বাঙ্গালী টাইম বলতে একটা কথা আছে । আমার ধারনা ছিল ব্লগাররা হয়ত বাঙ্গালী টাইম ফলো করবেনা । কিন্তু কিসের কি ? আমি যখন আমাদের পাঠশালায় পৌছলাম তখন কাটায় কাটায় ১১টা । একমাত্র ব্লগার অন্তিম ছাড়া আর কাউকে পেলাম না । বসলাম আমাদের পাঠশালার অফিসে, লক্ষ্য করছিলাম স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের । স্কুলে ছাত্ররা এত প্রাণবন্ত এর আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না । ৮/৯ বৎসর বয়সের একটা মেয়ে এসে অফিস রুমে ঢুকল, জানলাম গত দুইদিন সে স্কুলে আসেনি । মাত্র দুইদিন স্কুলে আসতে পারেনি বলে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, আজকে আসতে পেরে সে শান্তি পেয়েছে । তার মাথা ন্যড়া হওয়াতে টিচাররা তাকে বেল মাথা বেল মাথা বলে ক্ষেপাচ্ছে ।
আরো কিছুক্ষণ বসে অন্তিম সহ বের হয়ে আসলাম । উদ্দেশ্য চা খাব, পাশের একটা দোকান থেকে চা খেয়ে যখন ফিরলাম তখন বেশ কয়েকজন ব্লগার উপস্থিত । সবাই স্কুলের সামনে ইট সিমেন্ট দিয়ে যে বসার জায়গা বানানো হয়েছে সেখানে বসে আছে । আমরাও সেখানেই বসলাম । আমাদের সবার লক্ষ্য ছাত্রদের দিকে । ওরা এত উচ্ছল, লাফালাফি দৌড়াদৌড়ি করছে ? আরো কত স্কুল দেখেছি শিক্ষককে দেখলে ছাত্ররা দৌড়ে গিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকে । আর এখানে শিক্ষকের হাত ধরে টানাটানি করছে যেভাবে একটা শিশু তার বাবা মা কে টানে, কোন জড়তা নেই । এক সময় আমরা আমাদের নির্ধারিত আড্ডায় বসলাম । মুড়ি পেয়াজুর দাওয়াত থাকলেও পেয়াজু বদলে সিংগাড়া ছিল । আড্ডার সঞ্ছালকের ভূমিকা পালন করেছেন কৌশিকদা, এই আড্ডায় তাকে প্রথমবার দেখেছি এমন লোক যে আড্ডায় থাকে সেটা না জমে পারেইনা ।
আড্ডা হলেও এটার একটা উদ্দেশ্য ছিল । আমরা স্কুলের প্রধান শিক্ষক রুবেল ভাইর কথা শুনার জন্য উদগ্রীব ছিলাম । তার কথাগুলা পরবর্তী কোন একটা পোষ্টে লেখা যাবে । রুবেল ভাই যখন কথা বলছিল তখন মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম একজন মানুষ এত চিন্তা করতে পারে ? এত গভীরে ভাবতে পারে ? সমাজকে নিয়ে, সমাজের বঞ্চিত মানুষকে নিয়ে, প্রভাবশালী মানুষকে নিয়ে, সরকারকে নিয়ে, এন জি ও কে নিয়ে ।
তার কাছ থেকেই শুনেছিলাম সুবিধা বঞ্চিত শিশুদেরকে নিয়ে কাজ করতে গেলে কেন এন জি ও র সাহায্য নেয়া যাবেনা, এন জি ও র নীতি কিভাবে ওদের প্রকৃত শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হিসাবে কাজ করে । আগে কখনও যেমন করে ভাবিনি, আমাদের আড্ডার পর থেকে তেমন করে ভাবতে শুরু করলাম যে - আমাদের সরকার প্রতি বছর প্রচুর পরিমানে অর্থ ব্যয় করে প্রাথমিক শিক্ষার পিছনে কিন্তু সেখান থেকে উচ্চবৃত্ত ও মধ্যবৃত্তরাই শুধু বের হয়ে আসছে যারা এই ব্যয় না হলেও বের হত । কিন্তু নিম্নবৃত্ত বা সুবিধা বঞ্চিত রা ঠিকই ঝরে যাচ্ছে । অবশ্যই এখানে এমন কোন ঘাটতি আছে যার কারণে ঐ সুবিধা বঞ্চিত শিশুদেরকে স্কুলে ধরে রাখা যাচ্ছেনা ।
বলছিলেন রুবেল ভাই "আমরা এখনও শিখি, আমরা শিখি এইসব শিশুদের কাছ থেকে যে তারা কিভাবে শিখতে চায়, আমরা তাদের জন্য সেই পরিবেশ তৈরি করেছি যে বন্ধ থাকলেও তারা একবার এসে স্কুল থেকে ঘুরে যায় এখানে না আসলে তাদের ভাল লাগেনা" । যেহেতু ঝরে পড়ার ঘটনা নেই তাই আমাদের পাঠশালা হবে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত তার পর ছাত্রদের পছন্দ অনুযায়ী ভোকেশনাল অথবা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এস সি প্রোগরামে ভর্তি করা হবে এবং সেখানেও তাদেরকে সহযোগীতা করা হবে । তার অর্থ হচ্ছে একটা ছাত্রকে সেই পর্যায়ে পৌছানো যেখানে পৌছলে সে জীবন সংগ্রামের জন্য তৈরী হয়ে যাবে । সে বুঝতে পারবে যে তাকে এগিয়ে যেতে হলে পড়া লেখা করতে হবে । এই প্রচেষ্টা আমাদের দেশে একেবারে নতুন ।
এই প্রচেষ্টাকে যদি ধরে রাখা যায় তাহলে বাংলাদেশে সুবিধাবঞ্চিতের হার অনেক কমিয়ে আনা যাবে । কারণ যে শিক্ষিত হয়ে যাবে সে আর সুবিধাবঞ্চিত থাকবে না । তবে এর জন্য ইহাকে মিরপুরের এই ছোট্ট পরিসরে রাখলে চলবে না । এই প্রচেষ্টাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে । তার জন্য প্রয়োজন হবে একটা শক্তিশালী ফান্ড । আমাদের আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল এটাই যে কিভাবে এই ফান্ডকে ভাল করা যায় এবং একটা মানবিক প্রচেষ্টাকে অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া যায় ।
যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানে সরকারের কোন অনুদান নেই, নেই কোন এন জি ও অথবা বৈদেশিক সাহায্য তাই এটা চলছে এই দেশেরই কিছু সাদা মনের মানুষের ব্যক্তিগত সাহায্যে । তাদের সহযোগীতায় এই প্রতিষ্টান যেমন আছে তেমনভাবে চালিয়ে নেয়া সম্ভব । কিন্তু আমাদের দেশে সুবিধাবঞ্চিত শিশু এই দেড়শ দুইশ নয়, লক্ষ লক্ষ !! তাই এইভাবে চললে আমরা যে সুফলটা চাই সেটা আদৌ কবে আসবে তা চিন্তার বিষয় ।
যখন রুবোল ভাইর স্বপ্নের কথাগলো শুনছিলাম আমার চোখে ভাসছিল আজ থেকে ২৫/৩০ বছর পরের বাংলাদেশ যেখানে আমাদের পঠশালার মত প্রতিষ্ঠান সুবিধাবঞ্চতদেরকে হন্যে হয়ে খুজছে কিন্তু পাচ্ছনা । কারণ তারা শিক্ষিত হয়ে গেছে, সংগ্রাম করছে, নিজের অবস্তাকে পরিবর্তন করছে সেই সাথে দেশের অবস্তাকেও পরিবর্তন করে দিচ্ছে ।
একটা গল্পে পড়েছিলাম চীনের কোন একটা অঞ্চলকে নিয়ে । ওখানেএকটা পাহাড়ের কারণে একটা এলাকার লোকজনের যাতায়াত ব্যবস্তা খুবই খারাপ ছিল । পাহাড়টা অনেক বড় ও দুর্ঘম হওয়াত কেহ ঐদিকে রাস্তা বনানোর কথা চিন্তাও করত না । কিন্তু একদিন এক বৃদ্ধ কোদাল খুন্তি নিয়ে পাহাড় কাটা শুরু করল রাস্তা বানানোর উদ্দেশ্যে । লোকজন যখন দেখল বৃদ্ধ পাহাড় কাটছে তখন বল্ল তুমি কি পাগল হয়েছ? তুমি একজন বৃদ্ধ ঐ পাহাড় কাটা তোমার পক্ষে কোনদিনও সম্ভব হবেনা । বৃদ্ধ বল্ল আমি জানি আমার পক্ষে এই পহাড় কাটা সম্ভব না আর আমি এটাও জানি যে এই অঞ্চলের লোকজন জানে এই পাহাড়টা কাটা দরকার এবং তাদের রাস্তাও দরকার । আমি রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু করলাম এবার মানুষ তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই এটাকে এগিয়ে নেবে । একসময় দুইজন চারজন করে অনেক লোক পাহাড় কাটায় চলে আসলো এবং রাস্তাও হয়েগেল ।
আমরাও স্বপ্ন দেখি আমাদের দেশটা হবে শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ । কিন্তু এর পথটা অনেক দুর্ঘম, তবে কাজ শুরু হয়ে গেছে, এবার আমাদের পালা ।
আমরা এমন কিছু লোক খুজছি যারা সম্পর্ক সৃষ্টি করবে, বন্ধন প্রতিষ্টা করবে এবং শেষ সময় পর্যন্ত সাথে থাকবে ।
ব্লগারর কিভাবে অংশগ্রহন করতে পারে তা বিস্তারিত ছিল সাদিক ভাই এবং কৌশিক দার পোষ্টে তাই আমি আর ঐদিকে যাচ্ছিনা ।
কেউ ইচ্ছা করলে পড়ে আসতে পারেন -
সাদিক ভাইর পোষ্ট-http://www.somewhereinblog.net/blog/mysticsaint/28949115
কৌশিক দার পোষ্ট-http://www.somewhereinblog.net/blog/kowshikblog/28948708
কাভাবে আড্ডার সমাপ্তি হল তা আছে ক্যামেরাম্যানের পোষ্টে -
ক্যামেরাম্যানের পোষ্ট-http://www.somewhereinblog.net/blog/cameramanblog/28948858
শেষ করার সময় এটাই বলতে চাই - পরিবর্তন আসবেই, তবে যারা সঙ্গী হল পরিবর্তনটা তাদের হাত ধরেই আসল ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০০৯ সকাল ১০:৩২