somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রোগাটে সেই ছেলেটি

০৩ রা মে, ২০১৫ রাত ১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নাক মুখ কুঁচকে বিরক্তভঙ্গিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে নিশরাত। রোদে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। অথচ গতকালই মাত্র বৃষ্টি হল। কোন রিকশাও নেই। খাঁ খাঁ করছে কার্জন হলের সামনের পুরো রাস্তা। সেই সকালে বেরিয়েছে বাসা থেকে। ডিপার্টমেন্টে এসেছিল চেয়ারম্যান স্যারের সাথে দেখা করতে। এমআইটিতে ফুলব্রাইট স্কলারশিপের আবেদন করেছে কিছুদিন আগে। ওর শিক্ষকরাও বলছেন ওর নাকি স্কলারশিপটা হয়ে যাবে। অবশ্য হবারই কথা। পরিসংখ্যান বিষয়টা অনেকের কাছে কঠিন লাগলেও কেন যেন ওর কাছে ভালই লাগে। তাই রেজাল্টও সেরকম। আজ চেয়ারম্যান স্যারও বললেন তিনি নিশরাতকে নিয়ে খুবই আশাবাদী। গত বছর ওদের এক ব্যাচ সিনিয়র ইকবাল ভাই চেয়ারম্যান স্যারের সুপারিশেই কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে এখন ম্যানচেস্টারে পড়ছেন। সবমিলিয়ে ঠিকঠাক ভাবেই এগুচ্ছে সব। কিন্তু ওর কেন যেন মন টানছে না। যদিও কাউকে বলে নি এটা। এমআইটিতে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে মন টানছে না বললে লোকে পাগলও ভাবতে পারে।
নাহ, রিকশা আর পাওয়া গেল না। হেঁটেই যেতে হবে। এরকম কড়া রোদে হেঁটে হেঁটে ভার্সিটি থেকে বাসায় গেছে এটা রুমা জানতে পারলে অবশ্য রাগ করবে। নিশরাতদের বাসাটা ইত্তেফাক অফিসের একদম কাছে। একশ গজও হবে না বোধহয়।

বাসায় যেতেই মায়ের ডাক, এতক্ষনে আসলি?? তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে খেতে বস। দুপুরতো গড়িয়ে গেল।
খাবার টেবিলে বসে ছোটভাইদের কথা জিজ্ঞেস করে নিশরাত।
- তৌফিক, উলফাত ওরা কোথায় মা? খেয়েছে ওরা?
- সেই কখন থেকে খেয়ে দেয়ে ঘুমোচ্ছে!!
ছেলের পাতে তরকারি তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেন মা, “হ্যাঁরে তানি, তোর স্কলারশিপটা হবে তো??”
ও, বলাই তো হয় নি। ছফুটের ওপর লম্বা, রোগাটে কিন্তু সুদর্শন এই ছেলেটাকে তার বাবা মা আদর করে ‘তানি’ ডাকে। ভালো নাম অবশ্য অনেক বড়। আবু মঈন মোহাম্মাদ আশফাকুস সামাদ। সেটা ছোট হতে হতে বন্ধুদের কল্যাণে ‘আশফি’ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কাছে অবশ্য ও নিশরাত নামেই পরিচিত।
স্কলারশিপের আবেদন করার পর থেকেই মায়ের উৎকণ্ঠা, ছেলে পারবে তো ফুলব্রাইট স্কলার হতে? অবশ্য তাঁর ছেলের প্রতি তাঁর আস্থা আছে। কোনদিন তাঁকে নিরাশ করে নি তানি। ছোট্ট তানি এখন কত্ত বড় হয়ে গেছে! অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছে! আর বেশিদিন তো নেই, বিয়ে করিয়ে বউমার হাতে সংসারটা তুলে দিতে চান সাদেকা। ছেলে এমআইটি থেকে পড়াশোনা শেষ করার সাথে সাথেই বিয়ে করিয়ে বউমাকে ঘরে তুলবার ইচ্ছা সাদেকার। এত আগ্রহের কারণ তিনি নিজেও ফুলব্রাইট স্কলার। এজন্যই হয়তো তিনি চান তাঁর ছেলেটাও ফুলব্রাইট স্কলার হোক। শিক্ষকতায় সারা জীবন পার করে দিলেন প্রায়। অনারারি জাজও ছিলেন অবশ্য। সারা জীবন নিষ্ঠার সাথে ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে এসেছেন। শোকেস ভর্তি পুরস্কারের একটা অংশ তাঁর নিজের। শিক্ষকতায় নিষ্ঠার জন্য অসংখ্য পুরষ্কার পেয়েছেন সাদেকা।
সে যাই হোক, আমরা আবার ফিরে আসি খাবার টেবিলে।
- মা, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে পেয়ে যাব।
চাপা আনন্দের ঝিলিকে মুখ ঝলমল করে ওঠে সাদেকা সামাদের। চার ছেলেকে নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ নেই।
- তাড়াতাড়ি হয়ে যাক, তুইও উড়াল দে। দেশের অবস্থা ভালো না। কোনদিকে যে যাচ্ছে পরিস্থিতি কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। তুই এত ঘন ঘন বাইরে যাস, আমার তো খুব চিন্তা হয় রে।
- চিন্তা করো না তো মা, এখন কি আর ছোট আছি??
- আমার কাছে কি তুই বড় হবি রে?? সবসময় আমার ‘ছোট্ট’ তানিই থাকবি।
দেখতে দেখতে ছেলেটা কত বড় হয়ে গেল চোখের সামনে। এখনো মনে হয় এইতো সেদিনমাত্র হাঁটতে শিখল, মুখে আধো আধো বোলে কথা বলত। কিভাবে কিভাবে যেন বিশ বছরের তাগড়া যুবক হয়ে গেল। এর মধ্যে আবার অনার্স ফাইনালও শেষ। ছেলেটাকে নিয়ে যতই ভাবেন ততই শুধু গর্ববোধ হয় তাঁর।
ইদানীং দুশ্চিন্তায় ঘুম হয় না সাদেকার। ছেলেটা ভালোয় ভালোয় আমেরিকা চলে গেলে বেঁচে যান তিনি। প্রতিদিন কত কত মানুষ মারা যাচ্ছে গুলিতে। তাতে শুধু পরিস্থিতি খারাপই হচ্ছে। জনতা আরও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে রাস্তায় নেমে আসছে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে মনে হয় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর একার কথায় চলছে। তিনি নিজে রাজনীতি সচেতন বটে, কিন্তু কখনই চান না কোনভাবে তাঁর ছেলেরা এই পরিস্থিতির শিকার হোক। হাজার হোক, মায়ের মন তো!!

রুমার সাথে আজ বিকেলে দেখা করার কথা ওর। স্কলারশিপ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে এ কয়দিনে দেখাই হয় নি। মেয়েটা বড় ভালো মেয়ে।
-ভাইয়া, আম্মা বলেছে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যার আগে ফিরতে।
-আচ্ছা, আম্মাকে বলিস একটু সন্ধ্যা হলে যেন চিন্তা না করে।
সেদিন নিউমার্কেটে একটা শাড়ি দেখে খুব পছন্দ হয়েছিল নিশরাতের। মনে হয়েছিল এটা বোধহয় রুমার জন্যই বানানো। রুমা পড়লে ওকে পরীর মত লাগবে। সাথে সাথেই কিনে ফেলেছিল ও। আজ সেটা রুমাকে দেয়ার ইচ্ছা ওর। সন্ধ্যার পর আসলেও নিরাপদ না বেশিক্ষন বাইরে থাকা। রিকশাওয়ালা মামার অবশ্য কোন তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। বসে বসে দেশের অবস্থা নিয়ে ভাবে নিশরাত। এভাবে আর কতদিন?? এখন মিছিলগুলো থেকে স্বাধীনতার স্লোগান আসা শুরু হয়েছে।
‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো,
বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।
‘ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মার,
বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।
সত্যি কি দেশ স্বাধীন হবে?? কেউ জানে না। দেশ এখন কোনদিকে চলেছে কেউ বলতে পারবে না। মাঝেমাঝে অস্থির লাগে ওর। কি যে হয় এবার! ইয়াহিয়া ভুট্টো দুজন মিলে যে কি শুরু করেছে!!
ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মায়ের নিষেধ স্বত্তেও রাতে খাওয়ার পর একটু হাঁটাহাঁটি করা ওর অভ্যাস। উলফাত আর তৌফিককে নিয়ে ইত্তেফাক অফিসের সামনে ছোট্ট ট্রাফিক সার্কেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে গেল ওরা। কি যেন ঠিক নেই। সবকিছু কেমন থম মেরে আছে। অবশ্য রাতও বাজে দশটার মত। ঢাকা শহর এখন দশটায় নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
আতশবাজির মত শব্দ হল কোথায় যেন। কে জানে, হয়তো কোথাও গুলিই করেছে কেউ। প্রতিদিন যেভাবে মানুষ মরছে... গুলির শব্দে মানুষ এখন আর খুব একটা ভয় পায় না। ওইতো, আতশবাজিই হবে। আকাশে উঠে যাচ্ছে। একটা গুলিস্তানের দিকে হবে মনে হয়। আরেকটা দেখে মনে হচ্ছে মতিঝিল কমলাপুরের ওদিকটায়। এইসময় আতশবাজি! হাসি পেয়ে যায় নিশরাতের। নাহ, আতশবাজি তো এমন না! চারদিক কেমন আলো হয়ে গেল, ধীরে ধীরে নিচে নামছে আতশবাজিগুলো। কেমন অস্বস্তি লাগে ওর। কি যেন ঠিক নেই। কি যেন ঠিক নেই।
চারদিকে হঠাত বেশ কিছু গুলির আওয়াজ হয়। অজানা ভয়ে মন কেঁপে ওঠে ওর। বাসার দিকে হাঁটা শুরু করে দ্রুত। দূর থেকে এখনো গুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
পৌনে বারটার দিকে ঘড় ঘড় আওয়াজে তাদের বাড়ি কেঁপে ওঠে যেন। বাসার সবাই বড় ঘরটায় এসে জড় হয়েছে। কারও মুখে কোন কথা নেই। কান ফাটানো একটা আওয়াজ হল। থর থর করে কেঁপে ওঠে ওদের বাড়ি। জানালা লাগিয়ে দিতে গেল উলফাত। অস্ফুটে মুখ দিয়ে আর্ত চিৎকার শুনে এগিয়ে যেতে বাইরে চোখ পড়ে নিশরাতের। খোদা!! কি হচ্ছে এসব!!
ইত্তেফাক অফিসে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। ট্যাঙ্কের সারি দাঁড়িয়ে আছে। একেকটা গোলা ফায়ার করার সাথে সাথে কেঁপে উঠছে ওদের বাসাটা। আগুন মনে হচ্ছে আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা করছে। চারপাশে শুধু অবিরাম গুলির আওয়াজ। আর মাঝে মাঝে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠছে ট্যাঙ্কগুলো। নিজের চোখকেও অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। আগুনের আঁচ এত তীব্র, জানালার শিকগুলো গরম হয়ে যেতে হাতে তাপ লাগায় জানালা ছেড়ে পিছিয়ে এল ওরা। কাঠের জানালা। ভয় হচ্ছে আগুন না ধরে যায়!! দ্রুত বালতি করে পানি এনে জানালার কাঠে পানি ঢালতে থাকে ওরা।
একটু পর শুরু হয় মানুষের আসা। ইত্তেফাক অফিসের সবাই যেন ওদের বাড়িতে আসছে। প্রত্যেকে আবার পেছন দরজা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সারারাত সেদিন ওদের ব্যস্ত থাকতে হয় এসব কাজে।
পরদিন সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে আঁতকে ওঠে ওরা সবাই। যেখানে সেখানে পড়ে আছে মানুষের লাশ। গুলিতে মুখের একপাশ উড়ে গেছে কারও কারও। ইত্তেফাক অফিসের আগুনে পোড়া লাশগুলো কোনভাবেই চেনার উপায় নেই। একদম পুড়ে কালো হয়ে বিকৃত হয়ে গেছে।
ফেরার পথে একটি বাড়ির সদর দরজায় ঝুলন্ত একটি কিশোরের লাশ দেখে ওরা। হয়তো ভীত হয়ে দরজার ওপাশে টপকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। গুলি সেই দরজার সাথেই ঝুলন্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
সারাদিন মুখ গম্ভীর করে অস্থির হয়ে পায়চারী করে নিশরাত। পরদিন ২৭ মার্চ ভোরে বাড়ি ছাড়ে সে। মায়ের কাছে শুধু বলে যায়, ‘ফিরে আসব মা’।
কথা রাখে সে। ফিরে আসে মাত্র আটদিনের মাথায়। ৪ এপ্রিল। এবার শুধু সে আসে না। ওর খুব কাছের তিনজন বন্ধুও আসে ওর সাথে। বদি, মাসুদ পং আর বাদল। খালি হাতে আসে না ওরা। কোথা থেকে যেন ছয়টা রাইফেল নিয়ে আসে ওরা। সাথে অনেক গুলি। চোখ কপালে ওঠে সাদেকার। এরকম কারফিউয়ের ভেতর এসব নিয়ে ঢাকায় আসার সাহস করেছে তাঁর ছেলে। ধরা পড়লে কি হত ভাবতেই শিউরে ওঠেন তিনি। কিন্তু বাবা আজিজ উস সামাদ ঠিকই নিশরাতকে সাহায্য করেন অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখতে।
- ভাইয়া, এগুলো পেলে কিভাবে??
- সে অনেক কথারে ভাইয়া। অনেক বড় কাহিনী।
উলফাতের প্রশ্নের জবাবে বলে নিশরাত।
বাবা রাতে ডাকেন নিশরাতকে। বসার ঘরে সবাই বসে রয়েছে।
- এবার বল, কি হয়েছে। কিভাবে কী করেছ? এগুলো কোথায় পেয়েছ?
- বাবা কিশোরগঞ্জে।
- তোমরা কিশোরগঞ্জ গিয়ে এসব নিয়ে ফিরে এসেছ!!
বিস্মিত গলায় বলে ওঠেন মা।
- তারপর?
- ওখানে মেজর শফিউল্লাহ বিদ্রোহ করেছেন বাবা। ওখানে বাদল লেঃ হেলালের সাথে যোগাযোগ করে অস্ত্রগুলো এনেছে।
- যুদ্ধ তাহলে শুরু হয়েই গেল? আর কেউ বিদ্রোহ করেছে?
- সারা দেশেই বাঙ্গালী ইউনিটগুলো বিদ্রোহ করছে বাবা। মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁর সেকেন্ড বেঙ্গল নিয়ে বিদ্রোহ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আখাউরার দিকে আগাচ্ছেন। উনার ইউনিটের লেঃ মাহবুবের সাথে আমাদের দেখা হয়েছে। উনি বললেন কর্নেল জামান আর মেজর জিয়া নামে দুই অফিসারও তাদের ইউনিট নিয়ে বিদ্রোহ করেছেন।
- এখন উনারা কোথায় আছেন?
- উনারা সিলেটে যাচ্ছেন তেলিয়াপারাতে। ওখানে মনে হয় মুক্ত দেশের প্রথম ক্যাম্প করা হবে।
- তুমি কি চাও??
- বাবা আমি যেতে চাই।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে রুদ্ধশাসে অপেক্ষা করে নিশরাত।
মা চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘ঘরের ছেলে ঘরে থাকো। কোথাও যেতে হবে না। স্কলারশিপ পেলে আমেরিকা চলে যাবে’।
বাবা কিছু না বলে চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে থাকেন।
কোথা থেকে এত আবেগ আসল নিশরাত জানে না, শুধু কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,
- মাগো! তোমার চার চারটা ছেলে! একজনকে, কেবল একজনকে তুমি কোরবানি করতে পারো না দেশের জন্য?? তোমার আমার মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য???
স্তব্ধ হয়ে যান সাদেকা। মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে কাঁদতে চলে যান ভেতর ঘরে। বাবা মাথা নিচু করে বসে থাকেন। একটু পর বলে ওঠেন,
-তাহলে এখন কি করতে চাও তুমি??
-উত্তরে রৌমারীর দিকে আমাদের প্রতিরোধ যোদ্ধারা যুদ্ধ করছে বাবা। আমরা তাদের সাথে গিয়ে যোগ দিব।
-তারপর?
-ওখান থেকেই তো কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। তুমি চিন্তা করো না। আমি বদি মাসুদ পং ওদের সাথে কথা বলেছি। বদি থেকে যাবে। ও তোমাদের দিকে খেয়াল রাখবে, দোয়া করো বাবা।

এরপর চলুন আমরা গল্পের মত কিছু কাহিনী শুনি।
দুদিন পর মাসুদ পং আর বাদলের সাথে রৌমারী রওনা দেয় নিশরাত। তার কিছুদিন পর তৌফিকও চলে যায় রৌমারীতে। আর এর কিছুদিন পর এপ্রিলের ১৮ তারিখ উলফাত চলে যায় আগরতলায়। জায়গাটার নাম মেলাঘর। কিছুদিন পর এখানেই সে মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারের তত্ত্বাবধানে গেরিলা ট্রেনিং নেয়া শুরু করে। পরে এরাই পরিচিত হয় ক্র্যাক প্লাটুন নামে।

সে যাক, আমরা আবার ফিরে আসি নিশরাতের কাছে।
রৌমারী যাওয়ার জন্য বাসে ওঠে ও। ঢিমে তালে চলছে বাস। সবার মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। দুলতে দুলতে ঝিমুনি এসে পড়ে নিশরাতের। হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় বাস।
খাকি পোশাক পড়া একজন সৈন্য সবাইকে কর্কশ গলায় নির্দেশ দেয় নিচে নামার জন্য।
- নাম কেয়া হ্যায় তুমহারা?
- আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ।
- আইডি কার্ড হ্যায় তুমহারে পাস?
- ইয়েস, হিয়ার ইস ইট।
ওর মুখে ইংরেজী শুনে ভুরু কুঁচকে তাকায় সৈন্যটি।
-কেয়া হুয়া ইকবাল??
একজন অফিসার এগিয়ে আসে ওর দিকে। বুকের ভেতর ধড়ফড় করা শুরু হয়ে গেছে নিশরাতের। দেশের জন্য কিছু করার আগেই কি এই জানোয়ারদের হাতে জীবন দিতে হবে। হতাশায় নুইয়ে আসে সে।


ক্যাপ্টেন বেগের মন আজ খুব খুশি। এইমাত্র মেজর চিশতী স্যার তাকে ফোন করে জানালেন পশ্চিম পাকিস্তানে তার বিবি ফুটফুটে একটি ছেলে প্রসব করেছে। মনে মনে ছেলের নাম ঠিক করে রেখেছে ইব্রাহিম। দেশের গণ্ডগোল ঠাণ্ডা হলেই সে ছুটি পাবে। দেখতে যাবে তার রাজপুত্রকে।
-আসলাম, কাম হিয়ার। গাড়ি রেডি?
-জ্বি হাঁ স্যার, রেডি হ্যায়।
পাঞ্জাবি গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে গাড়িতে চড়ে ক্যাপ্টেন বেগ। নাহ, আজকের দিনে শুধু শুধু এই কাফেরদের মারবে না। তল্লাশিতে কিছু না পেলে আজ ছেড়ে দেবে। অন্যান্য দিন তার প্রিয় কাজ হয় এসব কাফেরের মাথার পেছনে রিভলবারের একটি গুলি ঢুকিয়ে দেয়া।
চেক পোস্টে একটা বাস থামানোই রয়েছে। কর্পোরাল ইকবাল একটা যুবককে কি যেন জিজ্ঞেস করছে। এইসব বাঙালি কাফের যুবক দেখলেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। গুলি করার ইচ্ছায় হাত শুধু নিশপিশ করে। এরাই সব ঝামেলা করে। নাহ, আজ বিনা কারণে কাউকে মারবে না।
-কেয়া হুয়া ইকবাল?
-স্যার ইয়ে হারামি আংরেজি মে বাকওয়াস কার রাহা হ্যায়।
এগিয়ে গিয়ে তার আইডি কার্ড হাতে নিল বেগ।
- তুমি মিঃ সামাদ?
- জ্বি।
- রংপুর যাচ্ছ কেন, সামাদ?
- আমার মায়ের মামা মারা গেছেন। তার জানাজা পড়ে লাশ কবর দিব।
- তুমি যে সত্য কথা বলছ তা প্রমান করতে পারলে তোমাকে ছেড়ে দেব।
- দেখুন, আমার তো মিথ্যা বলার কোন কারণ নেই।
‘এই একে সার্চ কর। কিছু পাওয়া গেলে গুলি কর আর না পেলে ছেড়ে দাও’।
ভাগ্য ভালো এই হারামির। বেঁচে গেল শুধু তার সদ্যোজাত শিশুর জন্য। নাহলে এরকম কাটা কাটা সুরে জবাব দিলে সাথে সাথে দুই চোখের মাঝখানটাতে গুলি করে ক্যাপ্টেন বেগ।
‘নেক্সট!!’ হাঁক শুনে ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে নিশরাতের। প্রানপনে চেষ্টা করছে নিজেকে স্থির রাখার।

কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও নৌকায়, কখনওবা মহিষের গাড়িতে করে অবশেষে রৌমারী পৌঁছে নিশরাত। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করে রাইফেল, স্টেনগান আর মিডিয়াম মেশিনগান চালনার ট্রেনিং নেয় সে। গেরিলা কায়দায় চলতে থাকে যুদ্ধ।
এখন আর ওর ভেতর নিশরাত নামের বিশ বছরের টগবগে তরুণটি আর নেই। এখন তার মাঝে বাস করে বিশ বছর বয়সের পোড় খাওয়া এক যোদ্ধা আশফাকুস সামাদ, গণবাহিনী। সবাই যাকে ‘আশফি’ নামে চেনে। যে যোদ্ধা শত্রুশিবিরে হাসতে হাসতে বিপজ্জনক ভাবে আক্রমন করে আবার ফিরে আসে, আবার যে কিনা সেই অপারেশনেই মৃত সহযোদ্ধার লাশ বুকে নিয়ে পাথর হয়ে বসে থাকে। পঁচিশে মার্চের পরদিন যে চোখে পানি টলমল করেছিল, সে চোখে এখন আগুন খেলা করে। সে চোখ এখন শত্রুর লাশ দেখে ক্রূর হাসি হাসে। যে হাত সেদিন নিশপিশ করেছিল, আজ সে হাতের আঙুল মিডিয়াম মেশিনগানের ট্রিগারে চেপে থাকে, ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে দেখে শত্রুর বুক।

অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। পাকিস্তানিরা বৃষ্টি পছন্দ করে না। এক দৃষ্টিতে বৃষ্টি পড়া দেখছে আশফি। সিগারেটের ছ্যাকা লাগতে হাত ঝাড়া দিয়ে ওঠে সে। কখন যে পুড়তে পুড়তে হাতের কাছে এসে গেছে টেরই পায় নি। মা খেতে ডাক দেন। জুনের প্রথম দিকে অল্প কিছুদিনের এই ছুটিতে আসার সাথে সাথেই মায়ের আদরযত্ন যেন আকাশ ছুঁয়েছে। ছেলে যুদ্ধের ময়দানে কি খায় না খায়, আদৌ খেতে পারে কিনা... মায়ের আর চিন্তার শেষ নেই। আগামীকালই রওনা দিতে হবে। ছুটি প্রায় শেষ। মুক্তাঞ্চলে পৌঁছান অনেক ঝক্কি ঝামেলা। পালিয়ে পালিয়ে অন্তত সন্তর্পণে যেতে হয়। অনেক সময় লেগে যায় তাতে।

ক্যাম্পে এসেই তার নামে একটা চিঠি পায় আশফি। উপরে মুজিবনগর সরকারের সিল দেয়া। কৌতূহল নিয়ে খামটা খোলে সে। ভেতরের লেখাগুলো পড়ে এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে সে। খুশিতে যেন ডানা মেলতে ইচ্ছে করে। পাশেই তার কমান্ডারের নোট “আশফি, ফার্স্ট ওয়ার কোর্সে তুমি একজন ট্রেইনি অফিসার হতে যাচ্ছো। অভিনন্দন”।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সে সে অফিসার হতে যাচ্ছে। সে নিজে নেতৃত্ব দিবে তার সৈন্যদের। পাথর মুখে কয়েকমাসের মধ্যে প্রথম হাসি ফোটে।
ওয়ার কোর্সের দিনগুলো যন্ত্রের মত কেটে যায়। প্রতিদিন ভোরবেলা শরীরচর্চা দিয়ে শুরু। যুদ্ধের কলাকৌশল, অস্ত্র চালনা, এক্সপ্লোসিভ নিয়ে ট্রেনিং এই ট্রেনিং ওই ট্রেনিং আরও কত কী! ফুরসতই মেলে না ট্রেইনি অফিসার আশফির। তবু মাঝেমধ্যে বিরল যে অবসর সময়টুকু পায়, মাকে চিঠি লেখা আর আড্ডাতেই কেটে যায়। অবশ্য সে জানেও না চিঠিগুলো মায়ের কাছে আদৌ কখনও পৌঁছাবে কি না। তাদের সাথেই কোর্সে আরও অনেক ট্রেইনি অফিসার, প্রত্যেকেই সংকল্পবদ্ধ দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দিবে। ওদের সাথেই জামাল ট্রেনিং করে। প্রথমে ওর বিশ্বাসই হয় নি, বঙ্গবন্ধুর ছেলে তার কোর্সমেট! অবশ্য জামালের সহজ ব্যবহারে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই জড়তা কেটে গেছে সবার।
সময় ঘনিয়ে আসে। কোর্স প্রায় শেষের দিকে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হতে আর বেশিদিন নেই। অবশেষে নিজের প্লাটুন, নিজে কমান্ড করবে ‘লেফটেন্যান্ট’ আশফি, উত্তেজনায় ইদানীং ঘুমই হয় না ওর।
অবশেষে কমিশন্ড হয়ে পোস্টিং পায় আশফি। দায়িত্ব পড়ে উত্তরাঞ্চলে যতটা সম্ভব মুক্তাঞ্চল তৈরি করা। কাজটা সহজ না। কিন্তু অসাধারণ কলাকৌশল আর বীরত্বে একের পর এক এলাকা মুক্ত করতে থাকে তার কোম্পানি।
নভেম্বর এসে গেছে। সারাদেশ থেকে প্রতিদিন নিত্যনতুন অঞ্চল মুক্ত হচ্ছে পাকবাহিনীর করাল গ্রাস থেকে। অনেকদিন পর আজ একটু অবসর পেয়েছে সে। ক্যাম্পে নিভৃতে নিজের বাঙ্কারে আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে তাই।
মাঝেমাঝে রুমার কথা খুব মনে পড়ে ওর। কেমন আছে মেয়েটা? ঢাকায় যোগাযোগ করা খুব কঠিন। হঠাৎ হঠাৎ চিঠি আদানপ্রদান হয়। কিছুদিন আগেই ওর একটা চিঠি পেয়েছে আশফি। মেয়েটা খুব সুন্দর একটা কবিতা লিখে পাঠিয়েছে এবার। যুদ্ধের ফাঁকে সময় হয় নি জবাব দেয়ার। নাহ, এখনই জবাব লিখে ফেলা দরকার। আবার কবে সময় পায় কে জানে!



“প্রিয় রুমা,
যুদ্ধের এই ময়দানে তোমার চিঠিটা পেয়ে খুবই ভালো লাগল। এই যুদ্ধ, ধ্বংস আর মৃত্যুর বাইরেও যে চমৎকার একটা দুনিয়া আছে, এই বাঙ্কারে বসে দূরে এখনো গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যেও মনে পড়ে গেল, বুঝলে? তুমি শুনে খুব খুশি হবে রুমা, আমি তোমাকে এই চিঠিটা লিখছি মুক্তাঞ্চল থেকে। স্বাধীন দেশের মুক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে শ্বাস নেবার আনন্দটা আসলে তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না। ...............”
রোমান্টিসিজমের মধ্যেও বাস্তবতা ভুলে যায় না পোড় খাওয়া যোদ্ধা। শেষ দিকে লিখে দেয়, “তোমার কবিতাটা খুবই অসাধারণ হয়েছে। তোমার আমার দেখা আশা করি স্বাধীন দেশের মাটিতেই হবে। আমার জন্য যে রুমাল বানিয়েছ, সেটা তখনই দিয়ো। যদি না হয় সেটা, আমার এপিটাফে তোমার লেখা একটা কবিতা দিয়ো; আর হ্যাঁ, কিছু ফুল রেখে দিতে ভুলো না যেন!”


নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়। কুড়িগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী একে একে ছেড়ে যাচ্ছে এলাকা। আশফির কোম্পানির তুখোড় আক্রমণ সহ্য না করতে পেরে একে একে পশ্চাদপসরণ করে সরে যাচ্ছে রায়গঞ্জের দিকে।
কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে সহযোদ্ধা লেঃ আব্দুল্লাহর সাথে কথা বলতে যায় আশফি। মুক্তিবাহিনীর চররা লেঃ আব্দুল্লাহর কাছে তথ্য এনেছে, রায়গঞ্জে পাকিস্তানিরা রীতিমত দুর্গ গড়ে তুলেছে।
- আব্দুল্লাহ, শুনেছিস ডিটেইলস ইনফরমেশনগুলো?
- হুম। হারামজাদারা তো দুর্গ বানিয়েছে মনে হয় রায়গঞ্জে।
- কি কি এনেছে জানিস নাকি?
- হুম, ছয়টা মিডিয়াম মেশিনগান বসিয়েছে শালারা শুধু দুধকুমার নদের উপরেই। আরও তিনটা হেভি মেশিনগান আছে ব্রিজের ওপারে বিল্ডিঙয়ের ছাদে।
- বলিস কী!! আক্রমণ তো শুধু পশ্চিম পাশ দিয়ে করা যাবে! কিন্তু এদিকে তো অনেকদূর পর্যন্ত একদম খোলা, কোন কভারই নেই। গুলি করলে তো আমাদের ছেলেরা কচুকাটা হয়ে যাবে।
- দেখি, চল আজ রাতেই বসি প্ল্যান নিয়ে। ইন্ডিয়ানরা সোলজারসহ কিছু হেল্প করতে পারে। না হলে শুধু আমরাই যাব। ওদের এক মেজর আসছে আজকে রাতে। তখনই কথা বলব নি।

রাত আটটায় ভারতীয় সীমান্তের দিক থেকে তিনচারটা গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা যায়। তাদের স্বাগত জানায় আশফি। মেজর ওপেল এসেছেন কথা বলতে। একটা রাজপুত কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার।
আশফির বাঙ্কারে একত্র হয় অফিসাররা। ঠিক হয় পরিকল্পনা। পাঁচ কোম্পানি যৌথ বাহিনী আক্রমণ করবে। মুক্তিবাহিনীর দুইটা, নেতৃত্বে থাকবে লেঃ আশফাক আর লেঃ আব্দুল্লাহ, দুই কোম্পানি বিএসএফ আর এক কোম্পানি রাজপুত ব্যাটালিয়নের সৈন্য যারা থাকবে মেজর ওপেলের অধীনে। নিঃশব্দে এগিয়ে যাবে যোদ্ধারা। ব্রিজের একটু দূরে থেকে দুধকুমার নদ অতিক্রম করতে পা্রলেই কেল্লা ফতে। মাঝখানে রাজপুত কোম্পানি আর তার দুপাশে বিএসএফ। দুই সাইডে থাকবে মুক্তিবাহিনী। রায়গঞ্জ দখল করতেই হবে। তাহলে কুড়িগ্রাম শহর পর্যন্ত পাকি হারামি গুলোর আর কোন ডিফেন্স লাইন থাকবে না।

পরদিন একটু দেরিতেই ওঠে আশফি। উঠেই দেখে টেবিলে দুটো চিঠি।
“লেঃ আবু মঈন মোঃ আশফাকুস সামাদকে সেক্টর সদরদপ্তরে বদলী করা হল।”
“তানি,
পাকবাহিনী আর তাদের দালালরা খুব জ্বালাচ্ছে রে। তোরা সবভাই যুদ্ধে গেছিস জানার পর থেকেই নিয়মিত এসে হুমকি ধামকি দিচ্ছে ওরা। তোর বাবা বলল আমরা দু এক দিনের ভেতরই ঢাকা ছেড়ে চলে যাব। হয় ভারতে আর নাহয় তোর মুক্ত করা মাটিতে। সাবধানে থাকিস বাবা।
মা।”
দ্বিতীয় চিঠির আর জবাব দেয়া হয় না। প্রথম চিঠিটা পড়ে শান্তভাবে জবাব লিখে পাঠায় আশফি।
রায়গঞ্জ দখল করেই চার পাচদিনের মধ্যে সেক্টর সদরদপ্তরে যোগদান করবে সে। সম্পূর্ণ আক্রমণ পরিকল্পনা করে যুদ্ধের সময় সে থাকবে না, তাই কি হয়??
নভেম্বরের ১৯ তারিখ।
আজই আক্রমণ। রায়গঞ্জ আজ মুক্ত হবেই হবে। গভীর রাত। নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে যৌথ বাহিনীর অকুতোভয় সেনারা। টানটান উত্তেজনা সবার মাঝে। দুধকুমার নদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে প্রায়।
কান ফাটানো শব্দে মাইন বিস্ফোরিত হল। হতভম্ব হয়ে গেল আশফি। শব্দটা রাজপুত কোম্পানির ওদিক থেকে এসেছে। সর্বনাশ!! সাথে সাথে মনে হল যেন নরক নেমে এসেছে রায়গঞ্জের বুকে। মুহুর্মুহু মেশিনগানের গুলির স্রোত যেন ধুয়ে যাচ্ছে যৌথ বাহিনীর যোদ্ধাদের উপর। বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ছে ওরা। দ্রুত সামলে নীল আশফি।
গলা ফাটিয়ে অর্ডার দেয়, “বয়েজ, রিট্রিট, রিট্রিট, ফল ব্যাক নাউ!!”
পাশেই অনুগত জেসিও গুলি করছে শত্রু অবস্থানের দিকে।
- জেসিও সাহেব, আপনার রেডিও আমাকে দেন, সোলজারদের নিয়ে পিছিয়ে যান, ওইখানে কভার নেন।
পেছনে কয়েকশ গজ দূরে গাছপালার সারি দেখায় সে।
- স্যার, আমার তো আর্টিলারি সাপোর্ট কল করার কথা।
- আমিই কল করবো। আপনি যান।
- না স্যার, আমি এইখানে আপনাকে এভাবে রেখে যাইতে পারুম না স্যার। বইলেন না।
- লিসেন টু মি ইউ ইডিয়েট! আপনি না গেলে সোলজার সবাই মারা যাবে। মুভ, নাউ!!
একটা মিডিয়াম মেশিনগান নিয়ে ক্রল করে একটু সামনে ছোট্ট একটা বোল্ডারের আড়াল নেয় সে। জেসিও ফিরে যাচ্ছে সৈন্যদের কাছে। একটু পর পর পেছন থেকে ওর সৈনিকদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে আশফি। লম্বা একটা দম নিয়ে ফায়ার ওপেন করে সে।



এরপরের ঘটনা আসলে গল্পে লেখার সাধ্য বা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। শুধু বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছি।
ফায়ার ওপেন করার সাথে সাথে পাক বাহিনীর সম্পূর্ণ আক্রমণ নিবদ্ধ হয় তরুণ এই লেফটেন্যান্টের দিকে। সহযোদ্ধা অধীনস্থ সৈনিকদের রক্ষায় কভারিং ফায়ার দিতে দিতেও শত্রুর বেশ ক্ষতিসাধন করেন তিনি। বিশ মিনিট পর নিস্তব্ধ হয়ে যায় তাঁর মিডিয়াম মেশিনগানের শব্দ। ডুকরে কেঁদে ওঠে পেছনে ততক্ষণে নিরাপদ অবস্থানে চলে আসা মুক্তিবাহিনীর কেউ কেউ।
কিন্তু এই বিশ মিনিটে বেঁচে যায় দুই কোম্পানি মুক্তিবাহিনী, দুই কোম্পানি বিএসএফ আর এক কোম্পানি রাজপুত সেনাদের অধিকাংশ সেনা।
লেঃ আশফাককে তাঁর সৈন্যরা এতই ভালবাসত যে তাঁর লাশ উদ্ধার করতে গিয়ে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অবশেষে সেই জেসিও তাঁর লাশের কাছে পৌঁছাতে পারেন। নাহ, কোন খেদ বা আক্ষেপ ছিল না তরুণ যোদ্ধার মুখে। শান্ত সমাহিত ভঙ্গিতে শুয়েছিলেন তিনি। শুধু হাতদুটো শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ করা। যেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এক যোদ্ধার আত্মপ্রত্যয়কেই ব্যক্ত করছে নীরব চিৎকারে। কপালের ঠিক মাঝখানে লেগেছিল গুলিটা।
পরদিন মুক্ত রায়গঞ্জে জয়মনিরহাট মসজিদ প্রাঙ্গনে আরও তিন সহযোদ্ধাসহ ২৭ গান স্যালুটের মাধ্যমে সমাহিত করা হয় মাত্র একুশ বছর বয়েসে জীবন দেয়া এই বীর যোদ্ধাকে। সেদিনের যুদ্ধে মেজর ওপেলও শহীদ হয়েছিলেন।
সেদিন রায়গঞ্জ মুক্ত হয়েছিল। রায়গঞ্জের মানুষ খুশিতে উল্লাস করছিল। আর মুক্তিযোদ্ধারা পাথরের মত মুখ করে কবর খুঁড়ছিলেন। নীরবেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল গাল বেয়ে। যোদ্ধাদের যে চিৎকার করে কাঁদতে নেই!

বাবা মায়ের আদরের সেই ছোট্ট তানি, বন্ধুদের প্রিয় নিশরাত, সহযোদ্ধা আর সিনিয়র অফিসারদের কাছে জনপ্রিয় তরুণ লেঃ আশফি, অধীনস্থ যোদ্ধাদের প্রিয় আশফাক স্যার; ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যার এমআইটিতে পড়তে যাওয়ার কথা, দেশ স্বাধীন হলে যার মুক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে রুমার কাছ থেকে নকশা করা রুমাল উপহার নেয়ার কথা......, রোগাটে সেই ছেলেটি জয়মনিরহাট মসজিদ প্রাঙ্গনে শুয়ে আছে চিরকালের জন্য; নিজের অধীনস্থ যোদ্ধাদের বাঁচাতে নিজের জীবন শান্তভাবে বিলিয়ে দিয়ে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার লেঃ আবু মঈন মোঃ আশফাকুস সামাদকে তাঁর অসাধারণ বীরত্ব এবং আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে মরণোত্তর “বীর উত্তম” খেতাবে ভূষিত করে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×