টিএসসির সড়কদ্বীপ থেকে রাস্তা পার হয়ে হাকিম চত্বরের দিকে যাচ্ছিল জ্যোতি। আনমনে গান গাইতে গাইতে বেশ আয়েশি ভঙ্গীতেই হাঁটছিল। সকাল থেকে কেবল একটা গানই মাথায় ঘুরছে। স্বাপ্নিকের নতুন গানটা। রাস্তা প্রায় পেরিয়ে গেছে তখনি রিক্সার হর্ন গান থেকে বাস্তবে নিয়ে এলো ওকে। বায়ে তাকিয়েই দেখল,বিপুল বেগে ওর দিকে একটা রিকশা ধেয়ে আসছে। জ্যোতির ভাগ্যটা খারাপই বলতে হবে। বেচারা চলন্ত গতিকে কাজে লাগিয়ে চকিতে ডানে সরে পড়ল কিন্তু রিকশাওয়ালার রিফ্লেক্সও সেই দিকেই কাজ করল। শেষ মুহূর্তে ও লাফ দিয়ে সংঘর্ষ এড়াবার চেষ্টা করল। রিকশাওয়ালাও হার্ডব্রেক কষল। কিন্তু রিকশার বাঁ পাশের অংশবিশেষ ওকে একটু স্পর্শ না করে থামল না। এদিকে রিকশার আরোহী তরুণী আকস্মিকতায় তাল সামলাতে না পেরে হতভম্ব হয়ে আর্তচিৎকার করে ওর পাশেই পড়ে গেল।
তরুণীর পতন ওর ব্যাথা কে ভুলিয়ে দিল বরং বেচারির শুভ কামনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রিকশাওয়ালার চোদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করবার প্রচণ্ড ইচ্ছেকে চেপে রেখে জ্যোতি হাঁটু গেঁড়ে বসে তাকে তুলে ধরল। এদিকে তরুণীর শুভাকাঙ্ক্ষী ভক্তবৃন্দের একটা বেশ বড় দলের প্রতিষ্ঠা লাভের দৃপ্ত ইচ্ছা জ্যোতি লুপ্ত করে দিল ভরাট কণ্ঠের আহবানে।
আহা,বেচারি লজ্জায় লাল হয়ে রিকশায় উঠে চলে যাবার ইচ্ছা পোষণ করতেই জ্যোতি দেখল রক্তাভ মুখমন্ডলের সাথে মৈত্রী স্থাপনের সংকল্প নিয়ে কনুইয়ের খানিকটা নিচে রক্তের উঁকিঝুঁকি।
জ্যোতিঃ 'আরে আপনার তো ভালই লেগেছে। দাঁড়ান এক মিনিট।'
বলে ওর মানিব্যাগ খুলে উত্তেজনা চাপা দিয়ে খুঁজে দেখল। ব্যান্ডএইড পেতেই ঈশ্বরের প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সে। এবার পরম মমতায় তরুণীর আহত স্থানে লাগিয়ে দিল সে। বলল,
জ্যোতিঃ 'সাবধানে থাকবেন,আমার জন্যই আপনাকে আঘাত পেতে হল। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিবেন।'
তরুণীঃ 'ছিঃ ছিঃ,কি বলছেন। আপনার কোন দোষ নেই। এটা স্রেফ একটা দুর্ঘটনা। আপনাকে ধন্যবাদ।'
জ্যোতি রিকশাওয়ালাকে কিঞ্চিৎ উপদেশ বর্ষণ করতে করতেই রিকশা চলতে শুরু করল।জ্যোতির মনে হল যেন হাজার বছরের বন্ধন টুঁটিয়ে ওকে ছেড়ে কেউ চলে যাচ্ছে। ওর প্রচণ্ড ইচ্ছে হল দৌড়ে গিয়ে রিকশাটি থামিয়ে তরুণীকে থেকে যেতে বলে। অন্তত নামটি জানা আর পারলে ফোন নাম্বারটি। কিন্তু শত বছরের পরম্পরাগত ঐতিহ্যবাহী অব্যক্ত রাজকীয়তা ওকে নিবৃত্ত করল। তবু পেছন থেকে নির্লিপ্ত থেকেই নিজেকে ওর কেন যেন ভীষণ সুপুরুষ মনে হল।
দুদিন পর,না ওদের আর দেখা হয়নি। মুগ্ধতা নিয়ে দুটি দিন কেটে যাবার পর জ্যোতি ভাবছে - জীবন এরকমই।