somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি নির্জন গলি অথবা ফিরে আসার গল্প

০১ লা মার্চ, ২০১২ রাত ৮:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই মুহুর্তে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছি আমি! যদিও জানি না এই অবস্থার জন্য বিব্রত বোধ করা উচিৎ কিনা! কিন্তু বাবার সাথে আমার সম্পর্কটাই এমন যে , বাবা সামনে আসলেই আমি খুব অস্থির হয়ে যাই , বুঝতে পারি না কি করা উচিৎ। খুব সম্ভবত ছোটবেলা থেকেই একটা সহজ সম্পর্ক না থাকায় এ অবস্থা হয়েছে । আমি দাঁড়িয়ে আছি আমাদের গলিটার সামনে , হাতে ধরা একটা সবুজ আইস্ক্রীম। আইস্ক্রীম খাওয়া কোন অপরাধ নয় , সদ্য ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া কোন তরুণ গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আইস্ক্রীম খেতে পারবে না , এমন কোন আইন নিশ্চই নেই! কিন্তু যখন গলির সামনে বাবাকে দেখলাম , তখন বুঝলাম তিনি আমার উপর বিরক্ত হয়েছেন। অবশ্য বাবা কিছু বললেন না, আমার কাছাকাছি এসে কেমন যেন একটা ঘোঁত জাতীয় শব্দ করে চলে গেলেন। হাঁপ ছেড়ে বাচলাম আমি! সারোয়ার আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, "চাচাজান কে দেখলে আমার কলিজায় পানি থাকে না! কি কঠিন মানুষরে বাবা! " বলেই আমার দিকে তাকাল। আমি মনে মনে ভাবলাম আমার নিজের বাবা, আমারই এমন লাগে, আর তোর তো লাগবেই ! মুখে অবশ্য বললাম , "গাধা তুই আইস্ক্রীম ফেলে দিলি কেন? আমরা কি সিগারেট খাচ্ছিলাম নাকি? " , বাবাকে দেখেই সারোয়ার আইস্ক্রীম ফেলে দিয়েছিলো! ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম ছয় মাস ও হয়নি , কিন্তু এর মাঝেই নানান ঝামেলা। দেশের যা অবস্থা , কি যে হয়। ইদানিং ক্লাশ হচ্ছে না ঠিকমত। সন্ধ্যার পর আকাশ কাঁপিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মশাল মিছিল আর নানা রকম মিটিং -আলোচনাতেই সবাই ব্যস্ত। চারদিকে চাপা অস্থিরতা । আমার কিছু ভালো লাগে না, আমি আর সারোয়ার উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই।

মনিরার সাথে দেখা হয় না বেশ কিছুদিন। ও এখন নিয়মিত ভার্সিটিতে আসে না, ওর বাসা থেকে আসতে দেয় না। প্রতিদিন ওর বাসায় যাবো তাও সম্ভব না। ওদের বাসায় গেলেই ভেতরের রুম থেকে ওর বুড়ো দাদী চেঁচিয়ে বলে , "এত পোলা বন্ধু আসে ক্যান ঘরে? কিয়ের এত বন্ধু?" আমার লজ্জা লাগে।কিন্তু মনিরার কোন বিকার নেই। এই যে এক সপ্তাহ ধরে ওর সাথে দেখা নেই , এখন ওর বাসায় গেলে নিশ্চই আমার গুষ্টী উদ্ধার করবে। কিন্তু ওকে আমি কিভাবে বুঝাই যে , মাত্র দুই মিনিটের হাঁটা রাস্তা পার হয়ে পাশের গলিতে ওর বাসায় যাই না শুধু মাত্র লজ্জায়! নাহলে, ওকে না দেখলে আমার ও যে অস্থির লাগে তা তো আর ও জানে না! দুপুরে খেয়ে শুয়ে ছিলাম , এমন সময় হাফিজ ডাকতে এলো। "শুভ চল, মিটিং আছে। " বাবা এখন সামনের বারান্দায় বসে আছেন। কিন্তু না যেয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। বের হওয়ার সময় টের পেলাম বাবা চশমার ফাঁক দিয়ে সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! সামনের মাঠটায় কাদের ভাইসহ এলাকার প্রায় সব ছেলেপুলে বসে আছে এক কোনায়। " পাকিস্তানিদের লক্ষন ভালো না। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না আমরা। স্বাধীন হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। " , কথাটা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন কাদের ভাই। স্বাধীন বাংলাদেশ, কথাটা শুনতেই কেমন যেন আগুনের ছোঁয়া লাগে শরীরে ! সত্যিই স্বাধীন হবো আমরা?

সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষন আগে মনিরার বাসায় গেলাম। না সামনের দরজায় না। পিছনের দিকের গলিতে , যেখানে মনিরার রুম আছে। আমি জানি ও এই সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। এই বদ্ধ গলিটায় কি দেখে জানতে চেয়েছিলাম একদিন। " বদ্ধ জীবনের ভেতরই তো মানুষ মুক্তি খোঁজে" , শান্তভাবে জবাব দিয়েছিলো ও। আমি আর কিছু বলি নি। মনিরা জানালার পাশেই ছিলো। আমাকে দেখে মুচকি হাসলো। " আমাকে তাহলে ভুলে যাও নি!", স্বগোতক্তি ওর! অপরাধীর মতন চোখ নিচু করলাম আমি। "হাতে মেহেদী লাগিয়েছি, দেখবে? " বলেই হাতটা মেলে ধরল ও। মেহেদী দেখার আগেই আমার চোখে পড়ল ওর হাতে সবুজ চুড়ি। এর মাঝে মেহেদীর অদ্ভুত খয়েরী , প্রায় লাল রঙ! খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর হাতটা একটু ধরে বলি, " তুমি এত ভালো কেন বলতো ? "! হলো না। কেউ আসছে এদিকে। তাড়াতাড়ি সরে গেলাম।

মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙ্গে গিয়েছিলো প্রচন্ড শব্দে। শব্দটা যে গুলির তা বুঝতে আমার কিছুক্ষন লাগল। ওরা তাহলে আমাদের খুন করার জন্য রাস্তায় নেমেছে? বাবা গম্ভীর মুখে সামনের রুমে বসে আছেন। লাইট নেভানো। "ওরা আমাদের মানুষ ভাবে না, কুকুর ভাবে। ওরা আমাদের এভাবে মেরে ফেলার জন্য আর্মি নামিয়েছে?", অন্ধকারে বাবার মুখটা না দেখলেও প্রচন্ড ক্রোধটা টের পেলাম।

মনিরার রুমের ওই জানালাটা এখন বন্ধ। আমি আজ সামনের দরজা দিয়েই ওদের বাসায় ঢুকলাম। কিছুক্ষন পরেই মনিরা এলো। " মনিরা আমি যুদ্ধে যাচ্ছি", এটা ছাড়া আর কিছু বলার মত খুঁজে পে্লাম না আমি। মনিরা কিছু বলল না। কাঁদল ও না। শুধু দেখলাম শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে ও। "মনিরা আমি ফিরে আসবো । অবশ্যই ফিরে আসবো। " বলেই মৃদু হাসলাম আমি। বের হয়ে আসার পর খেয়াল হলো, আজ মনিরার দাদী চিৎকার করেন নি!

আবারো বিব্রত অবস্থায় আমি। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। "কিছু বলতে চাইলো বলো", গম্ভীর ভরাট গলা শুনতে পেলাম। মরিয়া হয়ে সরাসরি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, "বাবা আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। আজ রাতেই চলে যাচ্ছি"।বাবা সরাসরি তাকালে আমার দিকে। "কোন বাবাই তার ছেলে মেয়েকে কখনো বলেন না যে তিনি তার সন্তানকে কতখানি পছন্দ করেন, ভালোবাসেন। কিন্তু আজ আমি তোমাকে বলি, তোমাকে আমি অসম্ভব পছন্দ করি। আমার গর্ব হয় তোমার মত একটা ছেলে আমার আছে" বাবার কথাগুলো শুনে আমার হতভম্ভ ভাব কাটার আগেই বাবা আবার বললেন,"মেয়েটা কি জানে এই এই কথা?" এই প্রথম বাবার মুখে এত নরম স্বরে কথা শুনলাম আমি! বাবা মনিরার কথা জানে!আমি কোনমতে মাথা নাড়লাম।

খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছে আমাদের দলটা। জয়পুর ক্যাম্প আক্রমন করতে এসে যে এভাবে দুই সাইড থেকে পাকিস্তানিরা আমাদের আক্রমন করবে তা আরা ভাবি নি। আর কিছুক্ষন এভাবে চললে সবাই নির্ঘাৎ মারা পড়ব। মেশিনগানটা ধরে রেখেই সারোয়ারকে বললাম, " তোরা পিছু হটতে শুর কর। যত দ্রুত পারিস সরে যা। কোন কথা না। আমি কমান্ডার। আমার অর্ডার এটা" , সারোয়ার কি যেন বলতে গিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো। হয়ত মাস চারেকের না কাটা চুল দাঁড়ির মাঝে আমার চোখটা খুব বেশি কঠিন দেখাচ্ছে। ওরা সরে যেতেই আমি আরো শক্ত করে ট্রিগারটা চেপে ধরলাম। গুলিটা এসে যখন আমার বা পাশের তলপেটে লাগল ততক্ষনে পুরো দলটা বেশ খানিকটা সরে গিয়েছে। ট্রিগারটা আবারো চেপে ধরলাম। কেমন যেন ঝাপসা লাগছে চারপাশ। মনিরার হাতের সবুজ চুড়ী গুলোর কথা মনে পড়ছে ভীষন। ফিরে যাওয়া...হ্যাঁ আমার ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো....নিশ্চই যাবো , আমার দেশের স্বাধীনতা মানে তো আমারই ফিরে আসা। সবুজ চুড়ী ..মেহেদী লাগানো হাত....বাকি সব ঝপসা...
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ ভোর ৬:৫৫
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×