somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বপ্নের আমেরিকার অন্ধকার দিক

১১ ই জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্বপ্নের আমেরিকার অন্ধকার দিক-১

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, আমেরিকায় গড়ে প্রতি ৫ সেকেণ্ডে একটি আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হয়, প্রতি ১৪ মিনিটে সেই আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে একটি প্রাণ যায়। বিশ্বের মোট হ্যান্ডগানের তিন ভাগের এক ভাগ আমেরিকানদের হাতে। ৩০ কোটি মানুষের আমেরিকায় হ্যান্ডগানের সংখ্যা ২০ কোটি৷ বাংলাদেশে যেমন লবণ কেনা যায় তেমনি আমেরিকাতে হ্যান্ডগান কেনা যায়। সেগুলো তারা খেয়াল খুশি মতো ব্যবহারও করে৷ কয়েকবছর আগে ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ বছরের ঘাতক তরুণটির কথা মনে আছে তো। যেকিনা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়া আমেরিকান সমাজের একটি ছোট্ট উদাহরণ মাত্র৷ আট বছর বয়স থেকে আমেরিকাতে বসবাসকারী এই তরুণের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ঘটতে দেয়নি আমেরিকান সমাজ ব্যবস্থা৷ তদপুরি তথাকথিত ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অপরাধ করার সহজ সুযোগ তাকে আরো বিধ্বংসী করে তোলে৷ আমেরিকার সমাজের গভীরে যে মরিচা পড়েছে সেটি সাধারণ মানের চেষ্টায় পরিষ্কার করা যাবে না৷ একটা বড় ধরনের ঘষামাজা সেখানে দরকার৷ কিন্তু আমেরিকানরা অন্যকে নিয়ে এতো বেশি ব্যস্ত যে নিজেদের ঘর গোছাতে তারা সময় করে উঠতে পারছে না৷

কেউ হয়তো বলবেন, নিজেকে রক্ষার জন্য অস্ত্র রাখা খারাপ নয়। সেতো হতেই পারে। যেমন সুইজারল্যান্ডে সিভিল ফোর্সের অংশ হিসেবে প্রতিটি বাড়িতে আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে৷ কিন্তু ২০০০ সালের জাতিসংঘের হিসাব মতে অস্ত্রের গুলিতে সুইজারল্যান্ডে প্রতি ১০ লাখে মাত্র ৫ জন মারা গিয়েছে৷ অন্যদিকে আমেরিকাতে এই হার হলো প্রতি ১০ লাখে ৩০০ জন৷ তাহলে? আসলে পচন ধরেছে যে সমাজে সেখানে অন্য কিছু বললে কি হবে?



স্বপ্নের আমেরিকার অন্ধকার দিক-২

সোভিয়েট ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর, ইচ্ছায় আর অনিচ্ছায় হোক বিশ্বের বড় একটি অংশ আমেরিকার মোড়লীপনা মেনে নিয়েছে৷ এদিকে, পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের কারণে আমেরিকা বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে স্বপ্নের দেশে পরিণত হয়েছে৷ বাংলাদেশীদের জন্যে তো বটেই৷ ওপি ওয়ান এবং পরবর্তীতে ডিভি লটারিতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশীর অংশগ্রহণ আমাদের জানিয়ে দেয় তারা ওই দেশটিকে কতটাই না ভালোবাসে৷ এরা মনে করে আমেরিকা গেলে ছবির মতো একটি দেশ তারা পাবে৷ কিন্তু বাস্তবতা হলো আমেরিকান সমাজের অবস্থা কোনো কোনো দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ৷

আমাদের দেশে রনবী-র টোকাইরা দুমুঠো ভাতের জন্য ঢাকার রাস্তায় বই ফেরি করে, পাতা কুড়ায় কিংবা গার্মেণ্টস কারখানায় হেলপারের কাজ করে অন্যদিকে স্বপ্নের আমেরিকার টোকাইরা ড্রাগস বিক্রি করে কিংবা ভাড়াটে খুনী হয়৷ ওইদেশের শিশুরা কতো যে অপরাধ করে তার ফিরিস্তি শুনবেন? ১২ বছরের আমেরিকান কিশোর জেফরি ফারিনা শুধুমাত্র ক্লান্তিকর দিনের বিরক্তি দূর করতে তিনজনকে গুলি করে কিংবা ১৯ বছরের হেনরি জেমস কাউকে খুন করলে ভালো লাগবে এই অনুভূতি থেকে গুলি চালায়৷



স্বপ্নের আমেরিকার অন্ধকার দিক-৩

আমেরিকার পচন আজকে শুরু হয়নি। সেই ১৯৭০ সালে ১৮ এর কম বয়সী ৫৪৫৯৬ জন শিশু বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার হয়েছিল৷ ১৯৯২ সালে

এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১,০৪,১৩৭ জন৷ আর ১৯৯৪ সালে প্রায় ২২ লাখ। এর মধ্যে ৩১০২জন গ্রেফতার হয়েছে খুনের অভিযোগে৷

১৯৯১ সালে আমেরিকাতে ধর্ষনের শিকার শিশু কিশোরীর সংখ্যা ছিলো ২৭ লাখ৷ তারমানে ওই বছর প্রতি ৪ মিনিটে একটি করে ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে৷ রুচি বদলের জন্য আমেরিকান সমাজে বাবা তার ১৩ বছরের মেয়েকে ধর্ষন করে৷ আরো শুনতে চান৷ বলি তাহলে৷ তবে তার আগে রিগান প্রশাসনের সাবেক মন্ত্রী পল ক্রেগ রবার্টসের একটি লেখা থেকে কিছুটা উদ্বৃত্তি দিতে চাই৷

২০০৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত তার লেখা এক প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন: বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ বন্দী অবস্থায় রয়েছে আমেরিকার জেলগুলোতে৷ এই সংখ্যা সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ চায়নার চেয়েও বেশি৷ আমেরিকার জেলে বন্দী মানুষের সংখ্যা চায়নার চেয়ে ৭ লাখ বেশি৷ আর রাশিয়ার চেয়ে ১৩ লাখ ৩০ হাজার বেশি৷ আরেক হিসেব অনুযায়ী আমেরিকাতে বসবাস করে বিশ্বের মোট ৫ শতাংশ মানুষ৷ কিন্তু এই দেশটির কারাগারে বন্দীর সংখ্যা বিশ্বের মোট বন্দী মানুষের ২৫ শতাংশ৷ প্রতি ৩২ জন পূর্ণ বয়স্ক আমেরিকানের মধ্যে একজন রয়েছে জেলে৷ তিনি এই লেখাতে আরো বলেছেন, আমেরিকাতে অর্থের বিনিময়ে স্বাক্ষী কিনতে পাওয়া যায়৷ তিনি তার এই লেখায় আমেরিকায় এতো বেশি অপরাধী হওয়ার পিছনের কারণ হিসেবে সমাজের অস্থিরতা, পরিবারের মধ্যে অবিশ্বস্ততা, দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, শিশু বিকাশে উপযুক্ত সামাজিক নাসিংয়ের অভাব এবং সর্বোপরি বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার বিভিন্ন দিকগুলো তুলে ধরেছেন৷



স্বপ্নের আমেরিকার অন্ধকার দিক-৪

আমেরিকাতে পরিবার প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পথে৷ আমেরিকার শিশু জন্মের মোট সংখ্যার মধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ অর্থাৎ মোট শিশু জন্মের প্রায় ৩০ শতাংশ জন্ম নেয় বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের মাধ্যমে৷

আর দুর্নীতির কথা যদি বলি তবে বাংলাদেশের সকল দুর্নীতিই আপনি মডিফাইড ভাবে আমেরিকাতে পাবেন। কিন্তু দুর্নীতি তো দুর্নীতিই, কি বলেন?

কয়েকটি উদাহরণ নিচে দেয়া হলো৷

সরকারি অফিসের দুর্নীতি

শিকাগো শহরে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা একটি ১৪ হাজার ৮২ বর্গফুটের অফিস বিল্ডিং যখন বাজারদরের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়ায় ২০ বছরের জন্য ভাড়া হলো তখন আশেপাশের অনেকেই বিষ্মিত হলো৷ কিন্তু যখন জানা গেলো নতুন ভাড়াটিয়া আর কেউ নয়৷ সরকারের দি সোশ্যাল সিকিউরিটি এডমিনিস্ট্রেশন, তখন কারো কারো বিষ্ময় কেটে গেলো৷

করদাতাদের অর্থে নিজের প্রচার

১৯৯১ সালের শেষে এসে দেখা গেলো নিউজার্সির নেওয়ার্ক শহরের বাজেটে ৪১ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতি পড়েছে৷ ঘাটতি বাজেট মোকাবেলায় সিটি কাউন্সিল কর্মী ছাটাইসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিল৷ অথচ সেসময়ে তারা সিটি কাউন্সিলের অতীত ও বর্তমানের ৪২ জন কাউন্সিল মেম্বারের প্রোট্রেট তৈরি করার জন্য ৬ লাখ ৫২ হাজার ডলার ব্যয় করা হলো৷ এর প্রতিবাদ করে শহরের করদাতা সমিতির চেয়ারম্যান বললেন, ওরা কর্তৃপক্ষ বলেই জনগণের অর্থে নিজেদের প্রচার করছে এবং সেসঙ্গে জনগণকে শোষন করছে৷

স্বপ্নের আমেরিকার অন্ধকার দিক-৫

মার্কিনী দুর্নীতির কিছু চমকপ্রদ খবর শুনুন:

১. রাগ হলে খুন করে কিন্তু দায়িত্ববোধ তার প্রখর: ওয়াশিংটন পোস্টের একটি খবর হলো এমন- ছোটখাটো চেহারার হেনরী জেমস গুলী ছুড়তে পছন্দ করে৷ তবে সবসময় নয়৷ যখন সে রেগে যায় তখন রাগ কমাতে সে অন্য কাউকে গুলি করে৷ এযাবতকালে সে এমন গুলি ছুড়েছে তিনবার৷ প্রতিবার একজন করে মারা গেছে৷ তার সর্বশেষ শিকার ৩৬ বছরের এক মহিলা৷ ঘটনাটি ঘটেছিল এভাবে- জেমস গাড়িতে যাচ্ছিল৷ হঠাত্ই তার মেজাজ খিচড়ে যায়৷ কি করবে ভেবে না পেয়ে সে গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে সিগনালে থেমে থাকা পাশের গাড়ির আরোহীনিকে গুলি করে৷ ফলে সে মারা যায়৷ পুলিশ তাকে ধরে ফেলে৷ তখনই তার আগের দুটো হত্যার কথা এবং সেসঙ্গে তার মন খারাপ হলে গুলি করার কথা জানা যায়৷ পত্রিকাটিতে আরো লেখা হয়৷ জেমস নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলেও তার একটি সুন্দর কোমল মন আছে৷ সেটি বোঝা যায় যখন দেখা যায় সে তার দুই কিশোরী মেয়ের খোজ খবর নেয়৷ তাদেরকে সময়ে সময়ে টাকাপয়সাও দেয়৷ (এ ঘটনাটি প্রমাণ করে আমেরিকান সমাজে বাবা-মেয়ের দায়িত্ববোধ বিষয়টিকে কিভাবে দেখা হয়)

২. খুনির ব্যক্তিগত: বাইশ বছরের একটি মেয়েকে টুকরো টুকরো করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ডেনিস বেলডটিকে ম্যাসাচুচেটস আদালত যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে৷ তার বাড়ি থেকে ব্যাগভর্তি মেয়েটির লাশ পাওয়া যায়৷ এসময় তার বাড়ি থেকে অনেকগুলো ব্লু ফিল্ম, স্টিল নগ্ন ছবি, নোংরা ও বাজে ম্যাগাজিন জব্দ করা হয়৷ কিন্তু আদালত এই বলে রায় দেয় যে, যেহেতু কোনো প্রমাণ নেই বেলডটি এগুলো বাইরে বিক্রি করতো, তাই এগুলো তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি৷ অতএব এগুলো তাকে ফেরত দেয়া হোক৷ (ব্যক্তিগত সম্পত্তির এমন সংজ্ঞা আপনি শুধুমাত্র আমেরিকান সমাজেই পাবেন, জয় আমেরিকা)।

৩. মাকে হত্যা করাটা বাহাদুরি: আমেরিকান শিশুরা তাদের প্রিয় তারকা খেলোয়াড়ের ছবির কার্ড সংগ্রহ করতে ভালোবাসে৷ প্রতিটি কার্ডের এক পিঠে তারকার ছবি এবং অন্যপিঠে ওই তারকা সম্পর্কে বিবরণ থাকে৷ এই তারকা মানে যে শুধুই সিনেমার নায়ক-নায়িকা, কিংবা খেলোয়াড় তা নয়৷ হরেক কিসিমের তারকা আছে আমেরিকান সোসাইটিতে৷ ১৯৯২ সালে এই ধরনের কার্ড নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছিল পত্র-পত্রিকায়৷ কারণ তখন এক ধরনের কার্ড বাজারে ছেয়ে গিয়েছিল যা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন সচেতন মানুষেরা৷ সেসময়ে ওই সব কার্ড আবার শিশুদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল৷ কি ছিলো সেসব কার্ডে তার একটি নমুনা দেখুন৷ একটি কার্ডের একপিঠে এডমন্ড এমিল কেম্পার নামে এক লোকের একটি ছবি ছাপানো ছিলো৷ ছবির নিচে আবার ছোট করে লেখা ছিলো বর্ণ কিলার অর্থাত্ জাত খুনী৷ অপর পিঠে তার সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা৷ সেখানে লেখা তের বছর বয়সে সে তার বাড়ির পোষা বিড়ালটিকে কেটে টুকরো টুকরো করেছে৷ আরেকটু বড় হয়ে সে দু’টি বালিকাকে তুলে নিয়ে গিয়ে টুকরো টুকরো করে পাহাড়ের উপর পুতে রাখে৷ এরপর সে আরেকটি ১৫ বছরের বালিকাকে অপহরণ করে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে৷ কার্ডের লেখার শেষ করা হয়েছে এভাবে- এডমন্ড তার মাকেও হত্যা করেছিলো তার উপর খবরদারী করার জন্য৷ মাকে হত্যার পর তার স্বরযন্ত্র কেটে ফেলেছিলো বেশি কথা বলার শাস্তিস্বরূপ৷

এই ধরনের কার্ড বিক্রির উপর পরবর্তীতে নিউইয়র্ক শহরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়৷ (আমাদের দেশে এমন কার্ড কেনার কথা কিংবা বিক্রি করার কথা ভাবা যায়?)

৪. রোগীর শরীর হাতিয়ে যৌনসুখ নেয়া: ফিলাডেলফিয়া নিবাসী দাতের ডাক্তার ওয়ারেন এস. গ্রাবয়েস কিশোরী রোগীদের শরীর হাতড়িয়ে যৌনসুখ নিতেন৷ কিন্তু একবার এক সাহসী কিশোরী বিষয়টি প্রকাশ্যে জানিয়ে দিলে এটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়৷ ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়৷ কিন্তু শাস্তির জন্য তাকে কারাগারে না পাঠিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়৷ কারণ গ্রাবয়েস যা করেছেন তার কারণ, ফ্রটিরিসম নামের একটি রোগ৷ যদিও ডাক্তার গ্রাবয়েস নিজেও তার এই রোগটি সম্পর্কে জানতেন এবং জেনেশুনেই তিনি এমনটা করতেন৷

৫. শিক্ষকরা ফাকি দেয়: বাল্টিমোর রাজ্যের সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষকের উপর পরিচালিত এক জরিপ থেকে স্কুল শিক্ষকরা মাসের পর মাস ক্লাস ফাকি দিয়েও ঠিকই বেতন তুলে নেন৷ এমনকি এজন্য তাদের কোনো শাস্তি হয় না৷ যেমন, একজন শিক্ষিকা ৪ বছরে মাত্র ৭ দিন ক্লাস নিয়েও প্রতিমাসেই পুরো বেতন তুলে নিয়েছেন৷ (বাংলাদেশের শিক্ষার মান বাড়ানো, স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং শিক্ষকদের স্কুল ফাকি দেয়ার প্রবণতা হ্রাসের কাজে অনেক বিদেশী বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে কাজ করছেন যার মধ্যে আমেরিকানরাও আছেন৷)



স্বপ্নের আমেরিকার অন্ধকার দিক-৫

সবই সম্ভব। প্রতিবেশী ১৩ বছরের এক কিশোরীকে মদ খাইয়ে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের ভিডিওচিত্র নিজের ৮ ও ১১ বছর বয়সী দুই ছেলেকে দেখানোর অপরাধে ব্রুস কান নামের এক আমেরিকানের সাজা হয়েছিল মাত্র ৮ সপ্তাহ৷ কারণ হিসেবে বিজ্ঞ আদালত রায়ে উল্লেখ করে, দোষী (ব্রুস কান)কে আরো বেশি সময় জেলহাজতে রাখলে আরো বড় ক্ষতি হবে কারণ তার দুই সন্তানকে দেখার কেউ নেই৷

কতটা সহজ। স্বল্প আয়ের আমেরিকান নাগরিকগণ মানসিক বা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলে তাকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নির্দিষ্ট অঙ্কের ভাতা দেয়ার নিয়ম রয়েছে৷ মূলত মানসিকভাবে অসুস্থ এবং ড্রাগে আসক্তরাই বেশি হারে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় অর্থ পায়৷ এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত জরিপে জানা যায় ড্রাগ আসক্তরা ড্রাগস কেনার অর্থ সংগ্রহের একটি উপায় হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে কাজে লাগাচ্ছে৷ কারণ এটি হলো অর্থ কামাইয়ের সবচেয়ে সহজ পথ৷ (অর্থকামাইয়ের সহজ পথ থাকলে সেটি সব সমাজের মানুষই গ্রহণ করে৷ এনিয়ে বাংলাদেশীদের আমেরিকা নসিহত করলেও নিজেদের দেশে তাদের ব্যর্থতা রয়েছে৷)

শেষ কথা

সত্য কথাটি কি জানেন, একজন মানুষের ভেতরটা যখন পচে যায় তখন দুর্গন্ধ বাইরে থেকেও পাওয়া যায়৷ এক কথাটি ব্যক্তির মতো একটি দেশের বেলায়ও প্রযোজ্য৷ আমেরিকা যখন নানান ছল ছুতোয় বিনা উস্কানিতে অন্য দেশে আক্রমণ করে নিরীহ মানুষ হত্যা করে৷ তারপর যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট দায়সারা গোছের দুঃখ প্রকাশ করে তখন বাইরের দুনিয়ায় আমেরিকানদের চরিত্রের যে স্বরূপটি ফুটে উঠে তা আমেরিকান সমাজের অভ্যন্তরীণ চিত্রের প্রতিচ্ছবি মাত্র৷

এখানে ঘুণে ধরা আমেরিকান সমাজের গুটি কয়েক উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে মাত্র৷ কি মনে হয় আমেরিকায় নাগরিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা আর মানবতার অবস্থান কেমন? আপনার কি মনে হচ্ছে না আমেরিকান সমাজ সভ্যতা, শিক্ষা আর অগ্রগতির নামে পঙ্কিলতায় আবর্তিত হচ্ছে৷ নিজ দেশে নীতি নৈতিকতার চর্চা হয় না বলেই আমেরিকানরা যুগে যুগে ভিনদেশে বোমা ফেলতে পারে, কিংবা পরমাণু বোমা খোজার অজুহাতে নির্বাচিত সরকার উত্খাত করতে পারে৷ আবার একই নৈতিকতা থেকে অন্য দেশে গিয়ে মানুষ ধরে নিয়ে যেতে পারে যেমন, ড্রাগের জন্য কলম্বিয়ার নরিয়েগাকে ধরে এনেছিল আমেরিকাতে কিংবা সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের কথা বলে ভিন দেশে বোমা ফেলতে এদের বাধে না৷ এসব দেখে কেউ যদি সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা হলো একটি স্ববিরোধী ও বৈপরিত্যের দেশ তা কি খুব বেশি বাড়িয়ে চিন্তা করা হবে?

এমন একদিন আসবে যখন সুটেড বুটেড কংকালসার আমেরিকান রাষ্ট্রের ভিনদেশে দাপট থাকবে৷ আর নিজ দেশের মধ্যে ঘটতে থাকবে একের পর নৈরাজ্যজনক ঘটনা৷ যা ঘটাতে বাইরের কোন শক্তির প্রয়োজন হবে না৷ দেশের মধ্যে তৈরি হওয়া অপ-সমাজ ব্যবস্থার দানবেরাই দেশটিকে গলা টিপে মারবে৷



খুনী আমেরিকা

এই লেখাটার শিরোণামে এক ধরনের শস্তা ব্যাপার আছে৷ পাঠককে আকৃষ্ট করার চেষ্টা আছে৷ লেখককে খেলো ভাবার কিছুটা ঝুঁকিও আছে৷ তারপরও এই শিরোণামটিই আমি বেছে নিলাম কারণ গত ১০ বছর ধরে আমেরিকা বিশ্বময় শত্রু খতমের খেলায় বেসামরিক নাগরিকদের যেভাবে হত্যা করেছে তাতে “খুনী” শব্দটির চেয়ে কোমল ও যথার্থ কোনো অভিধা আমি খুঁজে পাইনি৷

আমেরিকার জনগণের পক্ষে সেদেশের কংগ্রেস সর্বসম্মতিক্রমে ২০০১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্টকে খুনের লাইসেন্স দিয়েছিল৷ “অথরাইজেশন টু ইউজ মিলিটারি ফোর্স অ্যাক্ট” এর মাধ্যমে সেদিন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ওসামা বিন লাদেন ও আল কায়েদার অন্যান্য নেতাদের হত্যা করার জন্য আমেরিকার অভ্যন্তরে কিংবা বিশ্বের যেকোনো স্থানে হামলা চালানোর অনুমতি দেয়া হয়৷ তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ঘোষণা করলেন, “জাস্টিজ উইল বি ডান” (ন্যায়বিচার করা হবে)৷

সীতাকুন্ডে তিন পাহাড়ের মাটি কাটার অনুমতি নিয়ে ১১ পাহাড়ের মাটি কাটার মতোই এক ওসামা বিন লাদেন আর আল কায়েদকে শায়েস্তা করার অনুমতি নিয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বিশ্বজুড়ে নানান কায়দায় শত্রু খতমের খেলায় মেতে উঠে৷ শত্রু খতমের এই খেলা স্নায়ু যুদ্ধকালীন কমিউনিস্ট নিধনকেও ছাড়িয়ে যায়৷ গত দশ বছর ধরে পুরো বিশ্বকে এক ধরনের ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে আমেরিকা৷ ২৩৩৭ দিনের তান্ডব শেষে তারা মহাশত্রু ওসামা বিন লাদেনকে বধ করলো৷ বর্তমান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা করলেন, “জাস্টিজ হ্যাজ বিন ডান” (ন্যায়বিচার সম্পন্ন হলো)৷

প্রশ্ন থেকে যায়, নিরস্ত্র বিন লাদেনকে পাকড়াও করে বিচারের মুখোমুখি না করে গুলি করে হত্যা করাটাই কি ন্যায়বিচার? আরো অনেক প্রশ্নই করা যায়৷ যেমন: যে প্রক্রিয়ায় বিন লাদেনকে হত্যা করা হলো সেটি তো আরো আগেই করা যেতো৷ তাহলে বিন লাদেনকে এতোদিন কেন জীবিত রাখা হলো? তাহলে কি ওসামা বিন লাদেনকে জীবিত রাখার প্রয়োজন ফুঁরিয়ে গিয়েছিল বলেই তাকে খুন করা হলো৷ সেই খুনের ঘটনা স্টার সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখার মতো করে দেখেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, তাঁর পারিষদবর্গসহ৷ বিন লাদেনকে খুন করার জন্য তারা আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে ভিনদেশে হামলা চালাতেও দ্বিধা করেননি৷ মুভির কাহিনীর মতোই নায়কের বিজয় আর ভিলেনের পরাজয় হয়েছে৷

স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন চলাকালে বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট নিধনের অংশ হিসেবে আমেরিকা সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে লিপ্ত হয়৷ আর সেসময়ে আমেরিকা ওসামা বিন লাদেনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে৷ অনেকে মনে করেন, পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের পর লাদেনের তাত্ক্ষনিক প্রয়োজন আমেরিকার কাছে ফুরিয়ে গেলেও লাদেন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে গিয়ে নিজের প্রয়োজনকে ধরে রাখেন৷ তার এই ইমেজকে প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগায় প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর৷ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনার জন্য ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করে জর্জ বুশ সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ শুরু করে দেয়৷ লাদেন এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেননি৷ কিন্তু লাদেনকে সামনে রেখে আমেরিকা গত ১০ বছর ধরে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে বিশ্বময় এক ধরনের তান্ডব চালালেও ওসামা বিন লাদেনকে পাকড়াও করার ব্যাপারে আন্তরিক হয়নি৷ বরং বিশ্বজুড়ে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করে অস্ত্র বাণিজ্য এবং দেশে দেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠা আমেরিকান শত্রুদের শায়েস্তা করার মধ্য দিয়েই দিন কাটিয়েছে তারা৷ ইতোমধ্যে সাদ্দামকে খুন করেছে৷ সম্প্রতি গাদ্দাফীর এক পুত্র ও তিন নাতিকে খুন করেছে৷ অবশেষে লাদেনকে বধ করলো৷ কিন্তু এই হত্যা আমেরিকা সৃষ্ট গোলযোগ কি বন্ধ করতে পারবে? এই হত্যা কি বিশ্ব শান্তির জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে? আমি সেই প্রশ্নের উত্তর এই লেখাতে খুঁজবো না৷ আমি আমার লেখার শিরোণামের সপক্ষে কয়েকটি হত্যার ঘটনার কথা শুধু বলব৷ যে ঘটনাগুলোতে আমেরিকা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করেছে৷ যে হত্যার লাইসেন্স তারা আমেরিকান জনগণের কাছ থেকে নিয়েছে৷ ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে টুইন টাওয়ারে নিরীহ মানুষ হত্যার অপ্রমাণিত অভিযোগ (যা প্রমাণিত নয়) এর বিপরীতে বেসামরিক নাগরিক হত্যার প্রমাণিত অভিযোগ রয়েছে আমেরিকার বিরুদ্ধে৷ ওসামা বিন লাদেনের অপ্রমাণিত অভিযোগ প্রমাণের কোনো সুযোগ না দিয়ে, ন্যায়বিচার ছাড়াই তাকে হত্যা করা হলো৷ আর প্রমাণিত অভিযোগগুলোর কোনো বিচার নেই৷ কারণ, লাদেনকে হত্যা করার জন্য আমেরিকা যে সন্ত্রাস বিরোধী আইন করেছে তার একচেটিয়া সুবিধাভোগীও আমেরিকা৷ ফলে, আমেরিকা আমাদের দেশের গ্রামের মোড়লের আন্তর্জাতিক সংস্করণ৷ যারা সবসময় নিজের জন্য এক আইন ও অন্যদের জন্য পৃথক আইন ব্যবহার করে থাকে৷ অর্থাৎ তারা সালিশ মানি আর তালগাছটা আমার বলে থাকে৷

আমেরিকা যেসময়ে কমিউনিস্ট খতম করত, তখন কমিউনিস্টদের মধ্যে মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা থাকতো কিন্তু আমেরিকা যখন সন্ত্রাসী নির্মূলে মাঠে নামল কোনো এক অজ্ঞাতকারণে তারা মুসলমানদের টার্গেট করতে শুরু করল৷ ফলে, আমেরিকার সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানকে অনেকে ইসলাম বিরোধী অভিযান বলেও অনেকে গণ্য করে৷ তবে, এই বিষয়টিও আমার আজকের লেখার বিষয় নয়৷ আমার আজকের লেখার বিষয়টি খুবই সাধারণ৷ এক ঝলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমেরিকার বেসামরিক নাগরিকদের খুনের কয়েকটি ঘটনা মনে করা৷ কারণ, আমেরিকা কিভাবে কোথায় কত মানুষকে খুন করছে তার বিশদ বর্ণনা দিতে গেলে মহাকাব্য লিখতে হবে৷ আমেরিকার অগ্রগতির ইতিহাসের সঙ্গে, আমেরিকান সভ্যতার সঙ্গে খুন বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷

যেমন, ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০১ সালে পর্যন্ত আমেরিকাতে প্রায় ৫ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে, যাদেরকে প্রটেকশন দেওয়ার দায়িত্ব ছিলো সরকারের৷ অর্থাত্ বছরে গড়ে ২০ হাজার আমেরিকান মানুষ আমেরিকানদের হাতে খুন হয়েছে৷ আমেরিকাতে সর্বাধিক সংখ্যক ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহৃত হয়৷ একই সময়ে আমেরিকা ৭১৬ জন নারী ও পুরুষকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে৷ আমেরিকান পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যে নৃশংসতার অভিযোগ আছে তা লিখতে হলে পৃথক লেখা লিখতে হবে৷ শুধু তাই নয়, ২০০১ সালের হিসাব মতে, আমেরিকার জেলে প্রায় ২০ লাখ বন্দী ছিল যা বিশ্বের সর্বোচ্চ৷ এবং বিশ্বের মোট কারাবন্দীর এক চতুর্থাংশ৷ এই আমেরিকা ২০০১ সালের পর সন্ত্রাস নির্মূলে বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে তান্ডব শুরু করে জর্জ বুশের নেতৃত্বে৷ বারাক ওবামা যখন চমক দেখিয়ে ক্ষমতায় এলেন তখন অনেকে ভেবেছিলেন তিনি এই অন্যায় যুদ্ধ বন্ধ করবেন৷ তাঁর বেশ কিছু ঘোষণা সেই আশাবাদের প্রতিফলন ঘটায়৷ ২০০৯ সালে তিনি যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান তখন বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষগুলো নিরীহ বেসামরিক মানুষ হত্যা শেষ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল৷ কিন্তু বারাক ওবামা হলিউডি কায়দায় ওসামা বিন লাদেনকে খুন করে এবং এর রেশ আরো দশ বছর থাকতে পারে সেই আশঙ্কা ব্যক্ত করে খুনের রাজনীতিকেই সমর্থন জানালেন৷

২০০৯ সালে লক্ষ্য করা গিয়েছিল বারাক ওবামা জাতিসংঘের অস্ত্র বাণিজ্য চুক্তি (এটিটি) আলোচনায় অংশ নিতে সম্মতি জানিয়েছে৷ বুশ প্রশাসনের অধীনে পরিচালিত আমেরিকান সরকার একমাত্র দেশ হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অস্ত্র বাণিজ্য চুক্তি প্রক্রিয়ার বিরোধীতা করে আসছিল৷ অনেকেই মনে করেন, বিশ্বজুড়ে যে অগণিত জীবনহানি ঘটছে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই বিরোধীতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে৷ বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমেও আমেরিকা পরোক্ষভাবে মানুষ খুন করার পদ্ধতি চালু রেখেছে৷ যেমন: বারাক ওবামা ২০০৯ সালে কিউবার উপর ৪৭ বছর ধরে চলে আসা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা নবায়ন করেন৷ এই ধরনের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটিতে লাখ লাখ মানুষ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে৷ আমেরিকা জাতীয় স্বার্থে “ট্রেডিং উইথ দি অ্যানিমি অ্যাক্ট” এর আওতায় বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে৷ আমেরিকা ২০০৭ সালে ইউনিসেফের গাভি কর্মসূচির আওতায় কেনা ৩০ লাখ ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ সরবরাহের কার্যাদেশ বাতিল করে কিউবান শিশুদের জীবন বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল৷ তারা যখন জানতে পেরেছিল যে, সিরিঞ্জগুলো কিউবাতে যাবে তখনই কার্যাদেশ বাতিল করেছিল৷

আর আফগানিস্তানে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার ঘটনা তো একটা চলমান বিষয়৷ ২০০৯ সালে এক হিসেব মতে, বিভিন্ন ঘটনায় আফগানিস্তানে ২,৪১২ বেসামরিক নাগরিক মারা গিয়েছে৷ ২০০১ সালের পর থেকে প্রতিবছরের সংখ্যাটি কম বেশি এমনই৷ ২৫ জুলাই, ২০১০ তারিখে প্রকাশিত উইকিলিকসের প্রায় ৯২ হাজার গোপন ফাইল থেকে আফগানিস্তানে ২০০৪-২০০৯ সালের ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, আফগানিস্তানে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার ব্যাপারে আমেরিকান নেতৃত্বাধীন ন্যাটো কর্তৃপক্ষ উদাসীন৷ তখন বলা হয় যে, জবাবদিহিতা না থাকাই এই ধরনের হত্যার কারণ৷ আমেরিকা বেসামরিক নাগরিক হত্যার জন্য ওসামা বিন লাদেনদের জবাবদিহিতা খুঁজলেও নিজেদের জবাবদিহিতার ব্যাপারে তারা কতোটা উদাসীন নিচের ঘটনাগুলোতে দেখুন৷

১২ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তানের মারজাহ জেলার সীমান্ত এলাকার আমেরিকার ছোড়া দুটি মিসাইল একটি বাড়িতে আঘাত হানলে ছয়টি শিশুসহ অন্তত বারোজন মারা যায়৷ ন্যাটো এই ঘটনার জন্য মিসাইলের ত্রুটিকে দায়ী করে৷ পরেরদিন ১৩ ফেব্রুয়ারি অপারেশন মোশতারাক অভিযানে মারজাহ ও এর আশপাশের এলাকায় সামরিক অভিযানে অন্ততপক্ষে ১৫ জন বেসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে৷ ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখে কুন্দাজ প্রদেশের আমাখিলের নিকটবর্তী এক গ্রামে আকাশ হামলা চালালে ৮৩ জন বেসামরিক ব্যক্তি মারা যায়৷ আমেরিকা এবার বললো যে, তালেবানরা বেসামরিক বাড়িগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে৷ কিন্তু তাদেরকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে, তারা কেন ক্লিনিক ও হাসপাতালে হামলা চালায়৷ সেই জবাব তারা দেয় না৷ ২০১০ সালের আগস্টের ২৭ তারিখে পাকটিকা প্রদেশের একটি ক্লিনিকে হামলা চালানো হয় চিকিত্সারত তালেবান নেতাকে হত্যা করার জন্য৷ যা ছিল আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন৷

ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়, বেসামরিক মানুষদের হত্যা করে শুধুমাত্র ভুল স্বীকার করেও আমেরিকা মনে করেছে যে, তাদের দায়িত্ব পালন করা হয়েছে৷ যেমন, ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তালেবানবাহী গাড়ি ভেবে আমেরিকান সামরিক হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষন করা হলে ডাই কুন্ডি ও উরুঝগান প্রদেশের সীমান্ত এলাকাতে ২৭ জন বেসামরিক ব্যক্তি মারা যাওয়ার ঘটনায় আমেরিকা ভুল স্বীকার করে৷

আমেরিকা একা নয়, তার মিত্রদের বেসামরিক নাগরিক হত্যাকে তারা নীরবে ও সরবে অনুমোদন করে৷ যেমন: ইসরাইলী বাহিনী “কাস্টলিড” নামের ২২ দিনের অভিযানে (২৭ডিসেম্বর ২০০৮ থেকে ১৮ জানুয়ারি ২০০৯) ৩০০ এরও বেশি শিশুসহ প্রায় ১৪০০ ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছিল৷ ওই ঘটনায় আরো কয়েকশত মানুষ জখম হয়েছিল এবং কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছিল৷ ওই সময়ে শিশুরা প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় নিয়েও বাঁচতে পারেনি৷

উইকিলিকস প্রকাশিত কূটনৈতিক বার্তাগুলো থেকেও আমেরিকান সামরিক বাহিনীর বিশ্বজুড়ে হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলো জানা যায়৷ যেমন: ইয়েমেনকে না জানিয়ে আমেরিকা ২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর আবিয়ানের আল-মাজালাতে ক্রুজ মিসাইল ছুড়লে ১৪ জন নারী ও ২১ জন শিশুসহ সর্বমোট ৪১ জন মারা যায়৷ এই ঘটনা ধামাচাপা দিতে আমেরিকা ইয়েমেনের উপর চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি সামরিক সহায়তা বাড়িয়ে ২০০৯ সালের ৬৭ মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ২০১০ সালে ১৫০ মিলিয়ন করে৷ বিনিময়ে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ জনগণকে জানায় যে, এটি ভুলক্রমে তারাই করেছে৷ পরবর্তীতে আল কায়েদার সন্দেহভাজন সদস্যদের হত্যা করার জন্য মানুষবিহীন ড্রোন বিমান পাঠিয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় ফারাহ প্রদেশের বালা বালুক জেলায় আমেরিকা ১০০ এরও বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে৷ উইকিলিকস নথি প্রকাশ না করা পর্যন্ত এই সকল ঘটনার দায়দায়িত্ব সালেহ নিয়ে নিচ্ছিলেন৷ এভাবেই আমেরিকা আন্তর্জাতিক মানবিক ও মানবাধিকার আইনের লংঘন করে একের পর এক খুন করে চলেছে৷

তবুও খুনী আমেরিকা আমাদের কাছে পূজনীয় এক দেশ৷ আমাদের দেশকে মানবতা আর মানবাধিকার শেখাতে আমেরিকানরা নিয়মিত এই দেশে আসে৷ আর আমরা তাদের কাছ থেকে মানবতা শিখি৷ মানবাধিকার শিখি৷ ধন্য হই৷ কি বিচিত্র এই বিশ্ব৷

(রাইট টার্ন, মোহাম্মদ গোলাম নবী, সাপ্তাহিক বিপরীত স্রোত, বর্ষ ১, সংখ্যা ৮, মঙ্গলবার, ১০ মে ২০১১, ২৭ বৈশাখ ১৪১৮)
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×