somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'মডেল' শব্দের অপব্যবহার: আমরা কি অর্জনের চেয়ে উপস্থিতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি?

০৩ রা জুলাই, ২০২৫ সকাল ৯:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশে "মডেল" শব্দটির ব্যবহার যেন এক অদ্ভুত সামাজিক প্রবণতার চিত্র তুলে ধরে। বিশ্বব্যাপী, বিশেষত ইংরেজিভাষী সমাজে "মডেল" শব্দটি বহুমাত্রিক অর্থ বহন করে। এটি একদিকে যেমন ফ্যাশন বা বিজ্ঞাপনে উপস্থিত ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, তেমনি এটি এমন কাউকে বোঝাতেও ব্যবহৃত হয় যিনি নিজের জীবনে এমন কিছু অর্জন করেছেন, যা অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। অথচ বাংলাদেশে এই শব্দটি প্রায়ই একপাক্ষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়—কেবলমাত্র মিডিয়া বা ফ্যাশন জগতে ক্ষণিকের জন্য উপস্থিত কোনো নারী বা পুরুষকে বোঝাতে। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ একটি নাটকে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন বা মাত্র একবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন, তাকেও অনায়াসে “মডেল” বলে ডাকা হচ্ছে।

‘মডেল’ শব্দটির ইতিহাসও আমাদের এই আলোচনার গভীরতা বৃদ্ধি করে। এই শব্দটির উৎস লাতিন ‘মডুলাস’ থেকে, যার অর্থ ছিল ‘ছোট পরিমাপ’ বা ‘আদর্শ রূপ’। রেনেসাঁ যুগে শিল্পীরা তাদের ভাস্কর্য বা স্থাপত্যের চূড়ান্ত সংস্করণের আগে একটি ক্ষুদ্র রূপ তৈরি করতেন—এটাই ছিল ‘মডেল’। ধীরে ধীরে শব্দটির অর্থ প্রসারিত হয় বিজ্ঞানের পরীক্ষামূলক ছাঁচ, সমাজে অনুকরণীয় ব্যক্তি, কিংবা কোনও নির্দিষ্ট পণ্যের সংস্করণ বোঝাতে। বিশ শতকের শুরুর দিকে ফ্যাশন ও মিডিয়ার সঙ্গে ‘মডেল’ শব্দটি জুড়ে যায়, যখন মানুষদের পণ্য প্রদর্শনের জন্য ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বাংলাভাষী সমাজে, বিশেষত বাংলাদেশে, এই শব্দটি আজ প্রায় একমাত্র অর্থে ব্যবহৃত হয়—কেবলমাত্র মিডিয়া বা সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া কেউ। এই সংকীর্ণ ব্যবহার ‘মডেল’ শব্দটির বহুমাত্রিকতা এবং অন্তর্নিহিত মূল্যবোধকে আড়াল করে দেয়, যা একসময় পরিমিতি, নিখুঁততা এবং আদর্শের প্রতীক ছিল

এই অপব্যবহার শুধু ভাষাগত বিভ্রান্তি তৈরি করে না, এটি আমাদের সমাজের মূল্যবোধের প্রতিফলন হিসেবেও কাজ করে। আমরা কীসের প্রশংসা করছি, কাকে অনুসরণযোগ্য মনে করছি—সেই বোধটি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা এই শব্দটির ব্যবহারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একটি ছোট উদাহরণ দেই: কয়েক বছর আগে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন এক তরুণী, যিনি পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পে অংশ নিতেন। তিনি গ্রামের মেয়েদের মাঝে স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা ছড়াতে নিজ উদ্যোগে নাটক মঞ্চস্থ করতেন। অথচ তিনি কোনো টিভি বা ফ্যাশন বিজ্ঞাপনে কাজ না করায় তাকে কেউ "মডেল" বলেনি। অন্যদিকে, তার এক বান্ধবী মাত্র একবার একটি অনলাইন পোশাকের ছবিতে উপস্থিত হয়েছিলেন, এবং সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছুটা ভাইরাল হয়েছিল। এরপর থেকেই তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, "এই সেই মডেল মেয়ে।"

এই উদাহরণটি সমাজের একটি দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরে, যেখানে দৃশ্যমানতাই যেন মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন আসে—এই দৃশ্যমানতাকে আমরা কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছি? এই প্রবণতা কি আমাদের সমাজে "সফলতা" ও "আদর্শ" শব্দের সংজ্ঞাকে বদলে দিচ্ছে না?
একই রকম আরেকটি ঘটনা ঘটে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। এক তরুণ শিক্ষক যিনি আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করেছেন, স্থানীয় বিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাশিক্ষক হিসেবে সময় দেন—তাঁর নাম কেউ মনে রাখে না। কিন্তু একই ব্যাচের এক তরুণী, যিনি একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে নাচ করেছেন, হঠাৎ করেই ক্যাম্পাসে তার পরিচিতি বেড়ে যায়। এ ধরনের বৈষম্য শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়েই নয়, বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটেও অসাম্য তৈরি করে।

এমনকি আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে কোনো রিয়েলিটি শো বা সুন্দরী প্রতিযোগিতায় মাত্র একবার অংশগ্রহণ করেই কেউ কেউ সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে যান, মিডিয়ায় তাঁদের পরিচিতি তৈরি হয়। আমাদের গণমাধ্যমের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেলিভিশন, পত্রিকা বা অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রায়শই সামান্য কারণেই কাউকে “মডেল” বলে উল্লেখ করে, এমনকি কখনো-কখনো নিজেদের ক্লিকবেইট কনটেন্ট তৈরি করতেও এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে। এতে সমাজের তরুণ প্রজন্ম একটি ভুল ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে—যেখানে মনে হয়, ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোই সবচেয়ে বড় অর্জন।

আসলে, একজন প্রকৃত "মডেল" বা আদর্শ হওয়া মানে কেবল সুন্দর চেহারা নয়, বরং সাহস, সততা, অধ্যবসায়, ও আত্মত্যাগ। ডঃ মুহম্মদ ইউনুস, স্যার ফজলে হাসান আবেদ বা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মতো ব্যক্তিত্বদের আদর্শ হিসেবে তুলে ধরলে, “মডেল” শব্দটির প্রকৃত মর্যাদা বজায় থাকে। তারা ছিলেন এমন মানুষ, যাঁদের জীবন থেকে শেখার আছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম যদি তাদের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের বেশি অনুসরণ করে, তাহলে সমাজ কোন দিকে যাচ্ছে, তা ভেবে দেখা জরুরি।

বিষয়টি আরও গভীরভাবে অনুধাবনের জন্য আমরা শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকাতে পারি। স্কুল-কলেজগুলোতে সাধারণত সংস্কৃতি বিষয়ক কার্যক্রমে যারা অংশগ্রহণ করে, তাদের “মডেল” বা “আইকন” হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু যাঁরা বিজ্ঞান মেলা, গণিত অলিম্পিয়াড বা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, তাদের নিয়ে সাধারণত তেমন আলোচনা হয় না।

এখানে আন্তর্জাতিক উদাহরণ টানা যেতে পারে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে মালালা ইউসুফজাই, গ্রেটা থুনবার্গ বা এলন মাস্কের মতো ব্যক্তিত্বদের "রোল মডেল" হিসেবে দেখানো হয়। তাঁরা কেউই ফ্যাশনের সঙ্গে জড়িত নন, কিন্তু তাঁদের চিন্তাভাবনা, কর্মকাণ্ড ও সাহসিকতা মানুষকে প্রভাবিত করে। আমাদের দেশেও এ রকম ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, কিন্তু তাঁদেরকে আমরা "মডেল" বলে ভাবি না।
সর্বোপরি, শব্দের শক্তি অনেক। একটি শব্দ যেমন অনুপ্রেরণা দিতে পারে, তেমনি বিভ্রান্তিও ছড়াতে পারে। “মডেল” শব্দটি যদি আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার না করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আদর্শের সংজ্ঞা অস্পষ্ট হয়ে যাবে। তারা বুঝবে না—কাকে অনুসরণ করবে, কোন গুণটি অর্জনের জন্য সাধনা করবে। তাই এখনই সময়, শব্দটির ব্যবহার নিয়ে আমরা চিন্তা করি এবং সমাজে প্রকৃত আদর্শ স্থাপন করার প্রচেষ্টা চালাই।

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০২৫ সকাল ৯:৪৬
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনূস সরকার- অন্তবর্তীকালীন, আপদকালীন না কি গণশত্রু রাষ্ট্রযন্ত্র?

লিখেছেন রাবব১৯৭১, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:৫০

ইউনূস সরকার –অন্তবর্তীকালীন, আপদকালীন না কি গণশত্রু রাষ্ট্রযন্ত্র?
আজকের বাংলাদেশ এক অস্থির, আতঙ্কিত ও শোষণমুখর সময় পার করছে। রাজনৈতিকভাবে যে সরকার বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায়, তারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ‘অন্তবর্তীকালীন’ সরকার হিসেবে। আবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রিয় কন্যা আমার- ৮০

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ দুপুর ১:২৬



প্রিয় কন্যা আমার-
সেদিন খুব সাহসের একটা কাজ করে ফেলেছি। আমি এবং তোমার মা সাতার জানি না। তুমিও সাতার জানো না। বিকেলে আমরা তূরাগ নদীর পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। তোমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ১৬ বছরে রাজনৈতিক স্পেস না পাওয়া জামায়াতের এমন সমাবেশ ‘অবিশ্বাস্য’:

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৯





বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আজকের জাতীয় সমাবেশকে ‘অবিশ্বাস্য’ আখ্যায়িত করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি মনে করেন, এ সমাবেশ বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিয়মিত জোয়ার ভাটার ঢেউ আর সুনামির ঢেউ আলাদা

লিখেছেন অপলক , ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩১



সব কিছু একটা রিদমে চলে। সেই রিদম ভেঙ্গে গেলে ধ্বংস বা পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা করতে হয়। নিয়মিত জোয়ার ভাটার ঢেউয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীব বৈচিত্র একটা সমন্বয়ের... ...বাকিটুকু পড়ুন

“নুহাশ পল্লীর যাদুকর“

লিখেছেন আহেমদ ইউসুফ, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৮

এইখানে শুয়ে আছে স্বপ্নের কারিগর
আবেগের ফেরি করে, হৃদয়ে ঝড় তুলে
থেমে গেছে এক যাদুকর।
নুহাশ পল্লীতে মিশে আছে একাকার।

হিমুর চোখে জল, মিসিরের শোকানল
শুভ্রর শুদ্ধতা, রুপার কোমল মন,
আজও ঠিক অম্লান।

হাজারো ভক্তের মনে
মিশে আছ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×