বাকা হয়ে থাকা ঝলমল করা সোনালি চিহ্ন “রবীন্দ্র এক্সপ্রেস: যেখানে সংস্কৃতি, বিনোদন আর চিত্ত একাকার!” একটা বড় বিলবোর্ডে রবীন্দ্রনাথের হাসিমুখ; চোখের নিচে লেখা, "সংস্কৃতির সুলভ অফার রবীন্দ্রনাথের ফাস্ট ফুড - ম্যাকেন্দ্রনাথ।"

রমেশ হাসল। “এটা তো ঠিক ম্যাকডোনাল্ডসের মতো! সবাই এসে রবীন্দ্র-বাবুর কয়েক লাইন খেয়ে চলে যাচ্ছে। কবিতা, গীত, আর নাটক সব এক প্যাকেজে!” সে তো শুনেছে, এখন রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে 'সিরিজ' চলছে, আর তার গানগুলো জিঙ্গেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে টিভি বিজ্ঞাপনে।

লাইনে দাড়িয়ে রমেশ ভাবল, এককালে এমন ছিল না। রবীন্দ্রনাথের আগে সাহিত্য কি এমনভাবে ‘ফাস্ট ফুড’ হয়ে গিয়েছিল? না, তখন বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ ছিল, একেবারে ‘ধীরে হজমের’ মত সাহিত্য একবার পড়লে পাঁচদিন ধরে চিন্তা করতেই হবে। ভাবুন তো, “আনন্দমঠ” পড়ে কেউ দ্রুত উঠে চলে যেতে পারে? না, বঙ্কিমবাবু সেই সবের অনুমতি দেবেন না। আর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত? তাঁর “মেঘনাদ বধ কাব্য” তো এক প্রকার বাঙালি ভুড়ি ভোজ - তাড়াহুড়ো করে গিলতে গেলে গলায় আটকে যাবে। এ যেন ধীরে ধীরে প্লেটের পর প্লেট বিরিয়ানি খাওয়ার মতন ব্যপার ছিল।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এলেন, দেখলেন, জয় করলেন, বিকে দিলেন। তার সাহিত্য যেন এক ‘বার্গার রেভলিউশন’ হয়ে গেল! এখন সবাই তাকে চায়। রবিবাবু হলেন বাংলাসাহিত্য জগতের “বিগ ম্যাক” অলওয়েজ অন দ্য মেনু, ফাস্ট আর ফ্রেশ!

লাইনে দাঁড়িয়ে রমেশ ভাবছিল, কী নেবে আজ? ‘গীতাঞ্জলি’ নাকি একটু হালকা কিছু যেমন ‘ছিন্নপত্র’? কিন্তু এত হালকা খাবারে কি পেট ভরবে? মেনুতে চোখ বোলাতে বোলাতে সে ভাবল, মাইকেলের যুগে তো এভাবে সাহিত্যের তালিকা পাওয়া যেত না। ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ পড়তে গেলে অন্তত তিন দিন লেগে যেত। কিন্তু সে পড়া হলেও শেষের ক’টা লাইনই খালি মনে থাকে। বাদবাকিদের মনে করাতে আবার পাতা উল্লাটতে হয় বৈকি! এখন, সবই ‘কম্বো অফার’! ‘গীতাঞ্জলি’র সঙ্গে নাও ‘গোরা’, সঙ্গে থাকবে একটু ফ্রাইড ‘কাব্যিক হাহাকার’। অথবা আজকের বিশেষ: শেষের কবিতা কম্বো - এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিসের এক্সট্রা সাইডসহ।

রমেশ অর্ডার দিল:“ ‘শেষের কবিতা’ কম্বো দাও, আর এক্সট্রা হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ দিয়ে দাও শুধু আধা প্লেট!" অর্ডার নেওয়া ছেলেটি হেসে বলল, “অবশ্যই, স্যার! এই যুগে তো আধাপ্লেট সঙ্গীত দিয়েই সবাই চলছে। পুরোটা ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। তাই খর্চ্চা কম করে সবাই।”

রমেশ বসে অপেক্ষা করছে, আর তখন তার কানে বাজল পাশের টেবিলের কিছু লোক হেড়ে গলায় গেয়ে যাচ্ছে। আরে এতো রবিবাবুর গান, জিঙ্গেল হলো কবে থেকে? আহ মরি মরি! তার মুখে হাসি ফুটল। এখন আর রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র সাহিত্যে সীমাবদ্ধ নয়, তার গানও বাণিজ্যের জিঙ্গেল। ঠিক যেন ম্যাকডোনাল্ডসের স্লোগান - "আই’ম লাভিং ইট" সব সময় সবার মুখে মুখে!

রমেশের হাতে আসা ছোট্ট ‘শেষের কবিতা’ বইটা হাতে নিয়ে সে ভাবল, "এই হল আজকের বাঙালি সাহিত্যের ফাস্ট ফুড সংস্কৃতি। এককালে বঙ্কিমের ‘দেবী চৌধুরাণী’ কিংবা ‘আনন্দমঠ’ পড়তে গেলে ভাবতে হত, বহুদিন মাথার মধ্যে সেই গল্পগুলো ঘুরত। আর এখন? রবীন্দ্রনাথ হলেন সেই ম্যাকডোনাল্ডসের ড্রাইভ-থ্রু: পাঁচ মিনিটে সম্পূর্ণ গল্প, সঙ্গে সাইড ডিসে একটা গান!"

ব্র্যান্ডিংও তো দেখি ম্যাকডোনাল্ডসের মতোই হয়েছে! রবীন্দ্রনাথের মুখ এখন মগে, পোস্টারে, এমনকি সোফায় রাখা কোল বালিশের কভারেও! যা দিয়ে স্ফীতাকৃতির স্তন নিয়ে বিব্রত বঙ্গ ললনা স্তন যুগল ঢাকার চেষ্টা করছে। বেশ কার্যকারী বটে। মনে হবে রবিদা’কে বুকে লালন করছে। সব জায়গায় তার মুখ, ঠিক যেন হ্যাপি মিলে পাওয়া খেলনাগুলোর মতো। আর, তার কবিতা আর গানের প্যাকেজিংও তো ম্যাকডোনাল্ডসের ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফ্রেশ’ থিমে চলছে। ছোট ছোট পয়সার বিনিময়ে রবীন্দ্রনাথ যে ছিল একসময় জ্ঞানের অঢেল সমুদ্র, নবেল পাওয়া পর সে এখন মাত্র ৪৯৯ টাকায় পেয়ে যাচ্ছি। লা জওয়াব!

রমেশ চায়ে চুমুক দিল। তখন তার মনে পড়ল “আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের আগে সাহিত্য তো ছিল একেবারে 'মাইকেল-মিল'! তাড়াহুড়ো করে কিছু খাওয়া যেত না। মধুসূদনের ‘কপতাক্ষনদ’ পড়া শুরু করলে তো দিনে দুইবার পড়তে হত প্রথমবার শুধু হজমের জন্য, আর দ্বিতীয়বার পেটের স্বাদ মেটানোর জন্য। আর এখন? রবীন্দ্রনাথের যেকোনো কবিতা মাত্র দুই মিনিটে পড়ে ফেলতে পারছি!” সত্যি মাইরি। জয় রবিদা’র জয়।

পাশের টেবিলে কেউ ফিসফিস করে বলছিল, “ট্যাগরের রিমিক্স শুনেছ? নতুন ভার্সনগুলো ভিষন ভালো!” সে হাসল। "এখন সবাই সংস্কৃতির সঙ্গে ‘ফাস্ট ফুড’ চাইছে। আগে তো ‘গীতাঞ্জলি’ পড়া মানেই ছিল একটা উপলব্ধির রাত, এখন সেটা ম্যাকডোনাল্ডসের কোকের সঙ্গে পরিবেশন হচ্ছে!"

রমেশ উঠে দাঁড়াল, রবীন্দ্র এক্সপ্রেসের সেই ঝলমলে সোনালি চিহ্ন তার পেছনে। হাসতে হাসতে সে ভাবল, "এখন সবাই রবীন্দ্রনাথকে পাচ্ছে, একবারে, তাড়াতাড়ি, ঠিক ম্যাকডোনাল্ডসের ফাস্ট ফুডের মতো। হোক না, একটু হালকা সংস্কৃতি। সময়ের সঙ্গে তো বদলাতেই হবে!"

সে ভাবল, পরেরবার ‘গীতাঞ্জলি’ নেব, সঙ্গে এক্সট্রা ফ্রাই। সংস্কৃতি তো এখন সস্তা, কিন্তু সুস্বাদু। আই এম লাভিং ইট।

রম্য রচনা।

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৩
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১:০১

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

ছবি: অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের একটি 'সংশোধিত' অংশকে রাজনৈতিকভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তবু তো ফাল্গুন রাতে এ গানের বেদনাতে আঁখি তব ছলছলো....আমার দুঃখভোলা গানগুলিরে ......

লিখেছেন ইন্দ্রনীলা, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫



মাঝে মাঝে আমার বুকের গহীনে এক ব্যথার নদী উথলে ওঠে। উথাল পাথাল ঢেউগুলো পাড়ে এসে আছড়ে পড়ে। উত্তাল বেগে ধেয়ে এসে ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ে বুকের মাঝে... ...বাকিটুকু পড়ুন

"বিস্মৃতি"

লিখেছেন দি এমপেরর, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৫


সে যে আজ কোথা হারিয়ে গিয়েছে, আঁধার ছেয়েছে ঘনঘোর কালো;
চাঁদ নেই তারকারাজিও উধাও, নেই জ্বলে কোথা টিমটিমে আলো!
সে যে জানে শত হৃদয়ের কথা, মায়াজালে ঘেরা হাজার স্মৃতি!
কত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথা হালকা পোষ্ট!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:০৭

অবিশ্বাস্য হলেও লেকটির অবস্থান খোদ ঢাকায়; কেউ কি এর লোকেশন বলতে পারেন?



কাটা তরমুজের ছবিটা দেবার বিশেষ মাজেজা আছে;
উটিউবে একজন কামেল বুজুর্গান পাকা সূমিষ্ট তরমুজ কেনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলার্ট : শেখ হাসিনা আজ রাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪৭


বাংলাদেশের মানুষ কল্পনা করতে খুব ভালোবাসে। গুজব ও অপতথ্য শেয়ারে বাংলাদেশের মানুষ প্রথমদিকে থাকবে বলে অনেকের বিশ্বাস । দেশের মানুষের পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বইয়ের প্রতি আগ্রহ নেই। আত্নউন্নয়ন মূলক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×