somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধর্ষণ: প্রচলিত মিথ, বাস্তবতা ও কার্যকর সমাধান

১১ ই মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধর্ষণ সমাজের একটি ভয়াবহ ব্যাধি, যা শুধুমাত্র শারীরিক নিপীড়ন নয়, বরং ক্ষমতার অপব্যবহার, আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতা ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার একটি ভয়ংকর প্রতিফলন। সমাজে ধর্ষণের প্রকৃত কারণ নিয়ে সঠিক বিশ্লেষণের পরিবর্তে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা মূলত ধর্ষককে আড়াল করে এবং ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করে। এই লেখায় ধর্ষণ সম্পর্কিত প্রচলিত মিথ, তার বাস্তবতা এবং ধর্ষণ রোধে কার্যকর সমাধান বিশ্লেষণ করা হবে।

ধর্ষণের প্রচলিত মিথ ও বাস্তবতা

অনেকের ধারণা, নারীর পোশাক ধর্ষণের কারণ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তিন বছরের শিশু, বৃদ্ধ নারী এমনকি মৃত নারীর লাশও ধর্ষণের শিকার হয়। এর অর্থ হচ্ছে, ধর্ষণের সঙ্গে নারীর পোশাকের কোনো সম্পর্ক নেই, বরং এটি ধর্ষকের বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। অনেকেই মনে করেন, রাতে বের হলে নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়। অথচ অধিকাংশ ধর্ষণ ঘটে পরিচিত পরিবেশে এবং পরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO, ২০২২) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ষণের অধিকাংশ ঘটনা ভিকটিমের নিজ বাড়িতেই ঘটে, যেখানে ধর্ষক সাধারণত পরিবারের সদস্য, আত্মীয় বা পরিচিত কেউ থাকে। ফলে ধর্ষণ প্রতিরোধে "নারী রাতে বের হলে ধর্ষিত হয়"—এই ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর।

এছাড়াও অনেকে মনে করেন, মাহরাম (নিকট আত্মীয়) ছাড়া বের হলে নারীরা ধর্ষণের ঝুঁকিতে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক সময় স্বামীকে বেঁধে রেখেও তার স্ত্রীর ওপর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ফলে সঙ্গীর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি ধর্ষণের কারণ নয়। আবার কেউ কেউ বলেন, নারীরা যদি পর্দা মেনে চলে, তবে ধর্ষণের শিকার হবে না। কিন্তু বাস্তব উদাহরণ বলে, মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্রী, নিকাব পরিহিতা নারী এবং ধর্মীয় নারী গুরুরাও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মানে, ধর্ষণ প্রতিরোধে পর্দা বা পোশাক কোনো নিরাপত্তা দেয় না, বরং অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা এবং বিচার নিশ্চিত করাই আসল সমাধান।

আরেকটি ভয়ংকর মিথ হলো, আত্মীয়-স্বজন বা বাবা নিরাপদ আশ্রয়স্থল। অথচ বাংলাদেশে ধর্ষণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ঘটে পরিবারের মধ্যেই। "আইন ও সালিশ কেন্দ্র" (ASK, ২০২৩) এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ধর্ষণের বড় অংশই ঘটে বাবা, চাচা, মামা, খালু বা নিকট আত্মীয়দের দ্বারা। ফলে ধর্ষণ প্রতিরোধে কেবল অচেনা লোকদের দোষারোপ করলে হবে না, বরং পারিবারিক নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্ব দিতে হবে।

অনেকের ধারণা, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব ধর্ষণের মূল কারণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মাদ্রাসা—সর্বত্রই ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ফলে কেবল ধর্মীয় শিক্ষা নয়, নৈতিক শিক্ষার অভাবই মূল সমস্যা। সর্বশেষ আরেকটি প্রচলিত মিথ হলো, ধর্ষণের শিকার নারীই দোষী। এটি সবচেয়ে ভয়ংকর ও অমানবিক ধারণা, কারণ ধর্ষণ একজন নারীর ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। ধর্ষণের জন্য সবসময় ধর্ষকই দায়ী, ভিকটিম নয়।

ধর্ষণের প্রকৃত কারণ বিশ্লেষণ

পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসেবে দেখা

ধর্ষণ শুধু শারীরিক নিপীড়ন নয়, বরং এটি ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ও দখলের প্রতিফলন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের স্বায়ত্তশাসন ও সম্মানের পরিবর্তে তাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণের বস্তু হিসেবে দেখে। এই মানসিকতার কারণেই ধর্ষণকে কখনো কখনো পুরুষত্বের শক্তি হিসেবে দেখা হয়। সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বুর্দিয়ু তার "Masculine Domination" তত্ত্বে বলেন, "ধর্ষণ শুধু একজন নারীর ওপর শারীরিক হামলা নয়, বরং এটি একটি সামাজিক কাঠামোর বহিঃপ্রকাশ, যেখানে পুরুষতন্ত্র নারীদের মর্যাদাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে।" বাংলাদেশের মতো সমাজে, যেখানে নারীর স্বাধীনতা এখনও সীমিত এবং বিয়ের আগে নারীর সতীত্বকে মূল পরিচয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেখানে ধর্ষণকে অনেক সময় পুরুষের আধিপত্য কায়েমের উপায় হিসেবে দেখা হয়।

ধর্ষণ ও বিচারহীনতা

বাংলাদেশে ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা কত? "আইন ও সালিশ কেন্দ্র" (ASK) এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ধর্ষণের অভিযোগ গৃহীত হয়েছে ১,৩২১টি, যা রেকর্ডকৃত সংখ্যার মাত্র একটি অংশ। প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি, কারণ অধিকাংশ ধর্ষণ মামলা হয় না সামাজিক লজ্জা বা প্রতিশোধের ভয়ে। আশঙ্কার বিষয় হলো, ৯০% ধর্ষণের বিচার হয় না বা দেরিতে হয়, এবং ধর্ষণের মামলা নিষ্পত্তি হতে গড়ে ৮-১০ বছর সময় লাগে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ধর্ষণের মাত্র ৫% ঘটনার বিচার হয়, যা বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

ধর্ষণ প্রতিরোধে কার্যকর সমাধান

মানসিকতার পরিবর্তন ও পারিবারিক শিক্ষা

ধর্ষণ প্রতিরোধে প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে মানসিকতার পরিবর্তন। ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের শেখাতে হবে যে নারী কোনো ভোগ্য পণ্য নয়, বরং সমান মর্যাদার অধিকারী একজন মানুষ। নারীর প্রতি সম্মানবোধ তৈরি করতে হবে পরিবার থেকেই। ধর্ষণ কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, এটি সামাজিক ব্যাধি। তাই এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

কঠোর আইন ও দ্রুত বিচার ব্যবস্থা

ধর্ষণের বিচার সর্বোচ্চ ৩ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল গঠন করতে হবে। ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ পরীক্ষার বাধ্যতামূলক কার্যক্রম চালু করতে হবে, যাতে অপরাধী সহজে ধরা পড়ে এবং প্রমাণ নষ্ট করা না যায়।

যৌন শিক্ষা ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি

বিদ্যালয় পর্যায়ে যৌন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় প্রচারণা চালাতে হবে। পাশাপাশি নারীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত, যাতে তারা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারে।

মিডিয়া ও সমাজের ভূমিকা

ধর্ষণের খবর প্রচারের সময় ভিকটিম ব্লেমিং বন্ধ করতে হবে। ধর্ষকদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে হবে, যাতে সমাজ তাদের চিনতে পারে এবং সামাজিকভাবে তাদের প্রত্যাখ্যান করে। মিডিয়াকে ধর্ষণ নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো ভাঙতে হবে এবং প্রকৃত কারণগুলো তুলে ধরতে হবে।

ধর্ষণ প্রতিরোধে কেবল নারীর পোশাক বা চলাফেরার ওপর দোষ চাপিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। বরং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন, কঠোর বিচারব্যবস্থা, যৌন শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ধর্ষণের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই সমাজে এই অপরাধ কমে আসবে। আমাদের বুঝতে হবে—ধর্ষণের জন্য দায়ী কেবল ধর্ষক, নারী নয়। এই সচেতনতা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে, তবেই সমাজ থেকে ধর্ষণ নির্মূল করা সম্ভব।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:২০
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=১। কে বা চিনে আমায় ২। চলো যে যার মত ভালো থাকি =

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১:২৭


©কাজী ফাতেমা ছবি
#ভাবনা'রা
যত্ন করে লাগানো পাতাবাহার
কিংবা বারান্দার ঝুলে পড়া ঘাস ফুল
আর মানি প্লান্ট, কাঠ বেলী ওরা আমাকে চিনে,
রোজ বসে যেখানে দেখে নেই মুখশ্রী
ড্রেসিং টেবিলের আয়না সে আমাকে চিনে।

যে গ্লাসটায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। পৃথিবীতে ফিরলেন বুচ ও সুনিতা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১:৩৫

মহাকাশ স্টেশনে ৯ মাস আটকে থেকে পৃথিবীতে ফিরলেন বুচ ও সুনিতা


আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) দীর্ঘ ৯ মাস কাটিয়ে অবশেষে পৃথিবীতে ফিরতে সক্ষম হলেন দুই বিশিষ্ট মার্কিন নভোচারী... ...বাকিটুকু পড়ুন

'ওরা' পারেও....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৯ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:১৭

'ওরা' পারেও....

২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর ফজরের ওয়াক্তে আমাকে আর Zahid Hassan কে র‍্যাব-১০ থেকে মিরপুর থানায় হস্তান্তর করে। সেই দিনই আমাদের কোর্টে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আনে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজার রক্তাক্ত রমজান: বিশ্ব দেখছে নিরবে !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৫:৪২



রমজানের পবিত্রতা উপেক্ষা করে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে, যা যুদ্ধবিরতি চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন। এই হামলায় গাজার ডি-ফ্যাক্টো প্রধানমন্ত্রী ইসাম দা'আলিসসহ চার শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নুরের চে গুয়েভারা

লিখেছেন ঠাকুরমাহমুদ, ১৯ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:২৯



(১)
কয়েক দিন যাবত রাজীব নুরের মারাত্মক ধরনের মন খারাপ, তাঁর সেলফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছে এখন আর চার্জ নিচ্ছে না, অনও হচ্ছে না! মনে হয় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। একদিকে ভালোই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×