হৃদির খুব টেনসন হচ্ছে। বাসা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে । পালানোর
কোন ইচ্ছে ছিল না । শুধুই আগ বাড়িয়ে ঝামেলা করা। কিন্তু
পরিস্থিতি পালিয়ে যেতে বাধ্য করলো । তপুর সাথে সম্পর্কটা বাসা থেকে মেনে নিবে না । ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে জোর
করে আরেকজনের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে । এটা কেমন
কথা । তাই এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া । ব্যাগ আগেই গুছিয়ে উর্মীর বাসায় রেখেছিল । কখন পালাবে সেটা নিয়ে দ্বিধায় ছিল ।
রাতে পালানো যেত, তবে বাসায় তখন মানুষ থাকবে । রিস্ক বেশি হয়ে যায় । তাই খুব সকালে বেরিয়ে পড়লো । কারও
ঘুম ভাঙ্গার আগেই । বাসা থেকে বের হয়েছি এটা তপুকে জানানো দরকার । হাঁদারামটা নিশ্চয়ই এখনো ঘুমোচ্ছে ।
আলসেমীর চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত তপু । কি করে যে এমন বোকা আর কেয়ারলেস ছেলের প্রেমে পড়লো, সে ভেবে পায়
না ।
- হ্যালো
- উহ্ কে? তপু ঘুমঘুম মুখে বললো।
- " তুমি এখনো ঘুম থেকে উঠোনি?"
রাগান্বিত কন্ঠে হৃদি বললো।
- কে কে? আরে নাহ এই
যে আমি উঠে গেছি। রাস্তায় আছি।
- তোমার এই একই মিথ্যা আর কতদিন
বলবা?
তপু জিভ কাটলো। আজকের মতো একটা দিনেও বেহুশোর মতো ঘুমিয়েছে। গতরাতে বিয়ে নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করলো । কিছুতে সমস্যার সমাধান খুঁজে পেল না । আজও উঠতে দেরি হয়ে গেল। অবশ্য ওর সবসময়ই এমন দেরি হয়। এটা নতুন কিছু না।
- কোথায় আসবো... বাসস্টপ?
- বাসস্টপ কেন? আগে কাজি অফিসের
সামনে আসো। বিয়ে না করে তোমার
সাথে যাবো না।
- এখন কাজি অফিসে?
- হ্যা, কোন সমস্যা?
- না..মানে সাক্ষীর একটা বিষয় আছে তো।
যোগাড় করতে হবে না?
- আমি উর্মী আর জয়া কে বলছি।
তুমি মাহিন আর সাব্বির কে আসতে বলো।
- আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আসছি।
কাজী অফিসে চেয়ারে বসে আছে হৃদি। যার সাথে বিয়ে হবার
কথা সে এখনো পৌঁছোয় নি। স্টুডেন্টের বাসায় নাকি যাবে। মাসের বেতনটা আনার জন্য। হৃদির ভালো লাগছে না। কেমন অস্বস্তি লাগছে। হার্ট বিট বেড়ে গেছে। আগে কখনো এমন পরিস্থিতির সামনে এসে পড়েনি । তাই একটু ঘাবড়েও
গেছে। অস্বস্তির আরেকটি কারন শাড়ি । কি মনে করে যে আজ
শাড়ি পরে আসলো । মাহিন দেখেই ফোঁড়ান কেটে বললেন,
"একেবারে বউ সেজে এসেছিস দেখি। ভালোই হলো আসল বিয়ের ফ্লেভারটা একটু পাবি" তার খুব লজ্জা পাচ্ছিল । শাড়ি পরার বিশেষ কারন আছে । যদি আজ তপুর বাসায়
সরাসরি যাওয়া হয়, তবে শাড়িই সবচে উপযুক্ত পোষাক। নতুন বউ শাড়ি ছাড়া বেমানান লাগে । কিন্তু এই শাড়িই শেষমেষ কাল হয়ে দাঁড়ালো । একে তো ঠিকঠাক
গোছগাছ রাখা কঠিন, অপরদিকে সে আবার আনাড়ি ।
তপু জোরে জোরে হাটছে ।
হাটছে না বলে দৌড়োচ্ছ বললেও ভুল হবে না ।
হৃদি যে এমন পাগলামী করবে তা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ।
মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিলো ইউনিভার্সিটিতে । বন্ধুদের
সাথে আড্ডায় মেতেছিলো । তখনই
ভালো লেগেছিল। পরে জানলো সে তাদের ডিপার্টমেন্টেই ।
অতপর ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব, পরে প্রনয় । এইসব
পাগলামীর জন্যই ভালো লেগেছিল । কখন যে তা প্রেম-ভালবাসায় রূপ নিলো, কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। প্রচন্ড
রোদ । ঘামে ভিজে একাকার । বিয়ে করে সে উঠবে কোথায় । একজন বেকার ছেলে। যার নিজের কোন ঠিক-
ঠিকানা নেই। নিজের দায়িত্বই পুরোপুরি নিতে পারেনি।
সে কি করে আর একজনের দায়িত্ব নেবে। বাসায় উঠবে? বাসার
কথা মনে আসতেই বাবার চেহারা ফুটে উঠলো । সেই
রাগী চেহারা মানুষটির সাথে কখনোই ফ্রী ছিল না । সকল চাওয়া-
পাওয়া মায়ের মাধ্যমে বাবার কাছে গিয়েছে । বাবা অবসরপ্রাপ্ত
সেনা কর্মকর্তা । জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ম-
শৃঙ্খলা মেনে চলেছেন । আর তার ছেলেই কিনা এই কাজ করছে!
সমাজে মাথা কেটে দিলো। মা আর তনু মেনে নিলেও । কিন্তু বাবা..! কখনোই মেনে নিবেন না। হয়তো ঘরেই ঢুকতে দিবেন
না। তখন কি হবে? নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল । সময়
যতো গড়াচ্ছে চিন্তাগুলো জট
পাকিয়ে যাচ্ছে । আর সমাধানের পথ সরু থেকে সরুতর ।
স্টুডেন্টের বাসয় এসে পরেছে । তপু দ্রুত
বাসায় ঢুকে গেল ।
তপু আর হৃদি কাজী অফিসে । একটু আগে তপু ফিরেছে। কাজী সাহেব রেজিস্ট্রি খাতাটা হৃদির দিকে এগিয়ে দিলেন । হৃদি স্বাক্ষর
করতে গিয়ে থমকে গেল । সে ঠিক করছে তো?
প্রশ্নটা আচমকা মাথায় চলে আসলো । বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-বন্ধু সবাইকে ছেড়ে থাকতে হবে । সে পারবে তো?
নাকি এটি ভুল সিদ্ধান্ত । হুটহাট করে আবেগী সিদ্ধান্ত?
বাবার শরীর ভালো না। হৃদির
এভাবে পালিয়ে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিবেন না । অনেক কষ্ট পাবেন । কিন্তু প্রকাশ করবেন না।
নীরবে কেঁদে যাবেন। হৃদি পৃথিবীর সবার কষ্ট সহ্য করতে পারবে । তবে বাবার কষ্ট সহ্য করতে পারে না । পৃথিবীর কোন
মেয়েই তার বাবাকে কষ্ট দিতে পারে না। সেই মানুষটিকে কাঁদিয়ে সে আদৌ কি সুখি হতে পারবে? প্রশ্নগুলো কঠিন বাস্তবতার
সামনে এনে ফেলে । এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে । পিছনে ফিরে যাওয়া সম্ভব না । এই পরিণতিই মেনে নিতে হবে। হৃদির চোঁখ
পানিতে ভিজে আসছে । নিজেকে অন্ধকার ঘরে একা একা লাগছে। সে হাতে আরেকটি হাতের স্পর্শ পেল । তপু
তার হাত ধরে আছে । সবকিছু মুখে বলতে হয় না । কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।
হৃদি তপুর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।
মানুষটি তাকে বড্ড ভালবাসে!
কুমিল্লার উদ্দেশ্যে বাস ছুটছে । তপুর বাসায়
যাচ্ছে। হৃদি নতুন বউদের মতো ঘোমটা দিয়েছে । জানালার
পাশে বসায় চুল আর ঠিক থাকছে না । বাতাসে অবাধ্য
স্বাধীনতা পেয়ে উড়ছে । তপু অনেকক্ষন
ধরে চুপচাপ আছে । বাসায় কিভাবে নিয়ে উঠবে তাই হয়তো ভাবছে । হৃদি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ।
ভেতরে অস্থিরতা এখন আর নেই । কিছুই ঠিক নেই, তবুও সবকিছু ঠিকঠাক লাগছে । এরকম
কেন মনে হচ্ছে? তপু পাশে আছে, একারনেই?
হয়তো । কিছু মানুষ থাকে, যাদের সান্নিধ্যে থাকলে জগতের সকল বাঁধা-বিপত্তি অতি তুচ্ছ মনে হয় । তপুর সাথে সেই
নিশ্চয়তা আছে, তপুর সাথে নির্ভরতা আছে ।
ভবিষ্যতে কি হবে হৃদি জানে না । সে বর্তমানটা জানে । বর্তমানের
মুহূর্তটা সুন্দর । বাকি সারাটি জীবন মানুষটির
হাতে হাত রেখে, কাধে মাথা রেখে কাটিয়ে দেবার মতোই
সুন্দর । হৃদি তপুর কাঁধে মাথা রাখলো ।
চোঁখদুটি বন্ধ করলো । অদ্ভুত প্রশান্তি আছে ।
হ্যাঁ, এখানেই তার ঠিকানা । এখানেই সব
ভালবাসা ।