ইদানিং ইসহাক সাহেবের সমস্যাটা মারাত্মক আকার ধারন করেছে। বিশেষ করে মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে টানটা যেন আরো বেড়েছে। প্রথম যখন কোন পাত্রপক্ষ তাঁর মেয়েকে দেখতে এলেন, সেই তখন থেকে সমস্যার শুরু। তিনি বলতে গেলে কপর্দকহীন। মেয়ের বিয়ে সামলানোর মত টাকা কোথায় পাবেন? সংসারে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
এমন কোন ঘটনার কথা তার মনে নেই, যা তিনি স্ত্রী’র কাছে গোপন করেন। কিন্তু এই টানের ব্যাপারটা কেমন যেন, স্ত্রীকে বলতে কোথায় যেন বাঁধছে। ডাক্তারের কাছে যাবার প্রস্তুতি প্রায় নিয়ে ফেলেছিলেন ইসহাক সাহেব। কিন্তু উনি বুঝতে পারছেন না বিষয়টা কি ভাবে ডাক্তারকে ব্যাখ্যা করবেন। শেষমেষ ডাক্তারের কাছে যাবার চিন্তা বাদ দিয়েছেন। কয়েকদিন নিজের মনের সাথে যুদ্ধে করে পরাস্ত হয়ে তারপর স্ত্রীকে বিষয়টি বলার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
একদিন সন্ধ্যায় ইসহাক সাহেব ড্রইং রুমের সাদাকালো টিভির সামনে বসে খবর শুনছিলেন। তাঁর স্ত্রী রান্না ঘরে, চা করছিলেন। ইসহাক সাহেব ধীরে ধীরে উঠে রান্না ঘরের দিকে এগুলেন। কোন ভনিতা না করে স্ত্রীকে বললেন, ‘মিতু শোন, আমার কিছুদিন ধরে..।’ স্ত্রী ইসহাক সাহেবের দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন, ‘কি?’ ইসহাক সাহেবের গলা কেঁপে উঠল, ‘ইয়ে.. কিছুদিন ধরে, ম্ম্ম্ কিছুদিন ধরে..’ তার দৃষ্টি দুধের টিনে আটকে গেল। একটু দম নিয়ে এক নিশ্বাসে বলে ফেললেন, ‘এই কিছুদিন ধরে আমার আর দুধ চা খেতে ইচ্ছে করছে না।’ স্ত্রী অবাক হয়ে গেলেন। যে মানুষ দুধ চা’র জন্যে পাগল, এক বসাতে কয়েক কাপ চা পান করে ফেলেন উনি কিনা...। তিনি স্বামীকে বললেন, ‘চা তো বানিয়ে ফেলেছি, আচ্ছা তুমি ড্রইং রুমে গিয়ে বসো আমি রং চা করে আনছি।’ ইসহাক সাহেব গোমরা মুখে ফিরে এলেন। যাস্স্ সালা কি বলতে কি বলে ফেলেছেন। এখন হাসি মুখে চিরতার রস গিলতে হবে।
তিনি ড্রইং রুমে না গিয়ে বেড রুমে ঢুকলেন। শার্ট পড়াই ছিল, তাড়াতাড়ি প্যন্টটা পড়ে কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে গেলেন। রাস্তায় বের হয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে শুরু করলেন। তার স্ত্রী চা নিয়ে ড্রইং রুমে এসে দেখলেন টিভি চলছে। দর্শক হিসেবে সোফায় বসে আছে চার পাঁচটি সুসজ্জিত কুশন। ড্রইং রুম, বাথরুম, বেডরুম কোথাও স্বামীকে না দেখে তিনি মোবাইলে ফোন করলেন। এবং একটু পরেই ভ্রু কোঁচকালেন। ভ্রমরের ডাক শোনা যায় কোত্থেকে? দেখতে পেলেন, স্বামীর মোবইলটি ড্রেসিং টেবিলের উপর ভাইব্রেট হচ্ছে, রিংগিং টোন বন্ধ।
ইসহাক সাহেব ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন। ফুটপাতের সাথে লাগোয়া যত্নহীন পার্ক। মেয়ের কথা মনে পড়ল আবার। ওর শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা খুবই ভাল। বিয়েতে তিনি তেমন কিছু দিতে না পারলেও তাদের কোন অভিযোগ নেই। শুধু জামাই বাবাজির বিধবা বোনটি নাকি নানান বিষয়ে আড়েঠাড়ে খোঁটা দেয়। শশুর মশাইও মাঝে মাঝে মেয়ের পক্ষ নেন। নিবেনইতো, মেয়ে বলে কথা। তবে শাশুড়িটা নাকি সবসময় নীতুর পক্ষে থাকেন, মেয়েকে মোটেই পাত্তা দেন না। ওই বাসায় একজন মাঝবয়সী পুরনো লোক আছে। দশ বারো বছর বয়সে নাকি লোকটা সেখানে এসেছিল। জামাই বাবাজীর দাদার বাড়ীর লোক। এসব কথা তার কাছ থেকেই শোনা। ইসহাক সাহেব হঠাৎ পেছন দিক থেকে আলতো করে হেঁচকা টান অনুভব করলেন। চমকে উঠে সাথে সাথে পেছন ফিরে তাকালেন, নাহ্ কেউ নেই। পা-টা টলে উঠল নাকি? বাসায় চিন্তিত বউয়ের চিন্তা তার মনে একটুও রেখাপাত করছিল না। কারণ তিনি নিজেই তখন ডুবে গেছেন গভীর চিন্তায়। কে টানে তাকে?
ইসহাক সাহেব হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলেন চার পাঁচ গজ সামনে ফুটপাত ঘেঁষে একটা সিমেন্টের বেদী। তার উপর এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক বসে আছেন। হাতে নেভানো সিগারেট। কাছে গিয়ে দেখলেন, পাজামা পাঞ্জাবী পড়া লোকটির চোখ গুলো লালচে দেখাচ্ছে। চুলগুলি পরিপাটি করে আঁচরানো। ইসহাক সাহেব লোকটির কাছ থেকে এক্সকিউজ চেয়ে নিয়ে পাশে খালি জায়গাটায় বসলেন। লোকটি বলল, ‘ওয়ালাইকুম আস্সালাম’। ইসহাক সাহেব থতমত খেয়ে বললেন, ‘জি? ইয়ে.. আস্সালামু আলাইকুম।’ জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে লোকটা বলল, ‘সম স্ স্ স্যাটা কি?’ ইসহাক সাহেব ঘামতে লাগলেন। আবার নিজেকে প্রবোধ দিলেন,‘ আমি একজন সৎ - নির্ঝঞ্জাট মানুষ, আমি তার খাই না পড়ি.. ভয় পাব কেন?’ তিনি গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন,
-জি.. আমার মেয়ের বিয়ে...
-আমি কোন সাহায্য করতে পারব না।
-না না সাহায্য লাগবে না। আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় ছ’মাস। বলছিলাম মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করেই সমস্যার শুরু।
-তা আমি কি করতে পারি?
-না মানে, ‘সমস্যা কি’ জানতে চাইছিলেন, তাই বলছিলাম আরকি। তাছাড়া আপনার চেহারায় একটা ‘ভাল মানুষ’ ভাব আছে... ভাবলাম সমস্যাটা আপনাকে বলা যায়..
-বাহ্ বেশ বেশ, তা বলুন আপনার সমস্যা.. শোনা যাক।
-ইয়ে আমি যখন হাঁটি, মাঝে মধ্যে কে যেন আমাকে টানে। কখনো পেছন থেকে কখনো বা পাশ থেকে।
-টানে মানে?
-মানে ঠিক হাত ধরে টানা নয়.. মানে কে যেন আমাকে আকর্ষন করে আরকি। কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাই না।
-ও বুঝতে পেরেছি, সমস্যা গুরুতর। তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন ভাই, আপনাকে আর যেই টানুক না কেন আমি অন্তত টানি না।’
ইসহাক সাহেব ভ্যবাচেকা খেয়ে গেলেন। লোকটা চিন্তিত ভাবে নেভানো সিগারেটটা ধরালেন। ইসহাক সাহেবের নাকে গাঁজার গন্ধ এসে লাগল। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে হনহন করে হাঁটা শুরু করলেন। পেছন থেকে লোকটার গলা শোনা গেল, ‘আরে ভাই এই জীবনে একমাত্র আপনিই বুঝতে পারছেন যে আমি একজন ভাল মানুষ, শুনে যান.. সমস্যার সমাধান শুনে যান।’ ইসহাক সাহেব হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। আরে আরে.. একি! আবার কে যেন টানছে। আবারও চমকালেন, নাহ্ এবারও কেউ নেই। একটা আলগা ইটে পা পড়েছিল বোধ হয়!
আচ্ছা তিনি কি পাগল হয়ে যাচ্ছেন? এই বাষট্টি বছরের একজন লোককে কে টানাটানি করবে? তিনি রাস্তার পাশে একটি ঝুপড়ি মত দেখতে চা’র দোকানে ঢুকে একটি টেবিলে গিয়ে বসলেন। টেবিলের উপর পড়ে আছে ব্যবহৃত পানির গ্লাস আর চা’র কাপ। ইসহাক সাহেব কিছু ভাবতে পারছেন না। তাঁর সব চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নীতু ফোন করেছিল কখন যেন.. ও হ্যাঁ.. পরশু। তার বড় মায়া হল। মেয়েটা তাকে কখনও তেমন কোন আবদার করে নি। সে ছোটবেলা থেকেই তার বাবার আর্থিক অবস্থার কথা কিভাবে যেন জেনে গেছে। ওদিন কত কাচুমাচু করেই না সে ফ্রিজের কথাটা বলল। তার শশুর বাড়ীর ফ্রিজটা নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। বিয়েতে তাকে কিছু দিতে পারেননি ইসহাক সাহেব। আচ্ছা বিয়েতে তেমন কিছু না দেয়ায়, নীতুকে শশুর বাড়ীর লোকেরা হেনস্থা করে নাতো?
গতকাল অবশ্য তিনি ‘শ্যাকলকের’ শোরুমে গিয়েছিলেন। ফ্রিজটা খুবই উন্নত মানের। তবে দামটা একটু বেশী। পঁচিশ হাজার টাকা। এত টাকা তিনি কোথায় পাবেন? অন্যমনষ্ক ইসহাক সাহেব চা’র কাপটা ঠোঁটে ছোঁয়ালেন। আরে কাপে তো চা নেই। হোটেল বয় কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তিনি টেরও পাননি। বয়টি বলল, ‘স্যার চা দেব?’ তিনি লজ্জা পেয়ে গেলেন। আরেক জনের এঁটো চা’র কাপটা তাঁর হাতে ধরা। তিনি আরষ্ঠভাবে হেসে চা দিতে বললেন। বয় টেবিলটা মুছে আগের কাস্টমারের এঁটো কাপ আর গ্লাসটা নিয়ে চলে গেল। ইসহাক সাহেব ঠিক করলেন অফিস থেকে আবার লোন করবেন। আগের পনের হাজার এখনও শোধ করা হয়নি। কোন উপায় নেই। একটু কষ্ট হবে, তবু তিনি ফ্রিজটা কিনবেন। ইসহাক সাহেব চমকে উঠলেন, চেয়ারের পেছন থেকে আচমকা কে যেন টান দিল। নাকি চেয়ারের খুঁটি ভালভাবে বসে নি?
ইসহাক সাহেব বাইরে থেকে সোজা ড্রইং রুমে ঢুকে টিভি’র সামনে বসলেন। তিনি ঠিক করলেন রাতে আজ কিছু খাবেন না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বেন। তার স্ত্রী ভেতরের রুম থেকে এসে তাকে দেখে চমকে উঠলেন, ‘কখন এলে?’ ইসহাক সাহেব বললেন, ‘চা কই?’ তার স্ত্রী কিছু না বলে দরজা বন্ধ করে পাশে এসে বসলেন,
-এখানে একা একা কি করছ?
-টিভি দেখছি।
-টিভি তো বন্ধ।
-আহ্ বক বক করো না তো।
স্ত্রী’র চোখ দু’টি ছল ছল করে উঠল। তিনি স্বামীর হাতে হাতে রেখে জিজ্ঞেস করলেন,
-ক’দিন ধরে লক্ষ্য করছি তুমি সব সময় কি যেন চিন্তা করছো, কি হয়েছে তোমার.. আমাকে বল।
ইসহাক সাহেব আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। বাচ্চা ছেলের মত স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন। বললেন,
-আমাকে টানে।
-কে?
-ইয়ে.. ইয়ে মানে মেয়েটার জন্য মনটা বড় টানে।
ইসহাক সাহেবের স্ত্রী একটু হালকা বোধ করলেন,
-তা একবার গিয়ে ঘুরে আসলেই পার।
-ওখানে যেতেই লাগবে দু’দিন, তাছাড়া অফিস ফেলে এখন যাওয়া সম্ভব না।
-তা হলে মেয়েকে আসতে বলি, জামাই নিয়ে এসে ঘুরে যাক।
-না না, ওর এ অবস্থায় আসা ঠিক হবে না। ইয়ে.. মিতু.. পঁচিশ হাজারটা টাকা খুব দরকার..
-হঠাৎ অত টাকা.. কেন?
-ভাবছি মেয়েকে বিয়েতে তেমন কিছু তো দিতে পারিনি, একটা ফ্রিজ কিনে দিব।
দুপুর বেলার ভাত ঘুমে ইসহাক সাহেব স্বপ্ন দেখছিলেন। অফিসের লোনটা পেয়ে তিনি শ্যাকলকের শোরুমে ছুটছেন। ছুটছেন তো ছুটছেন.. ছুটছেন তো ছুটছেন। ছুটতে ছুটতে দরদর করে ঘামছে। শ্বাস প্রশ্বাস বাড়তে বাড়তে.. বাড়তে বাড়তে হঠাৎ তিনি চমকে উঠলেন, ডান পাশ থেকে কে যেন টান দিল তাঁকে। স্বপ্ন ভেঙ্গে তাকিয়ে দেখেন তাঁর ডান হাতটা স্ত্রীর হাতে ধরা। তাঁর স্ত্রী হেসে স্বামীর দিকে পেপারটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওঠ.. পত্রিকাটা দেখ।’
ইসহাক সাহেব ধীরে সুস্থে উঠে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলেন। চোখে চশমা লাগিয়ে, স্ত্রী’র হাতে ধরা পেপারের দিকে সরু চোখে তাকালেন। প্রথম পৃষ্ঠায় লাল কালিতে আন্ডারলাইন করা একটা কলাম চোখে পড়ল তাঁর। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কি মিতু?’ মিতু সামান্য এগিয়ে এসে স্বামীর চিবুকে হাত ছুঁইয়ে ঠোঁট টিপে হেসে বললেন, ‘প্রাইজ বন্ডের ড্র হয়েছে খোকা। মিলিয়ে দেখ, কিছু পেলে কিনা!’
ইসহাক সাহেব ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা বোধ করতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ চমকে উঠলেন! আচমকা সামনে থেকে একটা টান অনুভব করলেন তিনি। সামনেই পত্রিকা হাতে তাঁর স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। ইসহাক সাহেব চিন্তিত মুখে একবার পেপার আরেকবার স্ত্রী’র দিকে তাকাতে লাগলেন; টানটা কোনদিক থেকে এল?