বন্ধু তীরন্দাজ
ভালো আছ আশা করছি। তোমার ওখানে খুব শীত পড়েছে বলে জানিয়েছ। আজকের পত্রিকায় তা কমেছে জানতে পেরে অনেকটা আশ্বস্ত হলাম। তোমার গত চিঠিতে তুমি প্রতিবারের মতোই দেশ সম্পর্কে তোমার হতাশা প্রকাশ করেছো। কোন চিঠিতেই তোমাকে আশাদায়ক কিছু জানাতে পারি নি। কিন্তু এবার যা লিখছি, তা তোমাকে উদ্বেলিত করবে, সেটা ভেবে আমি নিজেই আনন্দিত, শিহরিত হচ্ছি বারবার।
আমাদের দেশে খুব সম্ভবত বিরাট এক পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। অনেকদিন ধরেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উপর সাধারণ মানুষের ভরসা ও অবিশ্বাস বেড়েই চলছিল। তার যে যথেষ্ট কারণ ছিল, তা অবশ্যই জানা আছে তোমার। চিঠিতে আমরা অনেকবারই এ নিয়ে আলোচনা করেছি। গত নির্বাচনে বেসরকারী হিসেবে শতকরা মাত্র 37 ভাগ ভোট পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর বাকসে দলগুলো ও তাদের নেতানেত্রীদের উপর সাধারণ মানুষের কতোটা অনীহা, এরপর তা আর কোন প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। তারপরেও তারা কারচুপি করে একটা সরকার গঠন করেছে। তাতেও ক্ষান্ত হয়নি তারা। নিজেদের মাঝে সংলাপের ভাওতা দিয়ে সরকার ও বিরোধী দল মিলে মিশে এমন কিছু আইন প্রনয়ন করার চেষ্টা করেছে, যা শুধুমাত্র নিজেদের অবস্থান ও শক্তিকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টাকে আরো বেশী নগ্ন করে তুলেছে। এ ভাওতাবাজির দিন যে শেষ, সেটা হয়তো ভুলে গিয়েছিল বোকার হদ্দরা। কোনকিছুর তোয়াক্কা না করে সাধারন মানুষ বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। এমনকি আগে যারা টাকা খেয়ে ভোট দিতে যেত, তারাও এখন আধপেটা খেয়ে এই জনজোয়ারে সামিল হয়েছে। রেডিও, টেলিভিশন স্টেশন, বড় বড় দুর্নীতিবাজ ও আমলাদের বাড়ীগুলো, তাদের চামচাদের করা বিশাল দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন জনগনের দখলে। তুমি শুনে অবাক হবে, তারপরও কোন লুটতরাজ নেই বললেই চলে। মালিকদেরকে উচ্ছেদ করে জনগনই পাহাড়া দিছে। এমন জোয়ার আমি কখনও দেখিনি, মনে হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় লেখা হতে যাচ্ছে এবার যা যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে মানুষ।
প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের ভবন এখনও সরকারের দখলে। সেখানে সেনাবাহীনি মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশবাহিনীর বিরাট একটি অংশ তো আগেই এই বিপ্লবের পক্ষে চলে এসেছিল, সেনাবাহিনীও যে তাতে যোগ দেবে, তা মাত্র সময়ের ব্যপার। তাদের একটি অংশ প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টে কে গ্রেপ্তার করার প েবক্তব্য রেখেছে ও তা যে খুব দ্রতই ঘটতে যাচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই কারো। রাজনৈতিক দলগুলোর চামচাদের অনেকেই যারা পেরেছে, আশ্রয় নিয়েছে সেখানে। কেউ কেউ পালিয়েছে দেশ ছেড়ে। যারা কোনটাই পারেনি, গ্রেপ্তার হয়েছে জনগনের হাতে। রাজনৈতিক দলগুলোর মদদদাতা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা তাদের দুতাবাস ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে অনেকেই। যারা এখনও রয়েছে, তারাও একই পথ নেয়ার পায়তারা কষছে।
অভ্যুথ্যান ও গনজোয়ারের দেশ আমাদের। কিন্তু এবারের মতো কখনোই দেখা যায়নি। সত্য ও ন্যয়ের পথে চললে মানুয়ের চেহারায় যে দৃপ্তভাব দেখা যায়, সে দৃপ্তভাবই ফুটে উঠেছে প্রতিটি মানুষের চেহারায়। এমনকি পুলিশবাহিনীর সদস্যরা ঘুষ নিতে অসী্বকার করছেন। কেউ কেউ ঘুষ দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হবার পর, এখন কেউ ঘুষ দিতেও সাহস পাচ্ছে না। দোকানদারাও এই অভ্যুথ্যানের ছুতোয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী করা থেকে বিরত থাকছেন। ধনী, গরীব, শিক্ষিত, অশিক্ষিতের এই নির্লোভ একাত্মতা প্রমান করে দেয় যে, দেশের মঙ্গল ও মুক্তিই এবার আসল উদ্দেশ্য। যারা এই উদ্দ্যেশের সাথে একাত্ম নয়, তাদের দিন শেষ। দেশের ভেতরে তাদের আর কোন স্থান নেই।
আরেকটা বিষয় নজর করার মতো। এবারের গনজোয়ারে ধর্মান্ধদের কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। হয় তারা পালিয়েছে, নয় তারা নিজেদের ভুল ধরতে পেরে সামিল হয়েছে জনগনের কাতারে। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, জাতিধর্মনিবিশেষে সবাই এবার এক কাতারে। জাতিধর্মনিবিশেষে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধর্ম ঠিক রেখেও সামিল হবার পথ খুজে পেয়েছে এক কাতারে।
খুব তাড়াতাড়িই বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ, কৃতি ও যোগ্য শিক্ষকদের ও বোদ্ধাদের সামনে রেখে এক অন্তর্বতিকালীন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। তীরন্দাজ, তুমি হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না যে, গনজোয়ারের নেতৃত্বদানকারী কেউই এ সরকারে থাকছেন না। গদীর লোভ যে তাদের নেই, তা তারা তাদের ভুমিকা ও কর্মে প্রকাশ করেছেন। তবে তারা সরকারের ভুমিকাকে,যে বাইরে থেকে পর্যবেক্ষনে রাখবেন, সে কথা দিয়েছেন।
তীরন্দাজ, আমরা অনেকবারই হতাশ হয়েছি। আমাদের সপ্নগুলো প্রতিবারই হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। তবে আমার মনে হচ্ছে, এবার তা হতে যাচ্ছে না। কারণ প্রতিটি মানুষ বুঝতে শিখেছে, এটাই আমাদের সর্বশেষ সুযোগ, আমাদের বাঁচার একমাত্র পথ, জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে টিকে থাকার সর্বশেষ নি:শ্বাস। শাষনতান্ত্রিত পথ কি হতে যাচ্ছে, তা এখনও জানা যায়নি। তবে তা যে সাধারণ মানুষের আশা আকাংখা কে ডিঙ্গিয়ে কিছু মানুষের স্বার্থপূরণের পথ হবে না, সেটা পরিস্কার। সে পথেই এগুচ্ছে আমাদের দেশ। অন্যথায় জনরোষের সামনে কারেই যে পালাবার পথ থাকবে না, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তুমি ভাল থাকবে। সামনের বছরে দেশে এলে আশা করছি তুমি অন্য এক বাংলাদেশ দেখতে পাবে যেখানে সম্পদের পরিমান কম কলেও ভাগাভাগি সুষম। সামাজিক নিশ্চয়তা ফিরে এসেছে তখন সাধারণ মানুয়ের জীবনে। সামান্য নিয়েই আনন্দে ভরপুর অতি সাধারণ দিনগুলো। তখন তোমাকে নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে বেড়াব। তারপর তুমি নি:শ্চই এ দেশ নিয়ে শুধুমাত্র হতাশার দৃষ্টিকোন নয়, অন্য দৃষ্টিকোনথেকে লেখার সুযোগ পাবে।
অনীক

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


