আমরা যখন সামহোয়্যারইন ব্লগ বা অন্য যেকোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক করি, প্রথমেই আমাদের একটি প্রশ্ন সামনে আসে: এ ধরনের বিতর্কের কোনো ফলাফল কি আছে? আমরা কি সত্যিই সরকারের নীতিনির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারি? যদি না পারি, তবে কেন আমরা আওয়ামী লীগ-বিএনপি বা সাধারণ জনগণ হিসেবে নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক করি?
প্রথমেই একটি সত্য স্বীকার করে নিতে হবে—সামহোয়্যারইন ব্লগ বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যে কোনো সাধারণ নাগরিক সরকারের নীতিনির্ধারণে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে না। এর কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে:
১. প্রভাবের সীমাবদ্ধতা: অধিকাংশ ব্লগার ও পাঠক সাধারণ জনগণের অংশ, যাদের হাতে ক্ষমতা নেই এবং যারা সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। তারা শুধু নিজেদের মতামত ব্যক্ত করে, যা হয়তোবা কিছু মানুষের চিন্তা-ভাবনা পরিবর্তন করতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সরকার বা নীতিনির্ধারকদের মনোভাব পরিবর্তন করার সামর্থ্য নেই। তাহলে কেন আমরা এখানে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে এতটা মতবিরোধ তৈরি করি? কারণটা কি তবে আমরা নিজেরা যেটা ভাল করতে পারি না, সেটা যদি অন্য কেউ করে হিরো হয়, তাতে আমাদের কি সমস্যা? তাহলে কি আমরা অন্যের ভালোটা সহ্য করতে পারি না।
২. তথ্য এবং বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা: অনেক সময় ব্লগে প্রকাশিত মতামত বা বিশ্লেষণগুলো পূর্ণাঙ্গ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে হয় না। শুধুমাত্র ব্যক্তি ধারণা ও সীমিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মতামত তৈরি হয়, যা নীতিনির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় গভীরতা ও বিশ্লেষণ থেকে বঞ্চিত।
৩. অতীতের প্রভাবহীনতা: পূর্বের অভিজ্ঞতা বলে যে, অনলাইন বিতর্ক এবং ব্লগিং নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বড় ভূমিকা রাখতে পারেনি। যখনই রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের কথা আসে, তখন বাস্তবিক কার্যকরী পদক্ষেপ প্রয়োজন হয়, যা ব্লগের মাধ্যমে অর্জিত সম্ভব নয়। কিন্তু তবুও আমরা জ্ঞানচর্চার এই মাধ্যমটিকে রাজনৈতিক জিঘাংসা চরিতার্থ করার কাজে ব্যাবহার করি, এটা কি আদৌ কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনে? নাকি শুধু শুধু অচেনা ব্লগারগণ একে অন্যের মতবিরোধ থেকে ব্যক্তিবিরোধে লিপ্ত হয়ে পড়ে?
তবে, এই বিতর্ক এবং আলোচনার কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। যদিও আমরা সরাসরি নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারি না, তবু এ ধরনের আলোচনা সমাজের একটি গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা তৈরি করতে সাহায্য করে। সাধারণ জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং দায়িত্ববোধ গড়ে ওঠে। পাশাপাশি, সামাজিক সংহতি এবং মতবিনিময়ের একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়, যা পরোক্ষভাবে হলেও গণতন্ত্রের শিকড় শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। কিন্তু এখানেও কিছু কিছু অতিজ্ঞানী ব্লগারগণ নিজেদের কথার জালে অনেক অন্যায়-কে ন্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে লেগে পড়ে, যা সুষ্ঠ তর্ক-বিতর্ক বা নির্মল জ্ঞানচর্চায় বিঘ্ন ঘটায়।
শেষ কথা: সামহোয়্যারইন ব্লগে আওয়ামী লীগ-বিএনপি বা অন্য যে কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক হয়তো সরাসরি নীতিনির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখবে না। কিন্তু এটি একটি ক্ষেত্র তৈরি করে, যেখানে সাধারণ জনগণ নিজেদের চিন্তা ও মতামত প্রকাশ করতে পারে, এবং একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। এটি গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশে অবদান রাখে। তাই আসুন আমরা প্রত্যেকে একটি সুন্দর সত্যিকারের বাংলাদেশ গড়ার জন্য এগিয়ে আসি এবং এ লক্ষ্যে আমাদের মতামত যথেষ্ট যুক্তিসহকারে উপস্থাপন করি। কেউ যদি ভালো কিছু কাজ করে, তবে তাকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করি, তার ভুলত্রুটি খুঁজে বের করে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করি। আমরা মানুষ কেউই বিতর্কের উর্ধ্বে নয়, বা কেউই মহাজ্ঞানী বা নিষ্কুলুষ নয়, আমাদের মধ্যে মানবীয় গুণাবলী যেমন রয়েছে, তেমনি দানবীয় বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। আমরা নিজেকে কি ভাবে উপস্থাপন করব তা নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত চরিত্রের উপর। আমি যেটা করতে পারি না, তা যদি অন্য কেউ পারে তাহলে কেন আমি তার দোষত্রুটি খুঁজে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করবো? বরং তাকে অভিনন্দন জানাবো এমন একটা দুরূহ কাজ সে করতে পারছে সেজন্য।
এ সকল বিষয়ে নির্দ্বিধায় সকল ব্লগারগণের মন্তব্য ও পরামর্শ চাই।