somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কেন এই সংখ্যা নিয়ে ঘাপলা?

০৯ ই মে, ২০২৫ সকাল ৮:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশ তথা সমগ্র উপমহাদেশে সংখ্যাজনিত সমস্যার সাথে আমাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনোভাবে পরিচয় আছে। এটি শুধু একটি পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তি নয়, বরং এক ধরনের সমাজ-সংস্কৃতিগত প্রবণতা, যার শিকড় আমাদের শিক্ষা, প্রশাসন, পরিবার ও ইতিহাসে বিস্তৃত

আমাদের অনেকেরই দুটি জন্মদিন আছে—একটি সত্যিকার জন্মদিন, অন্যটি সনদের জন্মদিন। স্কুলে ভর্তি করানোর সময় অনেক সময় ইচ্ছেমতো বয়স নির্ধারণ করা হতো। কারণও ছিল বাস্তবসম্মত—বয়স কম দেখালে সরকারি চাকরির জন্য বয়সসীমা অনুযায়ী সুবিধা পাওয়া যায়। এ যেন এক সাংগঠনিক চুক্তি—পরিবার, শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠান মিলে একটি সুবিধাজনক সংখ্যা দাঁড় করিয়ে দেয়। কেউ হয়তো সাত-আট বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হলেও এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে সার্টিফিকেট অনুযায়ী সাড়ে ১৪ বছর বয়সে, যদিও প্রকৃত বয়স আরও বেশি। এটি নিছক ব্যক্তিগত নয়; এ এক সামাজিক চর্চা।

এই সংখ্যাজাল শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়। রাষ্ট্রীয় স্তরে সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা এক ধরনের ক্ষমতার অনুশীলন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন, জ্বালানী উৎপাদনের পরিসংখ্যান বা বিদ্যুৎ ঘাটতির হিসাব—বিভিন্ন সময়ে আমরা লক্ষ্য করেছি সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এমন সংখ্যা প্রকাশ করে যা সুবিধাজনক narrative গড়ে তোলে। ২০১৩ সালের “লোডশেডিংমুক্ত বাংলাদেশ” ঘোষণার পরেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন ছিল। বাস্তবতা আড়াল করে সংখ্যা উপস্থাপন করাটাই যেন norm হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো, কোনো কোনো সময় ইতিহাসে ব্যক্তি বিশেষের অনুভূতিকে পরিসংখ্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

সারা পৃথিবীতে Forbes বা Bloomberg Billionaires Index-এর মতো তালিকা তৈরি হয় যেখানে সম্পদের পরিমাণ অনুযায়ী ধনীদের র‌্যাংকিং প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কারা ধনী, তাঁদের সম্পদের পরিমাণ কত—তা নিয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই। কারণ হয়তো কর ফাঁকি, অপ্রদর্শিত আয় বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কেউ এই তথ্য প্রকাশ করতে চায় না। অথচ এই অদৃশ্য ধনীরা ব্যাংক, শিল্প, জমি এবং মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।

ভারত, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও সংখ্যা নিয়ে এই ধোঁয়াশা ব্যাপক। সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বা নির্বাচনকালীন সহিংসতায় মৃত্যুর সংখ্যা, গুম-খুন, কিংবা দাঙ্গার প্রকৃত চিত্র কখনো প্রকাশ পায় না। সরকার বলবে এক সংখ্যা, বিরোধী দল বলবে আরেক, এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বলবে তৃতীয় কিছু। যেমন, ২০১৯ সালে ভারতের দিল্লি দাঙ্গার সময় নিহতের সংখ্যা নিয়ে সরকারি হিসাব ও মানবাধিকার সংস্থার হিসাবের মধ্যে বিরাট ফারাক ছিল।

এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো রাজনৈতিক সুবিধা, আমলাতান্ত্রিক অলসতা কিংবা গণতন্ত্রের দুর্বল সংস্কৃতির মধ্যে নিহিত। যখন তথ্যপ্রকাশের কোনো দায়বদ্ধতা নেই, যখন সংখ্যাকে যাচাই-বাছাই করার কোনও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান কাজ করে না, তখন সংখ্যা হয়ে ওঠে একপ্রকার হাতিয়ার—সত্য প্রকাশের নয়, বরং সত্য আড়াল করার।

সংখ্যা কোনো নিরীহ বিষয় নয়। এটি সত্যকে বোঝার একটি পথ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি হাতিয়ার। কিন্তু যখন সংখ্যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত হয়, তখন তা সমাজকে বিভ্রান্ত করে, ইতিহাসকে বিকৃত করে, এবং একটি দেশের নীতি ও উন্নয়নকে ভুল পথে পরিচালিত করে। উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চা যতদিন না তথ্যভিত্তিক ও স্বচ্ছ হয়, ততদিন এই ‘সংখ্যার ভাপলা’ চলতেই থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০২৫ সকাল ৮:২৭
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×