কিছুদিন আগে আমি পান্থপথ গ্রীণরোড মসজিদে জুমআর নামাজ পড়তে গেছি । যদিও রাজাবাজার মসজিদটা কাছে তবুও ঐ মসজিদে যাই কারণ এখানে জায়গা পেতে সমস্যা হয় এবং গ্রীণরোড মসজিদে নামাজ আগে হয়, তাই ।
সেদিন গিয়ে মসজিদে ঢুকব এমন সময় একটা ভিক্ষুক কাছে এসে বল্ল - স্যার আমাকে কিছু সাহায্য করুণ আমার বাড়ী সিলেট । লোকটিকে চিনতে আমার একটুও ভুল হলনা যদিও তাকে প্রথম এবং শেষবার দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে এখানেই । আজ সে ভিক্ষা করছে! দেখতেও পরিপূর্ণ ভিক্ষুক কিন্তু তখন সে ভিক্ষুক ছিলনা, দেখতেও ভিক্ষুক ছিলনা । সে ছিল নিম্নবিত্তের একজন খেটে খাওয়া মানুষ এবং ঐ সময় বিপদগ্রস্ত ।
তখন আমি শমরিতা হাসপাতালের পাশে একটা বাসায় ভাড়া থাকতাম । প্রতি শুক্রবারে জুমআর নামাজ পড়তাম পান্তপথ গ্রীণরোড মসজিদে । তেমনি একদিন নামাজ পড়ে বের হয়েছি, মসজিদের সামনে অনেকগুলা ভিক্ষুক থাকে এবং এটা নিয়মিতই, কোনটা আসল কোনটা নকল বুঝার উপায় নেই ওদের আচরণে প্রফেশনাল ভিক্ষুক মনে হয়, তাই এড়িয়ে চলি । সেদিন বেরিয়ে একটা লোককে ব্যতিক্রম দেখলাম । লোকটি খুব করুণ ভাবে উচ্ছস্বরে বলছে "ভাই আমার বাড়ী সিলেট আমার ভাই নিলক্ষেত চাকরী করে, আমার বাবা মারা গেছেন এবং সেই খবর নিয়ে ভাইর কাছে এসেছিলাম কিন্তু ভাইকে পাইনি আর পকেটমার আমার সব টাকা পয়সা নিয়া গেছে, আর আমার যত দ্রুত সম্ভব বাড়ী যাওয়া দরকার, আমাকে কিছু সাহায্য করুণ" ।
সিলেটের কথা শুনে তার কাছে গেলাম, কোন সওয়াবের আশায় নয়, নিজের এলাকার একটা লোক এভাবে মসজিদের সামনে দাড়িয়ে ভিক্ষা করছে, এটা দেখতে ভাল লাগছিলনা তাই লোকটিকে ডেকে বল্লাম আর ভিক্ষা করার দরকার নাই তুমি আমার সাথে এসো । সে আমার পিছু পিছু পান্থপথে এসে উটল । এবার তাকে বল্লাম চল আমার বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে চলে যাবে । সে বল্ল, আমার পক্ষে কিছুই খাওয়া সম্ভব না আমার যত দ্রুত সম্ভব বাড়ী যাওয়া দরকার । জিজ্ঞেস করলাম তোমার ভাড়া কত ? আমি যে বাসে যাই সেটার ভাড়া একটু বেশি, আমার ধারণা সে ঐটাতে যায়না । বল্ল আমার যেতে ১৬০ টাকা লাগবে । আমি তাকে ২০০ টাকা দিয়ে বল্লাম রাস্তায় কিছু খেয়ে নিয়ো, আর যেহেতু তোমার তাড়া আছে তাই চলে যাও । এই বলে তাকে বিদায় দিলাম ।
তার পরেও কিছুদিন তার কথা আমার মনেছিল, ভাবতাম মানুষের বিপদ কতভাবে আসতে পারে । তাপর ধীরে ধীরে ভুলে গেছি, আর এটা মনে রাখার মত কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও না । আমাদের মত যারা ব্যস্ত আইটি প্রফেশনাল তাদে মেমোরিতে প্রতিদিন কিছুনা কিছু লোড হয় আবার কিছুনা কিছু ফরমেট হয়, তাদের জন্য জীবনে দাগ না কাটা কোন ঘটনা মনে রাখা অস্বাভাবিক ।
আজ এতদিন পর তাকে দেখে আমার মেমোরিতে পূরোনো ফাইলগুলো ততক্ষণাৎ অপেন হয়ে গেল । তাকে চিনতে একটুও ভুল হলনা । এবার সে পরিপূর্ণ ভিক্ষুক তার পোষাক যেমন ভিক্ষুকের মত তার চাওয়ার ভঙ্গিটাও অভিজ্ঞ ভিক্ষুকের মত । আজ যখন সে আমার কাছে সিলেটের পরিচয় দিয়ে ভিক্ষা চাইল, আমি তাকে না দেখার ভান করে মসজিদে ঢুকে গেলাম । কিন্তু এবার সে আমার চিন্তা থেকে আর সরছেইনা ।
আমার মনের মধ্যে এখন একটা অপরাধবোধ কাজ করছে যে মানুষকে খুব সহজে সাহায্য করে ফেলাটা তার জন্য মঙ্গল নিয়ে আসেনা । ভিক্ষাবৃত্তি অন্য যে কোন পেশার থেকে সহজ, কিন্তু ঐ লোকের কাছে এটাকে আমি আরও সহজ করে দিয়েছিলাম । তার অসহায়ত্বে আমার সাহায্য তার মধ্যে এই বিশ্বাস প্রতিষ্টা করেছে যে মানুষের করুণা পাওয়াটা অনেক সহজ শুধু নিজেকে ঐ ভাবে উপস্থাপন করতে হয় ।
আমার অপরাধবোধ এখানেই যদি ঐ সময় তার হাতে দুই টাকা দিয়ে চলে যেতাম তাহলে তার কাছে ভিক্ষাটা এত সহজ হয়ে যেতনা । টিকই তার ভাড়ার টাকা মেনেজ হয়ে যেত, কিন্তু যেহেতু সে ভিক্ষুক ছিলনা তার জন্য অনেক কষ্ট হত । যখন থেকে ভিক্ষাটাকে তার কাছে সহজ মনে হল তখন থেকে এর চর্চা শুরু হল এবং আজ সে পরিপূর্ণ ভিক্ষুকে পরিণত হল ।
আমার কষ্টটা এখানেই যে সে চর্চাটা শুরু হয়েছিল আমার দেয়া ২০০ টাকা থেকে । তখন আমি এমন কিছু করতে পারিনি যাতে তার মধ্যে আত্মসম্মান বোধ জাগ্রত হয় ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০০৯ দুপুর ২:৫১