somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মুনতাসির রাসেল
শব্দ আমার আশ্রয়, চিন্তা আমার পথ। ইতিহাস, সমাজ আর আত্মপরিচয়ের গভীরে ডুব দিই—সত্যের আলো ছুঁতে। কলমই আমার নিরব প্রতিবাদ, নীরব অভিব্যক্তি।

আউলিয়ার ইতিহাস, দেউলিয়া জাতি: রাজনৈতিক কারচুপি ও ভাসানীর প্রেত

২৩ শে জুন, ২০২৫ দুপুর ১:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এ জাতির সমস্যা হলো, সে নেতা বানায়—ইতিহাস নয়। তাই নেতা বেঁচে থাকেন, ইতিহাস মৃত হয়ে পড়ে।
২৩ জুন ১৯৪৯, ঢাকার রোজ গার্ডেনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর জন্ম। রাষ্ট্রগঠনের অল্পদিনের মধ্যেই পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার একচেটিয়াভাবে পশ্চিম পাকিস্তানপন্থী, বাঙালিবিরোধী ও গণতন্ত্রবিমুখ চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর বিরুদ্ধেই গড়ে ওঠে এই সংগঠন। যার প্রথম সভাপতি—মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
অথচ আশ্চর্যজনকভাবে আজ, যখন ২৩ জুন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে দলটি মহাসমারোহে পালন করে, তখন সেই মূল প্রতিষ্ঠাতার নামটিই সেখানে নেই—না ব্যানারে, না বক্তৃতায়, না দলীয় বয়ানে।
প্রশ্ন জাগে—এই প্রেতবৎ মুছে ফেলা কি নিছক ভুল? নাকি এটি একটি সুপরিকল্পিত ইতিহাস নির্মাণের অংশ, যেখানে একজনকে আউলিয়া বানাতে হলে অন্যদের দেউলিয়া করে তুলতে হয়?
ভাসানী ছিলেন একজন কৃষকনেতা, ইসলামপ্রিয় গণবিপ্লবী এবং বিরোধিতা ও আপসহীনতার প্রতীক। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সংগঠিত বিরোধী শক্তি। তিনি ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি ১৯৫৭ সালেই ‘আসসালামু আলাইকুম পাকিস্তান’ বলে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও বিচ্ছিন্নতার অঙ্কুর ছড়িয়ে দেন বাংলার মাটিতে। অথচ তাঁকেই বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন ও ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দলটি নিজেদের জন্মকাহিনি থেকে মুছে দিয়েছে। ভাসানী কখনোই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশ হতে চাননি—তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী, চিরবিপ্লবী, এবং অনেকটা রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্রষ্টা।
পাকিস্তানের স্বৈরতন্ত্রকে উত্থানের পর একসময়ের প্রগতিশীল আওয়ামী লীগও ক্ষমতার রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে নিজস্ব ‘আউলিয়া’ নির্মাণে।শেখ মুজিব রহমান নিঃসন্দেহে বাঙালির ইতিহাসে এক অবিসংবাদিত পুরুষ। তবে তার নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে যে 'একক-পুরুষ কেন্দ্রিক জাতির ইতিহাস' তৈরি করা হয়, তাতে অন্য সবাই 'ভিন্ন মতাবলম্বী', 'বিপথগামী', বা সর্বোচ্চ ‘সহচর’ হয়ে ওঠে।
এখানে ভাসানীর মতো সহ-প্রতিষ্ঠাতা, রাজনৈতিক পূর্বসূরি এবং আদর্শিক আলাদা পথের পথিকেরা ইতিহাস থেকে মুছে পড়েন—তাঁদের স্থান হয় না পাঠ্যবইয়ে, না দলের সভায়, না রাষ্ট্রীয় ভাষণে।
একে বলা যায় "ইতিহাসের কর্পোরেট কনসোলিডেশন"—যেখানে পণ্য (নেতা) বিক্রয়যোগ্য রাখতে হলে প্রতিযোগী ব্র্যান্ড (অন্য নেতা) মুছে ফেলতে হয়।
১৯৭৫–এর পর থেকে ৯৬ ও ২০০৯–পরবর্তী আওয়ামী লীগ শাসনামলে দলটি নতুনভাবে নিজেদের ইতিহাস লিখেছে। শেখ মুজিবের ভূমিকাকে রাষ্ট্রনির্মাতার একমাত্র স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে—যা আংশ সত্য হলেও, এটি যে একাধিক ধারার সম্মিলিত সংগ্রামের ফল, তা রাজনৈতিক প্রয়োজনে আড়াল করা হয়।
ভাসানী সেই আড়ালে পড়া সত্যগুলোর এক অস্বস্তিকর প্রতিনিধি—যিনি ভারতনির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, রক্ষীবাহিনীর সমালোচনা করেন, এবং ক্ষমতা একচেটিয়াকরণকে চ্যালেঞ্জ করেন। তাই আওয়ামী ক্ষমতাকেন্দ্রের পক্ষে তাঁর স্বীকৃতি বিপজ্জনক—তিনি স্মৃতির অতলে ঠেলে দেওয়া ‘বিপজ্জনক ইতিহাস’।
একটি জাতির ইতিহাস যদি শুধুই একজনের পূজায় পর্যবসিত হয়, তাহলে তা গণতন্ত্র নয়—আবেগতাড়িত রাজনৈতিক অচেতনতা।
শেখ মুজিবকে সম্মান জানাতে হলে তাঁকে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে দাঁড় করিয়ে দেখাতে হবে, তুলনায় নয়—প্রেক্ষাপটে। আর সেই প্রেক্ষাপটে ভাসানী ছিলেন অবিচ্ছেদ্য, শিকড়সন্ধানী, এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা।
একজন আউলিয়ার ভক্তি যত প্রয়োজন, তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন ইতিহাসের বিবেক থাকা। ভাসানীকে ভুলিয়ে রেখে, ইতিহাসের ঝুলিতে শুধু একটি মুখ রেখে দিলে আমরা একটি বিকলাঙ্গ জাতীয় স্মৃতি গড়ে তুলছি, যার ফলেই আজ জাতির ভিত দুর্বল, দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ এবং রাজনীতি কৃত্রিম।
যদি ইতিহাস একজন নেতা, একটি দল, একটি ছবি, একটি স্লোগানে বন্দি হয়ে পড়ে—তাহলে ইতিহাস আর ইতিহাস থাকে না, তা হয়ে পড়ে উপাসনালয়। আর যেখানে উপাসনালয় গড়ে ওঠে, সেখানে প্রশ্ন করা নিন্দনীয়, চিন্তা করা বিদ্রোহ, এবং স্মরণবোধ বিশ্বাসঘাতকতা।
তাই যখন আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনে শেখ মুজিবের গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরে, কিন্তু ভাসানীকে বাদ দেয়, তখন তারা কেবল একজন মানুষকে নয়—নিজেদের গণতান্ত্রিক মূলবোধকেও অস্বীকার করে।
আজ, যখন রাজনীতি শুধুই ক্ষমতা রক্ষার কারবার, ইতিহাস হয়ে উঠেছে বিজ্ঞাপন—তখন ভাসানীর ভূতের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে একটি প্রশ্ন: তোমরা যে ইতিহাস লিখছ, তাতে আগামী প্রজন্ম কী শিখবে—নেতার উপাসনা, নাকি আদর্শের সংগ্রাম?
যদি উত্তরটা হয় আদর্শ, তাহলে ইতিহাসের মূল পাতায় ফিরিয়ে আনতে হবে সেই মানুষটিকে— যিনি ক্ষমতা চাননি, কিন্তু ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছিলেন। যিনি রাষ্ট্র চাননি, কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত গড়েছিলেন।
যাঁর নাম মাওলানা ভাসানী।


সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০২৫ দুপুর ১:৪২
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×