শহরটা ছোট। মফস্বল যেমন হয় আর কি। দু তিনটে হলুদরঙা সরকারি বিল্ডিং ছাড়া দোতলার উপর বাড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভোরবেলা রাস্তায় মানুষজন এমনিতেই কম থাকে। আর শীতকালে তো জনমানবশুন্য। এধরণের শহরে বড় রাস্তা থাকে একটাই। সেটার দুদিকেই শহর গড়ে উঠে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে জুবুথুবু হয়ে হেঁটে আসছে যুবক। সামনে কামারপাড়া মোড়। মোড় ঘুরলেই তার বাড়ি। মফস্বলের “এলিট ক্লাস” বলে একটা ব্যাপার আছে। তার বাবা তাদের মধ্যে পড়েন বলা যায়। বাউন্ডারি দেয়া দোতলা বাড়ি। অবশ্য মেইন গেট বহু আগেই জরাজীর্ণ হয়ে কলকব্জা খসে গেছে। ধ্বসে পড়াটাই বাকি। ক্লান্ত পায়ে বারান্দার চেয়ারটায় বসল যুবক।দৃষ্টিতে অসীম শুন্যতা আর হাহাকার। গেটের ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজে সেদিক ফিরে তাকাল সে। নীল চাদরে ঢাকা ছোটখাটো একটা মেয়ে হেঁটে আসছে।
ও হ্যাঁ, নামই তো দেয়া হয় নি যুবকের। কি নাম দেয়া যায়? ধরলাম তার নাম আনন। বুয়েটে ট্রিপল ইতে পড়ে। কোন বর্ষ দেয়া যায়? ফাইনাল ইয়ার? ছোটবেলা থেকে হাইস্কুলের শিক্ষক বাবার গর্বের ধন। হবেই বা না কেন? মফস্বলের স্কুলে পড়াশোনা করে কজনই বা তার মত রেজাল্ট করে?? মায়ের কথা মনে পড়ে না আননের। আবছা স্মৃতিতে সুন্দরী একজন মহিলা তার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে; ব্যস এটুকুই। বাবার কাছে ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে মা নাকি আকাশে থাকে। বড় হবার পর একটু একটু খারাপ লাগতো, তবে খুব বেশি না। শুধু জীবনে প্রথম আর একমাত্রবার যেদিন সেকেন্ড হয়েছিল ফাইভের অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষায়; ফার্স্ট হওয়া নীতুর মা যখন মেয়েকে কোলে নিয়ে চুমো খেয়েছিল, তখন এতবড় ধিঙ্গি মেয়েকে কোলে তোলা অন্য বন্ধুদের কাছে হাসির লাগলেও কেন যেন ওর খুব কান্না পেয়েছিল। বাসায় এসে সেদিন ওয়ানে পড়ুয়া ছোট্ট ভাই চয়নকে আড়াল করে খুব করে কেঁদেছিল সে। সেটা কি মায়ের জন্য নাকি নীতুর কাছে সেকেন্ড হওয়ার কষ্টে তা বলা কঠিন। নীতু মেয়েটা ওকে ওয়ান থেকেই জ্বালাত। আঁতেল মানে কি তা জানতো না আনন। কিন্তু নীতু যখন তাকে আঁতেল আঁতেল বলে খেপানো শুরু করল তার দু তিনদিনের মাথায় পুরো ক্লাসই ওকে আঁতেল ডাকা শুরু করল। নিশ্চয়ই ভালো কিছু ছিল না এটার মানে!
ফাইভে বৃত্তিতে জেলায় ফার্স্ট হওয়ার পর বাবা পাঁচশো টাকা দিয়েছিল। সেই টাকাটা পেয়ে খুশি হবে কি, উল্টো অদ্ভুতরকম চিন্তা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। এত্ত টাকা দিয়ে কি করবে সে? আচ্ছা গাড়ি কি কেনা যায়? উপজেলার কলোনিতে শিখার বাবা টিএনও না কি যেন, মাঝে মাঝে যখন স্কুলে সবুজ রঙের জিপ নিয়ে আসতো ওকে তখন ওরও ইচ্ছা হত ওর একটা গাড়ি থাকবে যেটা টকটকে লাল রঙের হবে। রোজ ওকে স্কুলে দিয়ে আসবে। বাবা তার স্কুলে ১ মণ মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন খুশিতে। কিসের কি। কিছুদিন পর নীতু নতুন একটা নাম দিল ওর। মিষ্টি আঁতেল। সেদিন ওর ইচ্ছা করছিল মেয়েটার ঝুঁটি ধরে টান দিয়ে দৌড় দিতে। কেন দেয় নি কে জানে... ভয়ই পেয়েছিল নাকি।
কিছুদিন পর বাবার সাথে একজন ফরসা মতন মহিলাকে দেখে অবাক হয় আনন।
-তোর মা। সালাম কর বাবা।
-আম্মু না আকাশে থাকে বাবা?
-সে জন্যই তোর নতুন মাকে আনলাম বাবা।
-এটাও তোর আম্মু।
তবু কেন যেন বাবার কথাগুলো সত্যি মনে হল না আননের। সেদিন থেকে বাবাকে কেমন যেন লাগতো। নতুন মা অবশ্য খুব যত্ন করতো ওর। প্রতিদিন তিনবেলাই মুখে তুলে খাওয়াতে চাইতো। খুব অস্বস্তি লাগলেও কিছু বলত না ও। শুধু চুল আঁচড়ে দেবার সময় সে নতুন মাকে সেটা করতে দিত না। নিজে নিজে আঁচড়াত। একদিন জোর করে আঁচড়ে দিলেও সে আবার এলোমেলো করে নিজেই আঁচড়িয়েছিল।
এইটে যখন ফার্স্ট হয় জেলায় তখন অবশ্য সে অনেক বড় হয়ে গেছে। বুঝতেও শিখেছে মা আসলে আকাশে থাকেন না। শহরের শেষ মাথায় একটা বড় কবরখানা আছে। ওটার সামনে থেকে দ্বিতীয় সারিতে সবচেয়ে ডানদিকে অনেক কটা বছর হল শুয়ে আছে। ছোটভাইটাকে আনতে গিয়ে নাকি নিজেই আর আসতে পারে নি। পরের বছর চয়ন যখন ফাইভে বৃত্তি পেল না বাবা ওকে মারছে দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিল আনন। একটু ভয়ও ঢুকে গিয়েছিল মনে। তার মানে বৃত্তি না পেলে সেটা খুব খারাপ কাজ হয়ে যায়। বাবা তাহলে মারে।
-ভাইয়া, তুই এত ভালো রেজাল্ট করিস কিভাবে??
চয়নের প্রশ্নে খুব অস্বস্তি লাগতো আননের। ওর তো বিকেলবেলা মাঠে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি ফুটবল বা ক্রিকেট খেলতে ভালো লাগে না। ওর তখন শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে।
-এমনি এমনি রে ভাইয়া। দেখিস তুইও পারবি।
মাথার চুল এলোমেলো করে চয়নকে সান্ত্বনা দিত আনন।
-পারব না ছাই। আমার পড়াশোনা ভালো লাগে না। মনে হয় তোমার ওই বন্ধুটার মত হয়ে যাই, ওই যে সেভেনে পড়াশোনা বাদ দিয়ে রিক্সা চালান শুরু করেছিল যে ভাইয়াটা! উফ, কি মজা উনার, তাই না ভাইয়া? যখন খুশি রিক্সা চালায়। ভালো না লাগলে বাজারে বসে ভিসিআরে সিনেমা দেখে!!
-চুপ চুপ। বাবা শুনলে আবার মারবে।
এসএসসির রেজাল্ট বের হওয়ার দিন সে ফুপুর বাড়িতে গিয়েছিল। এসে দেখে বাসায় প্রচুর ভিড়। কে যেন একটা মিষ্টি দিয়ে দিল মুখে। এরকম হদ্দ মফস্বল থেকে বোর্ডে ফার্স্ট হওয়া কি যেমন তেমন কথা। সাংবাদিকরা ছবি টবি তুলে এলাহি কারবার। বাবা পরেরদিন সবগুলো পত্রিকা কিনে আলমিরাতে রেখে দিয়েছিল। এইচএসসিতেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তারপর বুয়েট। বাবা অবশ্য খুব করে চেয়েছিল যেন ডাক্তার হয় আনন। কিন্তু তা আর হল কই।
চয়নটা অবশ্য সেরকম হল না। কোনভাবে টেনেটুনে পাশের রেজাল্ট যখনই বাড়িতে আসতো বাবার ছাত্রদের জন্য যত্নে রাখা বেতগুলোর একটা সেদিন ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে থাকতো। নতুন মা রুমের বন্ধ দরজার বাইরে থেকে শুধু বিলাপ করতেন। চয়নটা কেন যেন নতুন মা’র খুব ন্যাওটা ছিল। আর কোন ভাইবোন না আসাতে অবশ্য আনন খুশিই হয়েছিল। কারণ কিভাবে যেন এই ফরসা মতন মহিলাকে তার ভালও লাগতো। কিন্তু কখনও সঙ্কোচের কারণে বলা হয় নি। যদি এই নতুন মাও তার মায়ের মত ভাই আনতে গিয়ে আর না আসেন...
মারের পর্ব শেষ হলে সেদিন জ্বর আসত চয়নের। সারারাত জলপট্টি কপালে দিয়ে নতুন মা জেগে বসে থাকতেন চয়নের পাশে। অবাক হয়ে একদিন আনন দেখল জলপট্টি দিতে দিতে তার নতুন মা কাঁদছে। সেদিন রাতে গিয়ে আনন তাকে চুল আঁচড়ে দিতে বলল।
হয়তো একা একা কোন বন্ধুহীন আর শত্রুহীনভাবে একা একা বড় হওয়াটাই তার নিয়তি ছিল। তা আর হল কই। বাবার কাছে ভোর ছয়টা থেকে ছেলে মেয়েরা পড়তে আসতো। ইংরেজির ভালো শিক্ষকের মফস্বলে দাম আছে বৈকি।
-ওই আঁতেল, স্যার কই রে?
-বাবা স্কুল থেকে আসে নাই এখনো। আমাকে আঁতেল ডাকবা না। আমার খারাপ লাগে শুনতে।
তার এই মন খারাপের কোন দাম ছিল কি নীতুর কাছে? মনে হয় না। থাকলে তো আর হাসিতে ভেঙ্গে পড়তো না বদ মেয়েটা।
-তো কি ডাকবো?? এই “চঞ্চল” ছেলে... স্যার কোথায় রে??
সুর দিয়ে ঢং করে বলা এই কথাগুলো যেন হুল হয়ে গায়ে বিঁধত আননের।
-তুমি থাকো। এখানে বস, আমি ভিতরে যাই।
-আরে আরে কই যাস?? বস এইখানে। বস বলছি!!
চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকতো সে। ততদিনে একটু না, বেশ ভয়ই পাওয়া শুরু করেছে সে এই দস্যি মেয়েটাকে।
-এই, পেয়ারা খাবি?? শিখাদের বাসার গাছের পেয়ারা। খেয়ে মজা পাবি। নে।
-না না তুমি খাও, আমি খাব না।
-এই তুই নাইনে পড়িস?? সত্যিই তো? এত আঁতেল কেন এই বয়সেই??
হতাশ হয়ে বসে বসে আনন ভাবতো, এই মেয়ের সমস্যা কি!!
-জানিস, রুবেল না আমাকে সেদিন বলেছে আমাকে নাকি তার ভালো লাগে।
আনন জবাব দিত না, কারণ কিছুদিন পর পরই এমন কথা সে শুনত যে অমুকের নীতুকে ভালো লাগে, তমুকের নীতুকে ভালো লাগে, সব সময় ফলাফল অবশ্য একই হত। নীতু যখন এক ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দেয়ার হুমকি দিত কেউই আর তখন দ্বিতীয়বার তাকে ঘাটাতে যেত না।
আননকে জিজ্ঞেস করলে সে হয়ত নীতুকে একবাক্যে পাগল বলে দিত কিন্তু চয়ন তার “নীতাপ্পি” বলতে অজ্ঞান ছিল। নীতাপ্পি এই, নীতাপ্পি সেই, নীতাপ্পি অনেক ভালো। আর চয়নের নীতাপ্পিও চয়নকে খুবই আদর করত। নীতাপ্পিরা ক্লাস টেনে থাকতে যখন সিলেটে বদলী হয়ে গেল চয়ন তখন সিক্সে পড়ে। নীতাপ্পিকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। আননকে যখন নীতু ভারি গলায় বলল “আসি রে আঁতেল, ভালো থাকিস। সিলেটে আসিস কিন্তু...” ; তখন কেন যেন আননের গলায় শক্ত কিছু একটা বেধে যাচ্ছিল। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত একসাথে পড়ার পর এখন থেকে আর নীতুকে দেখবে না ভাবতেই কেমন যেন লাগছিল আননের।
-তুমি এসএসসি পরীক্ষা দিবা না আমাদের স্কুল থেকে??
অনেক কষ্টে গলা দিয়ে যেন এটুকু বের করেছিল সে।
-না রে। বাবা বোর্ডে যোগাযোগ করেছে। রেজিস্ট্রেশন চেঞ্জ করে সিলেটেই পরীক্ষা দিব।
তারপর অনেকদিন নীতু নামের পাগল মেয়েটা তার জীবন থেকে নাই হয়ে গেল। কয়েকবছর পর হয়তো তাদের আবার দেখা হয়েছিল কিন্তু সেটা কয়েকবছর পরের ব্যাপার।
এইচএসসির সময় সে ঢাকায় খালার বাসায় চলে আসল। নিঃসন্তান খালা তাকে ছোটবেলা থেকেই নিয়ে আসতে চাইছিল ঢাকায়, তার আম্মু মারা যাবার পর কিন্তু তার বাবা তাকে দেয় নি। খালুর ব্যবসার ফুলে ফেঁপে ওঠার দৌলতে বেশ একটা আলিশান বাড়িতেই থাকতো ওরা। তবু মাঝে মাঝে ওর মফস্বলের সেই বাউন্ডারি ঘেরা বাসাটার জন্য, চয়নের জন্য, নতুন মার জন্য এমনকি হয়তো ওর বাবার জন্যও ওর মাঝে মাঝে খারাপ লাগতো। এই ব্যাপারটা অবশ্য কিছুটা অবাক করা ছিল; বাবা কোনদিন তার কোন চাহিদা অপূর্ণ না রাখলেও কেন যেন সে বাবার সাথে তেমন ঘনিষ্ঠ ছিল না।
কলেজ থেকে বাসা আর বাসা থেকে কলেজ, দুই একদিন ব্যাতিক্রম বাদ দিলে তার রুটিন বাঁধা জীবন ছিল এটাই। ঢাকা; অবাক করা একটা শহর। সবাই সবার মত দৌড়ে চলছে। কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় নেই। মানুষের এত ব্যাস্ততা!! যে দুই একদিন ব্যাতিক্রম হত সেদিন সে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটত। মানুষ দেখতে তার ভালো লাগতো। কতরকম মানুষ! দামি গাড়িতে করে যে রাস্তায় মানুষ চলে যাচ্ছে সে রাস্তায়ই আবার কিছু মানুষ ফেলে দেয়া খাবার খুঁজছে। গরমকালে ফুটপাথে বসে মানুষ কুকুর পাশাপাশি জিরোচ্ছে আবার ঠিক একই সময় বহুতল দালানের এসিতে পানি পড়ছে বাইরে। হকার বিভিন্ন জিনিস বিক্রির চেষ্টা করছে আর অনেক মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তার কথা শুনছে। ব্যস্ত নগরীর বিপরীতমুখীতা তাকে অবাক করত না আর ততদিনে। অবশ্য এই ব্যতিক্রমগুলো বেশি করা যেত না। কারণ খালা একটু দেরি হলেই টেনশন করা শুরু করতেন আর বাসায় আসলে জড়িয়ে ধরে প্রতিজ্ঞা করাতেন আর এরকম দেরি হবে না।
ও যখন এইচএসসিতে আবার বোর্ডস্ট্যান্ড করল, চয়ন তখন আবারও এইটে বৃত্তি পেল না। ফলাফল আবারও নতুন মার বিলাপ, বাবার বেতগুলোর একটা ভেঙ্গে যাওয়া, চয়নের জ্বর আসা আর নতুন মা’র রাত জাগা। চয়ন যখন ওকে চিঠি লিখত, “ভাইয়ারে, আমার অনেক কষ্ট হয়। আমার পড়তে ভালো লাগে না। আমি পারি না, বাবা কেন আমাকে শুধু শুধু মারে?” আনন সেদিন বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে কাঁদত। হাজার হোক, ছেলে মানুষ কাঁদছে এটা কেমন দেখায়!!
বুয়েটে ভর্তি হবার পর সে খালার বাসা ছেড়ে হলে উঠলো। হললাইফে মনে হয় প্রথম সে নিজেকে খুঁজে পেল। ক্লাস পরীক্ষার চাপ যে কি রকম তা তো বলাই বাহুল্য। এর মধ্যেও তাকে রাতে ঘুরার নেশা পেয়ে বসল। রাত তিনটা চারটা পর্যন্ত বাইরে ঘুরে ঘুরে সারাদিন ঢুলুঢুলু চোখে ক্লাস আর ল্যাব। মাঝে মাঝে ক্লাসের পেছনে ঘুমাতেও বেশ লাগত তার। পরিচিত কয়েকজন আবার নামও দিয়ে দিয়েছিল তার। “ঘুমবাবা”!! তাও ভালো, আঁতেল তো আর না! নীতুর দেয়া এই নামটা তাকে যে পরিমাণ জ্বালিয়েছে!!
হঠাত নীতু আসল কোথাথেকে?? হ্যাঁ, সিনেমার কাহিনীতে দেখা যায় সাধারণত ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে আবার দেখা হওয়া। কিন্তু বাস্তবেও যে এমন হবে সে ভাবতেই পারে নি। সেকেন্ড ইয়ারের মাঝামাঝি কোন এক বর্ষাকালে নিত্যকার মত সেদিন বিকেলে ল্যাব শেষে হাঁটতে হাঁটতে সে হলে যাচ্ছিল। বৃষ্টি আসতে পারে, তাই একটু তাড়াহুড়াই বলা যায়। হঠাত পেছন থেকে চিলের মত একটা চিতকারে চমকে উঠে ফিরে তাকাল আনন।
-আতেএএএল!!!! তুই???
নীতুর মতই দেখতে একটা মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ওর দিকে আসছে। আরে! ও তো নীতুই!! বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠলো তার।
-তুমি?? এখানে!!
-হুম, আমি তো ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ি। বাংলায়। তুই এখানে?? আমি তো ভাবছিলাম কে না কে। পরে দেখলাম তুইই। ভাগ্যিস আমি সত্যিই চিনতে পারছি, না হলে অন্য কেউ হলে যে কি হত!! তুই এখানে কেন?? কি করিস? কোথায় পড়িস??
হড়বড় করে একনাগাড়ে কথার যেন মেশিনগান চালাল মেয়েটা। একদমই বদল হয় নি। আপনমনেই হেসে দিল আনন।
-হাসিস ক্যান? কি হইছে??
-না এমনি। তুমি একদমই বদলাও নি। আমি বুয়েটে আছি। ট্রিপল ইতে। তোমার খবর কি??
-বদলাব কেন রে গাধা?? আমি কি গিরগিটি নাকি যে মিনিটে মিনিটে বদলাব??
কটমট করে জবাব দেয় নীতু। এমন ভাবে কথা বলছে যেন ওদের শেষ দেখা সাড়ে চার বছর আগে নয়, মাত্র সকালে হয়েছে।
অনেক কিছুই তো চিন্তা করা যেতে পারে। চলুন সুন্দর কিছুই চিন্তা করি!! যে বৃষ্টির আশঙ্কায় তাড়াহুড়া করছিল আনন সেই বৃষ্টি ঝমঝম করে পড়া শুরু করল। কাকভেজা হয়ে আনন নীতুকে রোকেয়া হলে পৌঁছে দিল। তারপর হয়তো আননের রাতের বেলা একা একা ঘোরা বন্ধ হয়ে দিনের বেলা দোকা দোকা হয়ে ঘোরা শুরু হল। অনুভূতিহীন ছেলেটা যেন বিচিত্র অনুভূতির সাগরে ভাসতে শুরু করল। বছর দুই এভাবেই চলে গেল। চয়নও বছরে দু একবার ঢাকা আসতো। তার “নীতাপ্পি”কে ফেরত পেয়ে যারপরনাই খুশি সে।
চয়ন কিভাবে যেন মোটামুটি একটা রেজাল্ট করে এইচ এস সি পাশ করে ফেলল। এবার ভর্তি। বরাবরই ভালো খেলা চয়ন জেলা টিমের হয়ে ফুটবল খেলত। সেবছর আন্ত জেলা ফুটবলে সে বলতে গেলে একাই সেমি ফাইনাল পর্যন্ত মিয়ে যায়। অবশ্য সেমি ফাইনাল শেষ করে বাসায় এসেই এইচএসসি এর আগে আগে খেলার জন্য বাবার আরেকটা বেত ভাঙ্গে। তাই কোচিঙের জন্য ঢাকায় এসে বাবাকে না বলে আবাহনীতে ফুটবলে ট্রায়াল দেয়। চান্সও পেয়ে যায়। তার স্বপ্ন সফল হচ্ছে!! খুশিতে চয়নের ঘুমই আসে না। ভাইয়াকে বললে ভাইয়াও খুব খুশি হয়। কিন্তু বাবা?? কেন যেন বাবা এবার আর মারে না তাকে। কিন্তু কোন কথাও বলে না তার সাথে। টাকাও পাঠায় না। অস্থির হয়ে চয়ন বাড়ি যায়। নতুন মায়ের হাজার কান্নাকে পাত্তা না দিয়ে বাবা তাকে ঘরে ঢুকতে দেন না। এবার তারও হয়তো রাগ লেগেছিল, আর না হয় অভিমান, এতদিনের পুঞ্জীভূত কষ্ট... সত্যি ঘটনা আর জানা যাবে না, কারণ তারপরদিন পেপারে ছোট্ট করে একটি নিউজ আসে; সড়ক দুর্ঘটনায় তরুণ ফুটবলারের মৃত্যু।
সেদিন কি আসলেই দুর্ঘটনা ঘটেছিল নাকি চয়ন ইচ্ছে করেই ট্রাকের সামনে পড়েছিল তা আর জানার উপায় নেই।
আননের দিনগুলো তারপর বড্ড রঙহীন হয়ে যায়। সাদাকালো দুনিয়াতে সে শুধু তার ভাইয়াটার লেখা চিঠিগুলো দেখতে পায়। চয়নের নীতাপ্পি কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসিয়ে ফেলে। আদৌ কি কোন লাভ হয়?? অবশ্য শোক তো আর লাভ ক্ষতির নিয়ম মেনে হয় না...
কোন এক শীতকালে আননের হঠাত সবকিছু অসহ্য মনে হয়। তাই সব কিছু ছেড়েছুড়ে সে চলে আসে মফস্বলে। বাবা জিজ্ঞেস করতে সাহস পান না সে কি ফাইনাল ইয়ারে উঠে পড়াশোনা ছেড়ে দিবে নাকি!! এতদিনের চেনা ছেলেটা আজ তার কাছে বড্ড অচেনা মনে হয়। চয়ন মারা যাবার পর থেকে এখনো বাবার সাথে একটা কথাও বলে নি আনন। প্রায় বছরখানেক এভাবেই চলে যায়। একই বাড়িতে তিনটি মানুষ থাকে মাত্র। অথচ দুজন কথা বলে না। নতুন মা দিনরাত কেঁদে যান। এত বছর পরও নতুন মা বলাটা কি ঠিক হবে?? আচ্ছা, ঠিক আছে। ‘মা’ শুধু কেঁদে যান। আনন ঘুমাতে পারে না। সারারাত জেগে ভোরবেলা বের হয়। আধঘণ্টা হেঁটে আবার বাসায় চলে আসে।
এক শীতে আনন চলে এসেছিল বাসায়। এখন আরেক শীত। এক বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়। আনন আবার অনুভূতিহীন হয়ে যায়, সারাদিন সে বই পড়ে আর মাঝে মাঝে একা একা হাঁটে। মফস্বল শহরতো, কোন কিছু গোপন থাকে না। কেউ কেউ তাকে পাগল বলা শুরু করে। তারপর হয়তো কোন একদিন ক্লান্ত পায়ে বারান্দার চেয়ারটায় বসল আনন।দৃষ্টিতে অসীম শুন্যতা আর হাহাকার। গেটের ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজে সেদিক ফিরে তাকাল সে। নীল চাদরে ঢাকা ছোটখাটো একটা মেয়ে হেঁটে আসছে। নীতু না?? নীতুই তো?? ও কি করছে এখানে?? নীতু এসে আননের পাশের মোড়ায় বসে।
-বেশ শীত পড়েছে এবার। কি বলিস?
-হু।
-তুই তো কাঁপছিস। কিছু গায়ে দে গাধা।
-হু।
-হু হু করবি না ছাগল, তোর হু হু শোনার জন্য ছয় সাত বছর পর এই বাসায় আসি নাই।
-কি জন্য এসেছো??
-বাহ, হু হু ছাড়াও তুই কোন কিছু বলতে পারিস তাহলে??
-প্রশ্ন এড়াবে না।
-ওরে বাবা, কি জেরারে!! তুই???? আমাকে জেরা করতেছিস???? বাহ!!!! তোর তো অনেক উন্নতি হইছে এক বছরে!! এখন উঠেন, রেডি হন, ঢাকায় যাব। আগামী মাস থেকে তোর ফাইনাল পরীক্ষা, তুই পরীক্ষা দিতেছিস। চয়ন যদি থাকতো, তোর এই অবস্থা দেখলে যে কি বলত!!
পরিশিষ্টঃ
-চয়ন, আব্বু, তুমি কি হবে বড় হয়ে??
-আমি ফুতবল খেলব বাব্বা।
-তাই??
-আমি ফুতবল খেলতে পারব না বাব্বা??
-অবশ্যই বাবা, তুমি ফুটবল খেলতে পারবে। কেন পারবে না!!! তোমাকে কালকেই একটা জার্সি আর বল কিনে দেব। আমি আর তুমি প্রতিদিন বিকেলে খেলব।
-আমার ফুতবল খেলতে অনেএএক ভালো লাগে।
-আমারও ফুটবল খেলতে ভালো লাগে বাবা।
নীতু এসে তাড়া দেয়, “হয়েছে। খাবার টেবিলে দিয়েছি, বাপ ব্যাটা খেতে আসেন।”
-আম্মু তুমি পচা, আমি বাব্বার সাথে কথা বলছি দেখছো না?
গম্ভীর হয়ে বলে তিন বছর বয়সী চয়ন।
সময় কারো জন্য থেমে থাকে না, যত প্রতিকূল পরিবেশই হোক, জীবন তো একটাই। জীবনের ট্রেন থেকে কেউ পড়ে গেলে বড়জোর অল্প কিছুদিন শোক করা হয়, তারপর ঠিকই সবাই সবার লাইফ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ট্রেনটা অবিরাম চলতেই থাকে। চয়ন হয়তো জানতো কিংবা হয়তো জানতো না; সেটা এখন নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়।