বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এমন এক সময়ে অবস্থান করছে যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। আমরা সেই সব ব্যবস্থার দিকে নজর দেব, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে এবং একটি স্থায়ী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো হলোঃ
১. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে আইনের শাসন, যা সকল নাগরিকের জন্য সমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, শক্তিশালী বিচার বিভাগ এবং আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এই ব্যবস্থায় নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে:
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। বিচারক নিয়োগ এবং পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
আইনের প্রয়োগ: আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক শক্তি বা সামাজিক অবস্থান আইনের প্রয়োগকে প্রভাবিত করতে না পারে।
২. মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা
একটি স্থায়ী গণতন্ত্রের জন্য মুক্ত, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
স্বাধীন নির্বাচন কমিশন: নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রাখতে হবে, যাতে তারা রাজনৈতিক চাপ বা প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করতে পারে।
সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ: নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তবে তার পূর্বে অবশ্যই প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদী, কূটিল সকল কর্মকান্ড প্রত্যাহার করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পরিবারভিত্তিক রাজনীতির পলিসি বাতিল করে প্রতিটি দলেই সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োগ করতে হবে।
৩. রাজনৈতিক সংস্কার
বাংলাদেশের রাজনীতি প্রায়শই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও দলীয় প্রভাবের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কার:
দলীয় শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা: রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। দলীয় প্রধানদের ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ কমিয়ে দলীয় কাঠামোতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।
রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতা: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দেশের স্বার্থে দলীয় স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে কাজ করতে হবে। এজন্য উপযুক্ত যোগ্য ব্যক্তিকে দলের প্রধানের দায়িত্বে থাকতে হবে। এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে জনগণের নিকট জবাবদিহীতা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা
সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যম একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং জনগণের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে সহায়তা করতে পারে:
স্বাধীন গণমাধ্যম: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারে এবং সরকারের কার্যকলাপের উপর নজর রাখতে পারে।
সুশীল সমাজের সক্রিয় ভূমিকা: সুশীল সমাজকে আরও সক্রিয় হতে হবে, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচারে কাজ করতে হবে।
৫. শিক্ষা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নাগরিকদের সচেতনতা ও শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:
গণতান্ত্রিক শিক্ষা: শিক্ষাব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং নাগরিক অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিকভাবে গণতন্ত্রের মূল্য বুঝতে পারে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নীতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৬. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা
দুর্নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এজন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিতে পারে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা: প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দুর্নীতির সুযোগ কমে যায়। সকল সরকারি দপ্তর ও অফিস আদালত থেকে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। কোন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের কর্মস্থলে কোনরূপ রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকতে পারবে না। অথবা কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী রাজনৈতিক ছত্রছায়া কোনরূপ প্রাত্ষ্ঠিানিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। আর এই সু-শাসন ব্যবস্থা এমন হবে যে, যে কোন সাধারণ নাগরিক এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত যেকোন কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলে আইনের দৃষ্টিতে সমান থাকবে। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রি সহ অন্যান্য মন্ত্রিগণের ক্ষেত্রেও এ আইন সমানভাবে কার্যকর করতে হবে।
উপসংহার
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা ধাপে ধাপে অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, আইনের শাসন, সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংস্কার, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা, শিক্ষা ও জনসচেতনতা, এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণই পারে একটি স্থায়ী গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে তুলতে। এইসব উদ্যোগ সফল হলে, বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যা দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হবে।
এসকল প্রস্তাবনার বাইরে যদি কারো কোন প্রস্তাব থাকে, তবে তা কমেন্টে যোগ করে দিতে পারেন।
ছবিসূত্রঃ Click