সত্যজিৎ রায়, যিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিত, তাঁর চলচ্চিত্র, গল্প এবং গোয়েন্দা সিরিজ ফেলুদা বাস্তববাদী চরিত্র, সমাজচিত্র, এবং গভীর দার্শনিকতা নিয়ে আলোচিত। তবে তাঁর কাজের মধ্যে একটি স্পষ্ট শূন্যতা লক্ষ্য করা যায়—মুসলিম চরিত্রের অনুপস্থিতি। তাঁর সমকালীন লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতারা যেখানে অন্তত কিছু মুসলিম চরিত্র অন্তর্ভুক্ত করেছেন, সেখানে রায়ের কাজ কেন এই বৈচিত্র্য থেকে বঞ্চিত?
রায় ছিলেন বাঙালি ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের অংশ, যারা বাংলার আধুনিক সংস্কৃতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তবে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এই সমাজের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রলোক সমাজ ক্রমশ এক ধর্মনির্ভর পরিবেশে পরিণত হয়। রায়ের চলচ্চিত্র মূলত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি বহন করত, যেখানে দেশভাগ-পরবর্তী কলকাতায় মুসলিম সম্প্রদায়ের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কমে গিয়েছিল।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাসে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির চরিত্র থাকলেও, রায়ের চলচ্চিত্র রূপান্তরে তা মূলত হিন্দু সমাজের গল্পে সীমাবদ্ধ ছিল। একইভাবে, তাঁর গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা এমন এক অভিজাত বৃত্তের প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে ধর্মের বিষয়টি সরাসরি আসে না, তবে মুসলিম চরিত্রের অনুপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। অন্যদিকে, ব্যোমকেশ বক্সী-র গল্পে মুসলিম চরিত্রের অন্তর্ভুক্তি দেখা যায়, যা ফেলুদার জগতে নেই।
অনেকে যুক্তি দিতে পারেন যে রায় তাঁর পরিচিত সমাজকেই প্রতিফলিত করেছেন, যেখানে মুসলমানদের উপস্থিতি ছিল কম। তবে এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ নয়। রায় শুধুমাত্র একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক ঐতিহাসিক চিন্তাবিদ, যিনি তাঁর সময়ের বাস্তবতাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন। তাঁর চলচ্চিত্র সংস্কৃতিগতভাবে অত্যন্ত খাঁটি হওয়া সত্ত্বেও, সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রদায়ের অনুপস্থিতি নিছক দুর্ঘটনা বলে মানা কঠিন।
দুটি চলচ্চিত্রে মুসলিম চরিত্রের উপস্থিতি দেখা যায়—ঘরে বাইরে (যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে) এবং চিড়িয়াখানা (যা ব্যোমকেশ বক্সী সিরিজের উপর ভিত্তি করে নির্মিত)। তবে এই চরিত্রগুলো মূলত অন্য লেখকের সৃষ্টি, যা রায় কেবল চলচ্চিত্রায়িত করেছেন। এছাড়া, তিনি বাংলাদেশি মুসলিম অভিনেত্রী ববিতাকে অশনি সংকেত-এ কাস্ট করেছিলেন, তবে সেই চরিত্রটি সরাসরি মুসলিম পরিচয় বহন করত না। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়: রায় কি ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলিম চরিত্রকে উপেক্ষা করেছেন, নাকি তিনি এটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেননি?
রায়ের পারিবারিক ইতিহাস এখানে একটি সূত্র প্রদান করতে পারে। তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা, তবে তাঁর পিতা সুকুমার রায় কলকাতায় ফিরে আসেন। দেশভাগের পর, যারা পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন, তাঁদের অনেকের মধ্যেই এক ধরনের নস্টালজিয়া, বিচ্ছিন্নতা এবং অনেক সময় অসচেতনভাবে তাঁদের হারানো মুসলিম প্রতিবেশীদের বাদ দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। এই মানসিকতা কি রায়ের চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত হয়েছিল?
এছাড়া, দেশভাগ-পরবর্তী কলকাতায় মুসলমানরা মূলত শ্রমজীবী বা নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রতিচ্ছবি বহন করছিলেন, যেখানে রায়ের চলচ্চিত্রের জগৎ ছিল অভিজাত বাঙালি ভদ্রলোকদের নিয়ে। এই বাস্তবতা কি তাঁর চিত্রনাট্য গঠনে প্রভাব ফেলেছিল?
রায়ের কাজের এই অনুপস্থিতি আরও বেশি প্রকট হয়ে ওঠে যখন আমরা বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য লেখকদের সাথে তুলনা করি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের রচনায় মুসলিম চরিত্রের উপস্থিতি রাখলেও, রায়ের কাহিনিগুলোতে এই বৈচিত্র্যের অভাব লক্ষ্য করা যায়। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা মুসলিম চরিত্রের প্রতি সহানুভূতির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। তবুও, রায়ের চলচ্চিত্র, এমনকি ঐতিহাসিক ও গ্রামীণ প্রেক্ষাপটেও, প্রধানত হিন্দু সমাজের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল।
বিশ্বব্যাপী পরিচয় ও প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন আজ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০০০ সালের ভারত এবং ২০২৫ সালের পরবর্তী ভারত সামাজিকভাবে ভিন্ন বলে মনে হয়, এবং এই পরিবর্তনই হয়তো আমাদের এই প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করছে।
রায় যদি ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলিম চরিত্রের অনুপস্থিতি ঘটিয়ে থাকেন, তাহলে কেন? এটি কি বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে উদ্ভূত, যেহেতু তাঁর দর্শক গোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলকভাবে কম ছিল? নাকি তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক জটিলতা এড়িয়ে গেছেন? নাকি এটি তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যা দেশভাগ-পরবর্তী কলকাতার বাস্তবতার দ্বারা গঠিত হয়েছিল?
রায়ের চলচ্চিত্রসমূহ সামাজিক সমালোচনার ক্ষেত্রে শক্তিশালী ছিল, তবে সেগুলো মূলত অভিজাত বাঙালি ভদ্রলোকদের সমস্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল—ঔপনিবেশিক প্রভাব, শ্রেণিগত সংঘাত, বুদ্ধিজীবীদের সংকট ইত্যাদি। ঋত্বিক ঘটকের মতো নির্মাতারা যেখানে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা সরাসরি তুলে ধরেছিলেন, রায়ের চলচ্চিত্র মানবতাবাদী হলেও এই বিষয়গুলোর প্রতি নিরপেক্ষ থেকেছে।
সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভা অদ্বিতীয়, তবে তাঁর কাজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করাও গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম চরিত্রের অনুপস্থিতি শুধু একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ নয়; এটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বিস্মৃতির একটি প্রতিফলন। এটি কি শুধুমাত্র একটি পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার প্রতিফলন, নাকি এটি তাঁর নিজস্ব রচনাশৈলীর সচেতন সিদ্ধান্ত ছিল? উত্তর স্পষ্ট নয়, তবে প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক।
রায়ের কাজকে পুনর্মূল্যায়ন করা মানে তাঁর অবদানকে ছোট করা নয়; বরং এটি আরও গভীরভাবে তাঁর সৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝার একটি প্রচেষ্টা। তাঁর চলচ্চিত্র প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছে, তবে এই সীমাবদ্ধতাগুলোর দিকে তাকালে আমাদের নিজেদের সময় এবং সমাজকেও নতুন করে বোঝার সুযোগ তৈরি হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৮:০৫