কয়েকদিন আগে পড়ে শেষ করলাম এ কে খন্দকারের লেখা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমুলক বই- ১৯৭১: ভেতরে বাইরে। আমি বইটা পড়া শুরু করি গত ডিসেম্বরের শুরুতে, কিন্তু নানা ঝামেলা আর ব্যস্ততায় শেষ করতে অনেক সময় লাগল। বইটি বের হওয়ার পরপরই ব্যাপকভাবে আলোচিত, সমালোচিত হয়। তাই বইটি পড়ার জন্য আগ্রহ তৈরি হয়েছিল আমার মাঝে। এই বইটির লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেক গূরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাঁর মাধ্যমে এসেছে। অনেক সিদ্ধান্ত তার উপস্থিতিতে নেয়া হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের উপর এরকম বই লেখার মত যোগ্য একমাত্র জীবিত ব্যক্তি তিনিই ছিলেন। যারা তাঁর বইয়ের সমালোচনা করেছেন, সমালোচনা করার মত যোগ্যতাও সেইসব ব্যক্তিদের নেই। বইটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য এবং প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত। তিনি বইতে এমন অনেক চমকপ্রদ ও বিরল ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন, যার প্রত্যক্ষদর্শী একমাত্র তিনি নিজে, বা কোন কোন ক্ষেত্রে আর কেউ উপস্থিত থাকলেও তারা বর্তমানে কেউ জীবিত নেই। তাই তিনি এই বই না লিখলে সেই সব ঘটনা সম্পর্কে আমরা কখনই জানতে পারতাম না। বইটি তিনি কেন এত দেরীতে লিখলেন সে সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিল যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা ডায়রী আকারে ১৯৭১ সালেই লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর তাকে বিদেশে বদলি করে দেয়া হয়। তার সেই ডায়েরীগুলো একজন পরিচিতের কাছে রেখে যান যা সেই লোকের জিম্মায় থাকা অবস্থায় ১৯৮৮ এর বন্যায় নষ্ট হয়ে যায়, যা তিনি আর ফেরত পাননি। এর পর অনেক দিন তিনি কিছু লেখার অবকাশ পাননি। পরে তিনি এরকম একটি বই লেখার তাগাদা অনুভব করেন। ওনার বইয়ের উপর কিছু লেখা বা মন্তব্য করার ন্যূনতম যোগ্যতাও আমার নেই। আসলে উনি মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন একটা অবস্থানে ছিলেন যে তার সমালোচনা করার যোগ্যতা অনেকেরই নেই। আমি নেটে এই বইয়ের উপর তেমন কোন রিভিউ পাইনি। তাই নিজেই পড়ার পর কিছু বলার দরকার মনে করছি। আশা করি এই মার্চ মাসে মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে যারা বইটি পড়তে চান তারা কিছুটা ধারণা পাবেন আমার রিভিউ থেকে।
১) বইয়ের শুরুতেই তিনি তৎকালীন পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। এর পাশাপাশি তিনি তার নিজের পেশাগত এবং পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বলেছেন, যা থেকে আমরা তার সম্পর্কে একটা ভালো ধারনা পাই। বইটি তিনি সম্ভবত একধরনের নৈতিক অবস্থান থেকে লিখেছেন। যার কারনে তিনি সত্য কথা লিখতে দ্বিধা বোধ করেননি। তিনি কখনো কারো কঠোর সমালোচনা যেমন করেছেন, আবার সেই একই ব্যক্তির সম্পর্কে ভিন্ন প্রসঙ্গে প্রশংসাও করেছে। বিমানবাহিনীর সদস্য ছিলেন বিধায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে এমন অনেক অভিজ্ঞতার সম্মুখিন তিনি হয়েছিলেন, যা সেনাবাহিনীর বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কারো হয়নি। অত্যন্ত সহজ ভাষায় বইটি লেখা, কথার মারপ্যাচ বা কল্পনার রঙ চড়ানো হয়নি। লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন যে বইটি তিনি ৪৩ বছর আগের স্মৃতি থেকে লিখছেন। তাই কিছু গড়মিল হয়ে যেতে পারে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই তিনি দলিল উপস্থাপন করে তথ্য দিয়েছেন, তাই ভুলের কোন অবকাশ ছিল না।
২) এই বই পড়ে আমার মনে হল এতদিন আমরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমরা যা পড়েছি সবই গৎবাঁধা রাজনৈতিক দৃষ্টভঙ্গির প্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আজকাল যারা বলেন বা লেখেন, এদের অনেকেই আদৌ যুদ্ধের ব্যাপারে কিছুই জানেন না, অনেকে দূর থেকে দেখে বলেছেন, অনেকে কিছু খন্ড চিত্র তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামীলীগের কৃতিত্বকেই সামনে নিয়ে আসা হয়, অথবা জিয়াউর রহমান একাই এক রেডিও ঘোষনা দিয়ে যুদ্ধ জয় করে ফেলেছিলেন, এই টাইপের কথাবার্তা। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্যগুলো প্রায়শই ঢাকা পড়ে যায়।
৩) এ কে খন্দকার তাঁর লেখায় সেই সময়কার রাজনীতিবিদদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। কারন তিনি মনে করেন পাকিস্তানের মত একটি বিশাল ও আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত এবং প্রশিক্ষিত একটি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের রাজনীতিকদের মাঠ গরম করা কথাবার্তা যুদ্ধ জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিলনা। মাঠে মুক্তির/স্বাধীনতার সংগ্রামের বক্তৃতা দিয়ে তারা পাকিস্তানের সাথে আপোস-মীমাংসার স্বপ্ন দেখতেন। তাদের ধারনা ছিল যে পাকিস্তানিরা শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কাছে পরাভূত হয়ে হার স্বীকার করে দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। আজকে তারা মুক্তিযুদ্ধের পুরো কৃতিত্ব দাবি করলেও সে সময় তারা যুদ্ধের ব্যাপারে কারো সাথে কোনো কথা বলত না। আদৌ কোন যুদ্ধ হবে কিনা, যুদ্ধ হলে সেই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্গালী অফিসার ও সৈনিকদের কি করনীয়, সাধারন মানুষের কি ভূমিকা থাকবে, অস্ত্র কোথা থেকে আসবে- এই রকম খুব মৌলিক অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনীতিক নেতারা সে সময় কোন দিক নির্দেশনা দিতেন না। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়ে গিয়েছিল, মানে আসলে আপোষ মীমাংসার পথ আর খোলা থাকেনা, কিন্তু এর পরও আওয়ামী লিগ পাকিস্তানে থাকার স্বপ্ন দেখতো।
৪) এ কে খন্দকার ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন সিনিয়ার বাঙ্গালী কর্মকর্তা। সে সময় পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সব বাঙ্গালী অফিসারদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে সিনিয়র। ৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি পাকিস্তান বাহিনীতে সন্দেহজনক কার্যকলাপ লক্ষ্য করেন। এসময় তাকে নানা অজুহাতে কর্মস্থল থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করত অবাঙ্গালী কর্তৃপক্ষ। এর মাঝেই তিনি বুঝলেন যে সাদা পোষাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেসামরিক বিমানে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসছে। কিন্তু এরা সবাই আসছে রাতের বেলা, যার কারনে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তিনি এসব তথ্য জানানোর জন্য আওয়ামী লীগের উচ্চপদস্থ নেতাদের সাথে কথা বলতে চাইতেন, কিন্তু তাকে তারা কেউ কখনো ডাকেনি, সেই সময় নজরদারীতে থাকার কারনে তিনিও নিজে থেকে যেয়ে কিছু বলতে পারেওনি। একেবারে শেষ মূহুর্তে ২৫শে মার্চ তিনি টেলিফোনে এবং সশরীরে বংবন্ধুর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন, কিন্তু আওয়ামী লিগের নেতাদের অবহেলায় সফল হননি।
লেখক মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানীদের আচমকা আক্রমণ এবং বাঙ্গালীদের ব্যাপক প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির জন্য আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের দায়ী করেছেন। তার মতে, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগাম পরিকল্পনা নেয়া হলে এভাবে তারা আচমকা আক্রমণ করতে পারত না। কিন্তু পরিকল্পনা না থাকায় প্রথম আঘাতেই পাকিস্তানিরা অসংখ্য বাঙালি হত্যা করে, ইপিআর এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক বাঙালি সৈন্য হতাহত হয়। বাঙালি অফিসাররা কোনমতে জীবন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে সক্ষম হয়। পরিকল্পনা না থাকায় বাঙালি সৈনিকদের প্রতিরোধ সফল হয়নি। এমনকি অস্থায়ী সরকার গঠনের পর প্রথম ৫-৬ মাস মুক্তিযুদ্ধে কাংখিত গতি আসেনি।
৫) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যাদের খুব কাছে থেকে তিনি দেখেছেন তারা হলেন তাজউদ্দিন আহমেদ, বাকি তিন নেতা, মোস্তাক, ওসমানি এবং সেক্টর কমান্ডারগন।
বর্তমানে জাতীয় চার নেতা টাইটেলের মধ্যে তাজউদ্দিনকে ফেলে দেয়া হলেও তিনিই মূলত মুক্তিযুদ্ধের রূপকার ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে প্রবাসী কোন সরকার গঠনের কথা বলেননি। মূলত তাজউদ্দিন নিজে থেকেই এই সরকার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করেন। কার কি দ্বায়িত্ব থাকবে তা তিনি নিজেই ঠিক করেন। সেই অর্থে বাকি তিন জাতীয় নেতার সাথে তাকে মিলানো কোনভাবেই চলেনা।
৬) আওয়ামী লিগের অনেক নেতা তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে মেনে নেয়নি। তারা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এরকম সরকারকে অবৈধ মনে করত। এসব নেতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ না করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা "র" এর সহযোগীতায় মুজিব বাহিনি নামে আরেকটি বিকল্প বাহিনী গড়ে তোলে। যারা মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য না করে বরং কেন্দ্রীয় কমান্ডের বিরুদ্ধে কাজ করত।
৭) ভারত কিভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, কিভাবে তারা বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছে, আবার তারাই কিভাবে মুক্তিযুদ্ধকে বিঘ্নিত এবং কলংকিত করেছে, তার বিবরন লেখকের কাছ থেকে পাওয়া যায়। কিভাবে বাঙালি অফিসাররা ভারতীয়দের পাকিস্তানি সেনা, বিমান এবং নৌ বাহিনী সম্পর্কে অমূল্য তথ্য দিয়ে যুদ্ধে পাকিস্তানের অপূরনীয় ক্ষতি করেছে, যা ভারত কখনই একা পারত না, তাও জানা যায়। এছাড়া এই যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার ভূমিকা সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে।
৮) মুক্তিযুদ্ধের কিছু ঘটনার লোমহর্ষক বিবরন আছে বইয়ে। ফ্রান্স থেকে ১৩ বাঙালি সাবমেরিনারের দুঃসাহসীক পলায়ন এবং তাদের নিয়ে গঠিত নৌ কমান্ডর দুঃসাহসী অভিযান সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। মাত্র দুটা বেসামরিক বিমানকে কিভাবে বাঙালি বৈমানিকরা কিভাবে যুদ্ধ বিমানে রুপান্তর করেন এবং এসব মান্ধাতার আমলের বিমান দিয়েই দুঃসাহসী অনেক বিমান অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানিদের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেন তার বর্ণনা দিয়েছেন।
৯) যুদ্ধের সময় ওসমানী এবং তার মধ্যকার মতানৈক্য, সেক্টর কমান্ডারদের সাথে ওসমানীর মত বিরোধ, ওসমানীর নানা সিদ্ধান্ত কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে সমস্যা সৃষ্টি করেছে, তার কথাও এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তাজউদ্দিনের বুদ্ধিমত্তায় কিভাবে যৌথ কমান্ড গঠিত হয় এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধে পরিণত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়, তা জানা যায়। কেনো ওসমানী আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আসেননি, সেই রহস্যও উন্মোচিত হয়েছে।
১০) মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে আওয়ামীলীগ নেতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল,কিভাবে তারা প্রথম ৫-৬ মাস দলীয় পরিচয়ধারীদেরকেই শুধু যুদ্ধের ট্রেনিং দিতেন, কিভাবে তাদের কারনে সেক্টর কমান্ডারগন সাধারন মানুষদের মুক্তিযুদ্ধে নিতে পারতেন না, তার কথাও উঠে এসেছে।
১১) মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সাধারন মানুষ কিভাবে সর্বস্ব দিয়ে সহায়তা করেছিল, কিভাবে অসংখ্য সাহায্যকারী ব্যক্তি এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, যাদের খোঁজ কেউ রাখেনি, সে কথাও এসেছে।
সর্বোপরি এই বইতে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি সামগ্রিক এবং পূর্ণাঙ্গ বিবরন পাওয়া যায়। মাত্র একটি যায়গা বাদে আর কোথাও কোন বিতর্কের অবকাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বইতে এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধপূর্ব যে রাজনৈতিক বিশ্লেষন করেছেন তাও ছিল অকাট্য। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের অনেক ভ্রান্ত ধারনা থেকে রেহাই দেবে ১৯৭১: ভেতরে বাইরে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ৮:৫৮