মেয়েদের নিয়ে ছেলেদের একটা কমপ্লেইন হলো তাদের বোঝা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। তাদের মানসিক দশা নাকি সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয় । আর তাদের বুঝতে পারা তাই রুবিকস কিউব সমাধাণ করার থেকেও কঠিন।
আজকে এই বিষয়েই একটু আলোকপাত করা যাক। আমাদের যাই শেখানো হয়ে থাকুক না কেন, আমাদের মানসিক অবস্থা কিন্তু কখনোই অপরিবর্তনীয় নয় , বরং তারা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। সকালবেলা হয়ত কেউ সুখি, সেদিনই দুপুরবেলা দুঃখী, সন্ধ্যায় আবার রাগান্বিত। এক মিনিট আগেই হয়ত আপনি কাউকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন আর এখনই তাকে পুরোপুরি ঘৃণা করছেন।
আমরা পুরুষেরা আমাদের লজিক ব্যবহার করে আমাদের আবেগকে প্রতিনিয়ত দমিয়ে রাখতে এবং সার্বিকভাবে আমাদের মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি, যা টিকে থাকার লড়াইয়ে অত্যন্ত জরুরী একটা গুণ। তবে সমস্যাটা অন্য জায়গায়। মেয়েরা আমাদের মতো তাদের আবেগকে দমিয়ে না রেখে বরং আবেগের সাথে গা ভাসিয়ে একটি মানসিক অবস্থা থেকে সম্পুর্ণ আরেকটি মানসিক অবস্থায় চলে যেতে সক্ষম। আর পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েরা তাদের এই বিশেষ গুণটি লুকিয়ে রাখতে রপ্ত করেছে, আর এটা এত সূক্ষ্ম যে, আমরা পুরুষেরা এটা প্রায় সময়ই বুঝতে পারিনা। বরং আমরা আমাদের যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে এর কোন সমাধান বের করতে ব্যর্থ হই এবং প্রচুর মানসিক এনার্জি নষ্ট করে থাকি যা মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
নারীর পৃথিবী মূলত বেশিরভাগ সময় প্রচন্ড আবেগীয় এবং একটি চেইনের মতো সে এক মানসিক অবস্থা থেকে অন্যটি আবার সেটি থেকে আরেকটি তে লাফ দিয়ে চলে যেতে অভ্যস্ত, যার ক্যালকুলাস কোনভাবেই যুক্তিনির্ভর নয়। এর জন্য নারীর শারীরিক গঠন ও তার কার্যপ্রক্রিয়াও খুব বড় ধরণের একটি কারণ ।
ঘুম থেকে উঠেই হয়ত একটা মেয়ের মন খুব ভালো কারণ জানালার বাইরে পাখিরা গান গাচ্ছে। আবার তার পাশের চেয়ারে রাখা লাল ড্রেসটি দেখেই তার মনে পড়ে গেলো তার বেস্ট ফ্রেন্ড গতকাল এটা দেখে বলেছে তাকে এই ড্রেসে মানায়নি। আবার হয়তোবা দোকানে গিয়ে সেটা চেঞ্জ করার সাথে সাথে তার পৃথিবী হয়ে উঠলো সুন্দর এবং ভরপুর। হয়তোবা ফোনে বয়ফ্রেন্ড এর সাথে কথা বলার সময় বয়ফ্রেন্ড কথার মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিলো, প্রচন্ড মন খারাপ করে মেয়েটি ভাবতে লাগলো তার বয়ফ্রেন্ড তাকে একদমই বুঝতে পারেনা। প্রচন্ড কান্না আসছে তাই সে আজ ভার্সিটি যাবে না।
একটা মেয়ে সম্পূর্ণভাবে একটি আবেগ থেকে অন্য আরেকটি আবেগে চলে যেতে পারে কোনরকম মানসিক দ্বন্দ্ব ছাড়াই, যদিও এই সকল আবেগের একটির সাথে অন্যটির যুক্তিগত কোনরকম কানেকশন নেই।
তাই মেয়েদেরকে বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু মন্ত্র মনের গভীরে ইন্সটল করে নেয়া খুব প্রয়োজন।
“একটি মেয়ে যাই বলুক না কেন, কোন একটি মুহুর্তের তাৎখনিক আবেগ নিয়ে সে সাধারণত কোনরকম অপরাধবোধে ভুগে না, যেমনটা পুরুষদের ক্ষেত্রে খুব বেশি হয়ে থাকে। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলেই পুরুষেরা অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়।”
হয়তোবা কোন একটা শপিং মলে গিয়ে আরেকটি লাল কালারের ড্রেস দেখেই তার মন খারাপ হয়ে গেলো, সাথে সাথে তার প্রত্যক্ষ পরিবেশে এই অনুভূতিটি সে স্থাপন করে দেবে। অর্থাৎ সেই মুহুর্তে তার বয়ফ্রেন্ড তার সাথে থাকলেও ছেলেটির ওপর মেয়েটির এই হটাৎ আবেগীয় পরিবর্তন কি প্রভাব ফেলতে পারে সে ব্যপারে মেয়েটি অপরাধবোধে না ভুগেই পুরো প্রক্রিয়াটি চলবে। তবে এতে আসলে রাগের কিছু নেই, এটাই স্বাভাবিক। রেগে গেলে কখনোই মেয়েদের সাথে মিলিমিশে থাকতে পারবেন না এটুকু মনে হয় আমরা সবাই এতদিনে জানি।
বড়জোর মেয়েটি বলতে পারে যে, “সরি, আমার খুব নার্ভাস লাগছে আর আমি একটু বিচলিত অথবা আমার মেজাজটা খারাপ।” তবে এর থেকে বেশি কিছু আশা করা বয়ফ্রেন্ডটির উচিৎ হবে না।
এবার আসি রুবিকস কিউবের সমাধানে। এ পর্যায়ে বয়ফ্রেন্ড তার নিজস্ব মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেললেই আরো বড় গেঞ্জাম/ঝামেলা অনিবার্য, যেটা পুরুষ-নারীর ছোটখাট বিষয় থেকে বড় ঝামেলাগুলোর সবথেকে বড় উদাহরণ। আর ঝামেলার কোন পর্যায়ে পুরুষ যদি যুক্তি ব্যবহার করতে চায় তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন এটা আরো বড় আকার ধারণ করবে, যেটা আমরা প্রতিনিয়তই করে থাকি।
নিজের ওপর থেকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রন হারাবেন না আর মেয়েটিকে সিরিয়াসলি নেবেন না। বরং আগুনে আরেকটু তেল ঢেলে দিয়ে দেখুন কি হয়। হটাৎ মেয়েটির এ ধরনের আচরণ করবার পেছনের লজিক খুজতে গেলেই বিপদ বেড়ে যাবে। আপনার পাগল হয়ে যাবার সম্ভাবনা তাতে প্রবল এবং লং টার্মে আপনাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তা মোটেই ভাল হবে না।
মেয়েটি – বিরক্ত হয়ে – “ ধ্যাৎ, এই লাল ড্রেসটা একদমই বাজে। আমাকে একদমই মানায় না।”
বয়ফ্রেন্ড- “আচ্ছা, অসুবিধা নেই, অন্য আরেকটা কিনে নিলেই হবে।”
ভুল। বয়ফ্রেন্ড তার পুরুষসুলভ যুক্তি ব্যবহার করে ধরে নিয়েছে যে আরেকটি নতুন জামা কিনলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বরং ঝামেলা সেখান থেকেই শুরু হবে।
এবার অন্যভাবে,
মেয়েটি – বিরক্ত হয়ে – “ ধ্যাৎ, এই লাল ড্রেসটা একদমই বাজে। আমাকে একদমই মানায় না।”
বয়ফ্রেন্ড- হাসিমুখে – “একদম ঠিক। চিন্তা করে দেখো, এটা পরে রাস্তায় বের হয়েছো আর একটা মহিষ তোমাকে ধাওয়া করছে।”
কোন সন্দেহ নেই মেয়েটির রাগ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাবে। আর বয়ফ্রেন্ড শান্ত ভাবে গরম আগুনে আরেকটু তেল ঢেলে দিলো। বয়ফ্রেন্ড – “বাপরে বাপ, এখনতো তোমাকেই একটা মহিষের থেকেও ভয়ানক মনে হচ্ছে।”
মেয়েটি – “তুমি একটা শয়তান।” বলতে বলতে নিজের অজান্তেই সে ঠান্ডা হয়ে যাবে।
বয়ফ্রেন্ড – হাসতে হাসতে “Exactly…….”
ছেলেটি একটাবারও তার নিজস্ব মানসিক স্থিতি না হারিয়ে অথবা রেগে না গিয়ে মেয়েটাকে তার ড্রেসটির সাথে যুক্ত প্রতিটা আবেগ অনুভব করতে দেয় এবং তার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে বরং মেয়েটার মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করে দেয়। আর মনে গভীরে মেয়েটা ঠিক এমন্টাই চায়। তার ঝামেলায় পড়ে নিজেরই মাথা খারাপ করে ফেলা একটা ছেলেকে তার সামলানোর কোন ইচ্ছা নেই। আবার নাটকীয়তা থেকে বাচার জন্য যে ছেলে তাকে সাথে সাথে আরেকটি নতুন ড্রেস কিনে দেয় তাকেও মেয়েরা ঠিক পছন্দ করে না।
আর এজন্য পুরুষদের মনোবিজ্ঞানী না হলেও কিছু কিছু ব্যপার বুঝতে পারাটা অবশ্যই কাজে লাগবে বলে আমি মনে করি, আর এটা করা সম্ভব একদম থিউরী মেনে।
১। একটি মেয়ের মানসিক অবস্থার হটাৎ পরিবর্তন একটি বিশেষ মুহূর্তে বুঝতে পারা এবং তার মানসিক স্থিতির কোন নিশ্চয়তা নেই সেটা স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারা।
২। এই পর্যায়ে যুক্তিনির্ভর যোগাযোগ না করে বরং ভাবোদ্দীপক ভাষার ব্যবহার করে তার সাথে কমিউনিকেট করা।
৩। সবশেষে মেয়েটার মানসিক অবস্থাকে তার অজান্তেই বিশেষ ভাবে পরিবর্তন করে দেওয়া, সাইকোলজি তে ভাষার ব্যবহার করে কাউকে ইনফ্লুয়েন্স করার যে বিজ্ঞান তা থেকেই উৎপত্তি হওয়া নিউরো-লিঙ্গুইস্টিক প্রোগ্রামিং অনুযায়ী মানুষ সচেতন ভাবে এবং অবচেতন ভাবে প্রতিনিয়ত একে অপরকে সম্মোহন করে যাচ্ছে, এটা আমাদের একদমই মৌলিক একটা গুণ। আর মানুষকে কোন কিছুর বিশদ বিবরণ দিয়ে খুব সহজেই তার আবেগীয় অবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি যে মেয়েরা উপর দিয়ে যাই বলুক না কেন প্রতিটা মেয়েই এই ধরণের আচরণে অত্যন্ত খুশি হবে কারণ তারা তাদের মানসিক অস্থিতিশীলতার জন্য কোনভাবেই দায় নিতে প্রস্তুত নয়। আর একটা ছেলে যখন নিজে শান্ত থেকে সুন্দরভাবে একটি মেয়ের আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে তাকে সাহায্য করে, মেয়েটা এটাই ধরে নেয় যে সে খুব আত্মবিশ্বাসী এবং একজন উপযুক্ত লিডার। একইসাথে সংবেদনশীল এবং মানসিক ভাবে শক্ত।
মেয়েরা পুরুষের ব্যক্তিত্বের দুটো গুণ প্রচন্ড পছন্দ করে। যার একটি হলো নারীসুলভ গুণ – একটি মেয়ের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারা এবং তাকে ইনফ্লুয়েন্স করতে পারা। অপর গুণটি হলো পুরুষসুলভ মানসিক দৃঢ়তার [নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে] সাথে একটি মেয়েকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারা। [আর মেয়েদেরকে একজন যোগ্য লিডারের মত পথ দেখাতে হলে নিজের জীবনে লিডারশিপ গুণাবলী সবার আগে দরকার। তবে আজকে সে বিষয়ে যাচ্ছি না। ]
পুরুষমাত্রই বুঝতে পারবেন এটুকু জ্ঞানের অভাবে কতরকম সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় আমাদের। আর এগুলো বুঝতে পারিনা বলেই আমরা পুরুষেরা মেয়েদের নিয়ে এত কমপ্লেইন করি। মেয়েদেরকে আরো ভালো করে বুঝবার জন্য তাই এদূটো গুণ ব্যক্তিত্বের অংশ হওয়া উচিৎ বলেই আমি মনে করি। একজন যোগ্য পুরুষের মত মানসিক স্থিতি আর একজন নারীর মত সংবেদনশীলতা। প্লেবয়দের মধ্যে যে দুটো গুণ বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায় ।
একটা রিয়েল লাইফ ফেসবুক এক্সপেরিয়েন্স দিয়ে বরং আজকের লেখাটা শেষ করা যাক। প্রায় বছর ছয়েক আগের কথা।
সে- “ইস, ফ্রেন্ডলিস্ট মাইয়া মানুষ দিয়া ভরপুর।”
আমি- ব্লেইম দিলা মনে হয়?
সে- “নাহ । হাম আপকে হে কউন। আমি ব্লেইম দেয়ার কে? চোখে যা দেখলাম তাই বললাম। এইগুলাকে বলে হাসা কথা।”
আমি – “কি বলবো মাথায় আসছে না। শুধু এটুকু বলতে পারি যে, তেমন কেউ কমসেকম ফ্রেন্ডলিস্ট এ নেই, আমি মেয়েদের সাথে তেমন একটা মিশিও না” [ পুরুষসুলভ লজিকের ব্যর্থ ব্যবহারের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ]
সে- “হুমমমম, সেটাই। সত্য কথা বললে মানুষ মাঝে মাঝে চুপ খেয়ে যায়।”
এবং সেখান থেকে ধীরে ধীরে কেমিস্ট্রি অবিশ্যম্ভাব্য ভাবেই নষ্ট হয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে এই সম্পর্কটি একটি বিশেষ রুপ পেয়েছিল কিন্তু আমার মনে হয় সেদিনের সেই কথোপকথনটা অন্যরকমও হতে পারতো।
যাই হোক, মাঝে মাঝে ভাবি কবে সেদিন আসবে যেদিন "সম্পর্ক বিজ্ঞান" নামে একটা আলাদা বই তুলে দেয়া হবে সবার হাতে। আবার চিন্তা করি যে ক্লাস ফাইভ সিক্স অথবা ইন্টামিডিয়েটেই যদি আমাকে কিছু সাইকোলজির বই ধরিয়ে দেয়া হতো তাহলে হয়ত অনেককিছুই অন্যরকম হতে পারতো, এই কথোপকোথনটাও নিশ্চিত অন্যরকম হতো। তবে সেক্ষেত্রে হয়ত আরো অনেক বড় কিছু ব্যপার মিস করে ফেলতাম। দিনশেষে আপনাকে বুঝতে হবে যে আপনার জীবনের প্রায় প্রতিটা ভুলই কোন না কোন ভাবে আপনাকে ভাল কিছু দিয়ে যাবার জন্যই করা।
https://www.facebook.com/DoctorXBD
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৪ সকাল ১১:৩০