somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে ফুল অংকুরেই ঝড়ে যায়

০৩ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ৯:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার নাম রেণু।
মা রেখেছিল নামটা। আমার মায়ের নাম ছিল পুস্প। মা জবা ফুল অনেক পছন্দ করত, বৃষ্টিভেজা লাল জবা। টুকটুকে লাল পাপড়িতে ফোটায় ফোটায় পানি, ডগায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য রেণু। মা বলত সেই অসংখ্য রেণু থেকে বাবা নাকি একটাকে আলতো করে তুলে এনে মার কোলে দিয়েছে। নানু বাড়িতে মা একটা জবা ফুলের গাছ লাগিয়েছিল। মা যে ঘরে থাকতো ঠিক তার জানালার পাশে। মা যেদিন না ফেরার দেশে চলে যায় সেদিন আমরা নানু বাড়ীতে, জবা গাছে অনেক ফুল ফুটেছিল। বৃষ্টি ছিলনা। ছোট্ট রেণুর চোখের লোনা জলেই জবার স্নান হয়ে যাবে, হয়ত তাই। আমি একটা রক্তজবা ছিড়ে এনে মার মাথার পাশে রেখেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল মা মৃদু হেসে আমাকে বলছে - আমি চলে যাচ্ছি রে মা, এই রেণু থেকেই আরেক জবার আগমন হবে আর তার মাঝেই আমি বেচে থাকবো।

বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসে। আদর করে ডাকে 'রেণুমা'। মা মারা যাওয়ার পর আমার কথা চিন্তা করেই বাবা আর বিয়ে করে নি। আমি এখন বাবা, দাদু, দাদাভাইয়ের সাথে থাকি।


পেটের ব্যাথাটা আজ আবার বেড়েছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে জীবনের সংখ্যারেখার বামে ডানে বার বার ঘুরপাক খাচ্ছি। আমার বিছানার পাশের দেয়ালে মার সাথে আমার একটা ছবি টাঙ্গানো আছে। আমার বয়স তখন ৮ মাস। একদম রক্তজবার মতই লাল টুকটুকে গাল। আমি ঠোট বারান্দা বানিয়ে আহ্লাদ করে কাঁদছি। মা চুমু দিচ্ছে আমার গালে। মার ঠোট দুটো ছিল একদম ধনুকের মত, যেনো শিল্পির তুলিতে আঁকা কোনো ছবি। ফুলের ঠোট দুটোও হয়েছে ঠিক মার মতই। বাকি সবকিছু সজীবের মত।

ফুল, আমার মেয়ে। এখনও বছর পড়েনি। ভেংগে ভেংগে বাববা, বুববু বলে। সেদিন সকালে, সজীব কেবলি অফিসে চলে গেছে। ফুল সেদিন প্রথম বাববা বলেছে। সজীবকে ফোন করে বলার সাথে সাথেই দৌড়ে বাসায় চলে এসেছে। সারাদিন সজীব বাসায় থাকলো মেয়ের মুখে বাববা শুনবে কিন্তু মেয়ে কিছুতেই আর বাববা বলেনা। আমি জানি এই অনুভুতিটা কেমন। দুই মাস বয়স থেকে মাম বলে। কেন বলে, কাকে বলে জানিনা। আমি মনে মনে মা'কেই ডাকছে কল্পনা করে পুলকিত হই। এ যেনো অন্য রকম একটা জীবন। যে অনুভুতি মা না হয়ে অনুভব করা যায়না। কত রাত জাগি, মেয়ে ঘুমায় না, হাত ধরে থাকে, হাঁসে, কাঁদে। সজীব নাক ডেকে ঘুমায়। মাঝে মাঝে জাগাই, মেয়ের সাথে খেলে। একটা নিশ্পাপ আত্বা, একটা নিষ্পাপ অস্তিত্ব, যেন ভালবাসার মানুষকে উপহার দেয়া এইমাত্র কলি থেকে ফুটতে থাকা লাল গোলাপ - কিছু পাপড়ি এখনও পুরোপুরি ফোটেনি। যার দিকে একবার তাকিয়ে একশ বছর বেচে থাকার প্রতিজ্ঞা করা যায়। সে আমার মেয়ে - ফুল।

পেটের নিচটা হঠাত মোচড় দিয়ে ওঠে। ছবিটার দিকে আবার তাকাই। মাকে খুব মিস করি। আমার অনুভুতিগুলো শেয়ার করার কাউকে পাইনা। বাবার সাথে আমার দুরত্ব অনেক বেশী। সজীবের সাথেও একটা সময় অনেক দুরত্ব ছিল। প্রথম যেদিন ওকে দেখেছিলাম সেদিন লজ্জায় কিছু বলিনি, ও আমার নাম জিজ্ঞাসা করেছিল। ওর ব্যাক্তিত্ব আমাকে আকর্ষণ করেছিল। সুদর্শন কোনো যুবক যে তা নয়, তবু কেনো যেনো ওর হাসিটা আমার হৃদয় কাপিয়ে দিত। ওর চাহনিতে আমার লজ্বায় মাথা নিচু হয়ে যেতো। ও কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিতে পারতাম না। শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

আমাদের কলেজে দুইটা কৃষ্ণচুড়া গাছ ছিল। গাছের নিচে বসার জন্য মাচা করা ছিল। সেখানে বসে সজীব আমাকে বলেছেল, "তুমি কি আমাকে ভালোবাস"? আমি উত্তরে শুধু বলেছিলাম জানিনা। সেদিন থেকে দুরত্বটা ধিরে ধিরে কমতে শুরু করল। ধিরে ধিরে একদিন আমি সজীবের স্পর্শ অনুভব করলাম। আমার শরীর পুলকিত হলো, কৃষ্ণচুড়ার ডালে যেনো দখিনা হাওয়া মৃদু দোলা দিয়ে গেলো। আমি তো এই অনুভুতির জন্য সজীবকে কাছে পেতে চাইনি কখনও, কখনও তো মুখ ফুটে বলিনি। তবু কেনো যেন এই স্পর্শ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেও ভাল লাগত। কেনো যেন দুরত্বটা আরো কমিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বলতে পারিনা। আবার সজীব বললেও আমি হ্যা বলতে পারিনা। কিন্তু চাই সজীব আমার আরো কাছে আসার চেষ্টা করুক, আরো কাছে আসুক।

সজীবের চাহিদাটা দিন দিন যেন বাড়তে থাকে, আমার সংকোচ ও যেন কমতে থাকে। আমি একটা চুমু দেই সজীবকে। মা যেভাবে আমাকে চুমু দিয়েছিল সেভাবে নয়। অনেক বেশী বাসনা ছিল তাতে। আমার শরীরে যেন একটা ঝড় বয়ে গিয়েছিল সেদিন, এমন ঝড় যার একটা দমকাতেই কৃষ্ণচুড়ার ফুলে মাটিতে লাল গালিচা হয়ে যেতো। আমি কল্পনায় হারিয়ে গিয়েছিলাম তখন। যেন সত্যি সত্যি নিভৃত নির্জনে কোথাও আমরা দুজনে। সম্বিত ফিরে পাওয়ার পর দেখলাম সজিবের চোখে যেন আগুন জ্বলছে। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনের লাভা যেনো আমাকে এখনই পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। লজ্বায় চুপচাপ শুধু তাকিয়ে ছিলাম। একদিন সত্যি সত্যি হারিয়ে গেলাম। সেদিন আবার সজীবের চোখে সেই আগুন জ্বলেছিল। সেই আগুনে আমি আজ পুড়ে অঙ্গার।

টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার। ফোন বাজছে। সজীব ফোন করেছে। ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না। রিংটোনের তালে তালে আবার ফুলের কাছে চলে যাই। আজ থেকে এক বছর পর। কি হতে পারে! আমার একটা মেয়ে - যার নাম ফুল। ঠোটদুটো ঠিক মা'র মত। আমাকে মাম বলে ডাকবে। নরম তুলতুলে হাতে আমার হাত ধরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, হাঁসবে, কাঁদবে, খেলবে। যাকে বুকে জড়িয়ে আমি শত বছরের কল্পনায় হারিয়ে যাবো প্রতিদিন। তখন যদি সজীব আমাকে বলে তোমার মেয়েকে গলাটিপে হত্যা করো, আমি কি পারবো? অবশ্যই না। তাহলে কি করব? জানিনা, হায়ত হারিয়ে যাবো।

আর পারছিনা। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে আজ। আত্তহাত্যা করতে ইচ্ছে করছে, সাহস পাচ্ছিনা। আজ মনে হচ্ছে জীবনের কিছু চাহিদা পুষে রাখতে হয়। জীবন মানে শুধু উপভোগ করা নয়, উপভোগ করার চাহিদাটা ধরে রাখা।

ফোন বেজেই যাচ্ছে। হসপিটালে যাওয়ার কথা। এবরশন করার জন্য। পেটের ব্যাথাটা আজ খুব বেড়েছে। আমার ভিতরে জন্ম নেয়া আমিটা যেন বুঝতে পেরেছে আজ আমি তাকে হত্যা করতে যাচ্ছি।

বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছেনা। মনের সাথে আবারো যুদ্ধ করি। যুদ্ধে হেরে যাই বারংবার। মাকে মনে পড়ে ভিশন। কারো সাথে শেয়ার করতে পারছিনা। আস্তে আস্তে উঠে দাড়াই। যে ফুলটা অংকুরেই ঝড়ে পড়বে তার কথা মনে হয় আবার। ছবিটার দিকে ঘুড়ে তাকই। আমি আহ্লাদ করে কাদছি, মা চুমু দিচ্ছে আমাকে। মনে মনে বলি "মা, তোমার ফুলকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি মা, আমাকে ক্ষমা করে দিও"।


সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৪ সকাল ৭:৩০
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×