somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিষের কৌটা

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ৮:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেই ক্লাস সিক্সে থাকতে মাকে হারিয়েছে। তারপর একমাত্র মেয়ের দিকে তাকিয়ে বাবা আর বিয়ে-থা করেন নি। বাবা-মেয়ে ছিল একজন আরেকজনের খুব ভালো বন্ধু। সংসার সামলাতে গিয়ে পড়াশুনা আর করা হয়নি তার।

সময় গড়িয়ে চলে নিজের মতো করে,বাবা উঠেপড়ে লাগলেন আসমাকে পাত্রস্থ করতে। মানুষ বিয়েতে কত কিছু চায়! কত বাসনা থাকে নতুন জীবন নিয়ে! ওর ইচ্ছা ছিল শুধু যেখানেই যাক বাবাকে সাথে রাখবে। নিজের ছেলের মতো আগলে রাখবে বাকী জীবন। আসমার এই শর্ত মেনেই ২৫ ফেব্রুয়ারী ওর বিয়ে হয়ে গেল একটা খুব সাধারণ ছেলে আহসানের সাথে। ঠিক এক মাস পরই সব ওলট পালট হয়ে যাবে তা কে জানতো!

কারফিউ ভাঙ্গার পরই ঢাকা পালানো, তারপর এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম পালিয়ে এখন একটা মফস্বল এলাকায়। না বাবাকে আনতে পারেনি সাথে করে, পাক বাহিনী ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল তার বৃদ্ধ বাবার দেহ। ২৫ মার্চ ওরা আহসানের বন্ধুর বাসায় আটকা পড়েছিল। কারফিউ ভাঙ্গার পরদিন এসে দেখে প্রিয় বাবার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন রক্তাক্ত দেহ। ঘরের আসবাবপত্র সব ছড়ানো ছিটানো, ভেঙ্গে চুরে একাকার।

মফস্বলে একটা ভাল বাড়ি পেয়েছিল, ভাল বলতে দেখতে সুন্দর বা থাকতে আরাম সেরকম কিছু নয়। তখন বাঁচতে পারাটাই ছিল সুন্দর।কে বা কারা থাকতো এ বাড়িতে! হয়তো প্রাণভয়ে পালিয়ে গিয়েছে কিংবা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ঘাতক বাহিনী। অনেক বড় বাড়িটার সামনের অংশ বিধ্বস্ত। এতে অনেক লাভ হয়েছে, মিলিটারীরা ভাবে এটা লুটপাট করা হয়ে গেছে, এখানে কেউ নাই। পেছনের অংশে একটা বড় ঘর আছে। সেখানেই থাকে ওরা আটজন। একটা পার্টিশনের মতো দেয়া হয়েছে ফলে ঘরটা দুইভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগে থাকে আসমা আর আহসান, অন্যভাগে বাকী ছয়জন। প্রাণভয়ে পালাতে গিয়ে এখন প্রাণবাজী রেখে যুদ্ধ করে ওরা। কোনকিছুকেই ভয় নেই তাদের।

আসমাকে ওরা সরাসরি যুদ্ধে যেতে দেয়নি। ওদের রান্না করে, অস্ত্র মুছে রাখে, কেউ আহত হলে সেবা করে। ওদের ট্রেনিং আগ্রহ নিয়ে দেখতে দেখতে নিজেও শিখে গেছে কিভাবে কি করতে হয়। ওরা আটজনের জন্য অস্ত্র মাত্র ছয়টা, আর দুটা অস্ত্র হলে সেও যুদ্ধে নেমে পড়বে। যুদ্ধে নারী-পুরুষ আলাদা করা ঠিক না, সবার মরার ঝুঁকি সমান, বাঁচার সম্ভাবনাও সমান।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আসমা। যতই বলুক নারী পুরুষ সমান আসলে কিন্তু তা না। মেয়ে হয়ে জন্মানো বেশ বাজে ব্যাপার এম্নিতেই, যুদ্ধে সেটা আরো তীব্র। এক কৌটা বিষ তার শাড়ির আঁচলে সযতনে বাঁধা আছে। মিলিটারীরা হামলা করলেই সেটা খেয়ে নিবে। নিজেকে ওদের উল্লাসের কারণ হতে দিবেনা, কিছুতেই না।

প্রতিদিন ঝুলি ভরে জয় আনে ওরা। মুখে তৃপ্তির হাসি, চোখে স্বপ্ন, আর কিছুদিন পর পাওয়া যাবে স্বাধীন বাংলা। সব দুঃখ পরাজিত হবে সেখানে।
সবদিন এক হয় না। একদিন পার হয়ে গেছে কিন্তু ওরা ফিরছেনা। ঘরে রয়েছে একজন মুক্তিযোদ্ধা, রুহুল। আগেরদিন হাতটা খুব বিশ্রীভাবে কেঁটে যাওয়ায় সে আর আজকের মিশনে যেতে পারেনি। জ্বরের ঘোরে পড়ে রয়েছে সে। আসমা জানে ওরা কোথায় গিয়েছে, খুব দূরে কোথাও না। সেখানে সে অনায়াসে যেতে পারবে। বাড়তি অস্ত্রও আছে, আহত রুহুলের অস্ত্র ছাড়াও ওরা মিলিটারীদের কাছ থেকে দুইটা বন্দুক এনেছিল। অস্ত্র চালানোর কৌশলও তার জানা আছে।
দু রাকাত নামাজ পড়ে নিল, তারপর অস্ত্র নিয়ে চুপিচুপি বের হলো বাড়ি থেকে।

অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে সে এখন আস্তানার কাছাকাছি। একটা স্কুল ঘর, সেখানে মিলিটারীরা এসে উঠেছে। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে কয়েকটা মিলিটারীর মাতাল হয়ে চেঁচাচ্ছে খুব, মনে তাদের খুব ফুর্তি। আসমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। ওরা সব ধরা পড়েনি তো! ধীরপদে এগিয়ে গেল, নারী কন্ঠের কান্না ভেসে আসছে ভেতর থেকে। কোন হতভাগী আটকা পড়েছে শত্রুর নারকীয় উল্লাসে! বিষের কৌটা টা ঠিক জায়গায় আছে নাকি দেখে নিল আসমা।

স্কুল ঘরের পেছনে একটা পুকুর। তার পাড়ে লুকিয়ে আছে আসমা। সাথে একটা বন্দুক, একটা ছুরি আর এক কৌটা বিষ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে চারপাশ। একটা বস্তার মতো দেখলো, বস্তাটা কি নড়ে উঠলো? নাকি চোখের ভ্রম? না না, আরো কিছু দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ, ওরাই, ওরা ছয়জনই। বেঁচে আছে এখনো, হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। ছুরি দিয়ে দ্রুত বাঁধন খুলতে লাগলো নিঃশব্দে, কোন শব্দ হলেই ঘাতকের দল টের পেয়ে যাবে। বাঁধন খুলে এরা হাত পা দ্রুত ঘষতে থাকে, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হবার জন্য। সবাই কম বেশী আহত, ঘাতক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার। রাতে শত্রুরা চলে গেল উল্লাস করতে। নইলে আরও ভয়ংকরভাবে নির্যাতন করা হত ওদের, সেগুলো সকালের জন্য জমিয়ে রেখেছিল পাক সেনার দল। ভোর হলেই এদের নৃশংস ভাবে হত্যা করা হতো!

ছাড়া পেয়ে ওরা চললো তাদের বাড়ির দিকে। সারাটা রাস্তা আসমা শক্ত করে ধরে রেখেছিল আহসানের হাত। বাড়িতে ওরা এসেছিল অস্ত্র নেয়ার জন্য। আবার যেতে হবে স্কুল ঘরে, থমকে দিতে হবে শত্রুর উল্লাস।
খুব অনুনয় করেছিল আসমা, “অন্তত কিছু মুখে দিয়ে যাও”। আহসান অভয়ের হাসি দিয়ে বলেছিল, “সকালে এসে খাব। ওদেরকে মারার এখনই সময়। বুঝতেই পারছো সকাল হয়ে গেলে সেটা প্রায় অসম্ভব হবে। বেঁচে থাকলে দেখা হবে।”

সকালে আর খাওয়া হয়নি আহসানের। সে রাতে অনেকক্ষণ যুদ্ধ করার পর ওরা বিজয় এনেছিল ঠিকই কিন্তু মূল্য হিসেবে দিতে হয়েছিল আহসানের প্রাণ। এত বড় বিজয়ের পরও কারো মুখে কোন হাসি ছিল না। আহসানকে চিরদিনের জন্য শুইয়ে দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল একেকজন।

কিছুদিন পরই দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। খুশীতে বিষের কৌটা ফেলে দিয়েছিল আসমা। বাবা আর স্বামী হারানোর বেদনা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল। এবার বুঝি দেশের মানুষ সুখে থাকতে পারবে।

দেশ স্বাধীন হলেও তার বাড়িঘর সব হাতছাড়া হয়ে যায়। আহসানের জায়গায় কাউকে স্থান দিতে পারবেনা বলে আর কোন সম্পর্ক গড়েনি সে।যুদ্ধের পর কিছুদিন এর ওর বাড়িতে থেকেছে, তারপর কাজে নেমে গিয়েছিল। এক বাসায় কিছুদিন গৃহকর্মীর কাজ করার পর জেনেছিল ওটা এক রাজাকারের বাসা। সঙ্গে সঙ্গে বাসা ছেড়ে চলে এসেছিল সে। তার পেট ভরার জন্য দেশের সম্মান, আহসানের সম্মান, তার নিজের সম্মান ধ্বংস হতে দিবেনা কিছুতেই। তারপর অনেক বাড়িতে কাজ করেছে সে। এখন আর শরীরে কুলোয় না। কাজ করতে পারেনা ঠিকমতো! কে রাখবে তাকে!

জীবনে কত কষ্টই না করেছে সে, কিন্তু সেগুলো কষ্ট মনে হয়না তার। শুধু যখন দেখে রাজাকারের দল সদর্পে ঘুরে ফিরছে, এই সোনার বাংলার শ্যামল ঘাসগুলো তাদের অপবিত্র পায়ে দলিত হচ্ছে, তখন নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা।

আজকাল স্মৃতিচারণ করে করেই দিন কাটে তার, চোখেও ছানি পড়ছে, অস্পষ্ট হয়ে আসছে সোনার বাংলা।
আবারও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ষাট বছরের বৃদ্ধ আসমা। ওর সামনে এক থালা ভাত, আজ ভিক্ষা করে পেয়েছে।

বিজয়ের দিনে বিষের কৌটা টা ফেলে দিয়ে বড় ভুল করেছিল সে।

৫২টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×