somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাইকেলে চেপে আর্জেন্টিনায় ১২ দিন

২৪ শে মে, ২০২৫ দুপুর ১২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আর্জেন্টিনায় পা রাখার আগে কল্পনায় ছিল ফুটবল, আন্দিজ পর্বত কিংবা বুয়েনস এইরেসের দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকার কথা। ভাবতাম, লোকালয় বা জনপদে দেখব, সকাল-বিকেল-রাত সবাই ফুটবল খেলছে। আমি দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে দেখতে হয়তো বলব—নিউমের উন আর্জেন্টিনা। কিন্তু না, এসব কিছুই হয়নি।

বরং আমি ছিলাম পাতাগোনিয়ার নির্জন উপত্যকায়, আন্দিজের গা বেয়ে নীরবতায় ঘেরা কাঁটা কম্পাস ধরে আঁকা সরলরেখার মতো সোজা এক রাস্তায়। সামনে-পেছনে কিছুই নেই, শুধু পাথুরে ধুলার ভাসমান রেখা আর গা ছমছমে বাতাস। মাঝেমধ্যে গর্জে ওঠা বিশাল ট্রাক আর দু–একটা গাড়ি চোখে পড়ে। নিমেষেই আবার হারিয়ে ফেলি। তবু এগিয়ে যাওয়া, শুধু মানুষ দেখব বলে।
ন্দিজ পর্বতের কোলে বসে থাকা পাতাগোনিয়া যেন পৃথিবীর এক নিঃসঙ্গ কবিতা।

বারিলোচের পূর্ণ নাম হলো সান কার্লোস দে বারিলোচে। বুয়েনস এইরেস থেকে দুই ঘণ্টার বিমানযাত্রা। লেক, পাহাড়, সুইস ঘরানার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রসিদ্ধ বারিলোচে পাতাগোনিয়ার অন্যতম প্রবেশদ্বার। আদর করে যাকে ডাকা হয় সুইজারল্যান্ড অব আর্জেন্টিনা।

বারিলোচে থেকে পূর্বের শহরের নাম ভিয়েদমা। এ শহরেই আমাদের জামাল ভুঁইয়া খেলতে এসেছিলেন সোল দে মায়ো নামের এক ক্লাবে। এ শহরে আসতে সাইকেল চালাতে চালাতে যে ভূদৃশ্য পার হই, তা যেন এক বিশাল পাথুরে ক্যানভাস, ধুলামাখা হাতে বেলা রুটির মতো এবড়োখেবড়ো; যেখানে ঠান্ডা হাওয়া আর বিস্তৃত ফাঁকা আকাশের রং লেগেছে।

এখানকার সকালগুলো এতটাই শান্ত, মনে হয় যেন সময় থমকে আছে। দিনের আলো আসতে দেরি করে—আমার অভ্যস্ত ভোর পাঁচটায় নয়; বরং তখনো চাদের আলোয় ডুবে থাকে চারপাশ, অদূরের পাহাড় আর কুয়াশায় লুকিয়ে থাকে ঘুমন্ত জনপদ।

যত দূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ শূন্যতা। কোথাও কোথাও দু-একটা গবাদিপশু, কখনো এক-আধটা ট্রাক; আর মাঝেমধ্যে অনেক দূরে দূরে খর্বাকৃত গাছের থোক। এই হলো সব। এখানে জনসংখ্যা এতই কম যে দিনের পর দিন সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে মনে হতো, আমি যেন এই পৃথিবীর একমাত্র অভিযাত্রী।

সকালের রুটিন অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল কুকুরের ডাক। জোরালো, গভীর, যেন সবাইকে আমার আগমন জানিয়ে দিচ্ছে তারা। আগন্তুকের আবির্ভাব তারা হয়তো ভালো মনে করত না। আলো ফোটার আগে রাস্তায় নেমে যেতাম। গ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই কুকুরের তীব্র ঘেউ ঘেউ, আর সেই আওয়াজ পাহাড় ঘুরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসত আমার কাছে। আমি ভীরু মনে দম বন্ধ করে পা চালাতাম যত না ঠান্ডার কাতরতায়, তার থেকে কুকুরের ভয়ে।

এই যাত্রায় বেশ কিছু খুদে শহর, এরা যাকে বলে গ্রাম, দেখা ও থাকা হয়েছে। তারই একটির নাম কুমালকাম। সেখানে এখনো পুরোনো স্টিম ট্রেন চলে পর্যটনের অংশ হিসেবে। তার কালো ধোঁয়া আর সিটি কল্পনাকে বাস্তবের এক সিনেমার দৃশ্যের মতো মনে হতো। লোহার একটা ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ট্রেনের কাঠামো দেখে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে, যেন ইতিহাস উঠে এসেছে অতীত থেকে।

পাতাগোনিয়ার রূপ বদলে যায় ধীরে। একসময়ের ধূসর, ধুলামাখা, শুকনা মরুভূমির মতো; আবার একসময় ঘাসে ঢাকা সবুজ তৃণভূমির মতো। এর মধ্যে দূরে ‘লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি’র মতো। কিন্তু আকাশ সর্বদা সুবিশাল বিস্তৃত, মেঘে ঢাকা; অথবা একেবারে নির্মল নীল। আর হাওয়া? কখনো সামনে থেকে, কখনো পাশ থেকে আর কখনো পেছন থেকে। একবার আঁকড়ে রাখে তো আবার ছেড়ে দেয়। এই টানাটানি পাতাগোনিয়ার চরিত্র।

ক্লেমেন্তে অর্নেলি নামের এক জায়গায় থাকতে হয়েছে। এখানে ছিল না কোনো থাকার জায়গা। পরের গন্তব্য আরও ৮০ কিলোমিটার। তাই এখানেই থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষ যেহেতু আছে, হয়ে যাবে। একটা স্কুল আছে। আমার স্থানীয় সহযাত্রী আমাদের পরিচয় দেওয়ার পর বেশ খাতির পাওয়া গেল। ক্লাসরুমে ক্যামেরা, মুঠোফোন চার্জের ব্যবস্থা হলো। জনা ১৫ শিশুর কাছে বাংলাদেশের গল্পও বলতে হলো।

সাইকেলের পেছনে বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে রেখেছিলাম। ভাবতাম, কেউ থামিয়ে জিজ্ঞেস করবে এই পতাকা কোথাকার? কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। কিছু বাইকার, কিছু ট্রাকচালক চোখ মেলেছেন ঠিকই, কেউ কেউ হাত নাড়িয়েছেন। একমাত্র যে গাড়িটি দাঁড়িয়ে কথা বলল, তিনি ছিলেন কানাডিয়ান পর্যটক।

বাংলাদেশে যদি কোনো বিদেশি দেখা যায়, হোক সে সাইকেলে, হোক হেঁটে—অবধারিতভাবে কেউ জিজ্ঞেস করবেন, ‘আপনি কোথা থেকে?’ আর হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দেবেন। আর্জেন্টিনায় মানুষ ঠিক ততটাই অতিথিপরায়ণ; কিন্তু সেটা অনেকটাই সংযত, কম প্রকাশ্য। খোলা মুখে কথা কম; কিন্তু দরকারে পাশে দাঁড়ান মানুষ।

যেমন সান আন্তেনিও ওয়েস্তে থেকে ভিয়েদমা যাওয়ার সময় আমার সাইকেল বাসে উঠতে না দেওয়ায় তিনজন স্থানীয় এগিয়ে এলেন। তাঁরা বাইকসহ আমাকে নিজে গাড়িতে তুলে ভিয়েদমা পৌঁছে দিলেন। শুধু তা–ই নয়, তাঁরা বাংলাদেশের নাম জানতেন, আর বিদায়ের সময় উপহার দিলেন আর্জেন্টিনার পতাকা। সেই মুহূর্তে মনে হলো, পতাকা বদল হয় কিন্তু মানবিকতা হয়তো একই থাকে। মানুষ বলে কথা। যার জন্য আসা এত দূর!


সাইকেলের পেছনে বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে রেখেছিলাম। ভাবতাম, কেউ থামিয়ে জিজ্ঞেস করবে এই পতাকা কোথাকার? কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। কিছু বাইকার, কিছু ট্রাকচালক চোখ মেলেছেন ঠিকই, কেউ কেউ হাত নাড়িয়েছেন। একমাত্র যে গাড়িটি দাঁড়িয়ে কথা বলল, তিনি ছিলেন কানাডিয়ান পর্যটক।

বাংলাদেশে যদি কোনো বিদেশি দেখা যায়, হোক সে সাইকেলে, হোক হেঁটে—অবধারিতভাবে কেউ জিজ্ঞেস করবেন, ‘আপনি কোথা থেকে?’ আর হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দেবেন। আর্জেন্টিনায় মানুষ ঠিক ততটাই অতিথিপরায়ণ; কিন্তু সেটা অনেকটাই সংযত, কম প্রকাশ্য। খোলা মুখে কথা কম; কিন্তু দরকারে পাশে দাঁড়ান মানুষ।

যেমন সান আন্তেনিও ওয়েস্তে থেকে ভিয়েদমা যাওয়ার সময় আমার সাইকেল বাসে উঠতে না দেওয়ায় তিনজন স্থানীয় এগিয়ে এলেন। তাঁরা বাইকসহ আমাকে নিজে গাড়িতে তুলে ভিয়েদমা পৌঁছে দিলেন। শুধু তা–ই নয়, তাঁরা বাংলাদেশের নাম জানতেন, আর বিদায়ের সময় উপহার দিলেন আর্জেন্টিনার পতাকা। সেই মুহূর্তে মনে হলো, পতাকা বদল হয় কিন্তু মানবিকতা হয়তো একই থাকে। মানুষ বলে কথা। যার জন্য আসা এত দূর!


প্রথমআলো তে মুদ্রন সংখ্যায় প্রকাশিত : ২৪০৫২৫ view this link
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২৫ দুপুর ১২:০৫
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×