প্রতিক্রিয়া
তোমার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদটা যখন এলো,তোমার বউ একটুও কাঁদেনি।কারণ প্রতিক্রিয়ার ধরণটা কেমন হওয়া উচিৎ সে বুঝে উঠতে পারছিলো না।
গল্প পড়তে তুমি ভালোবাসতে খুব, তবে কোন গল্পকারকেই তোমার কখনো পছন্দ হয়নি। গল্পযে মানুষের বাস্তবতাকে নগ্নভাবে চিনিয়ে দিতে পারে, প্রকাশ্যে জানিয়ে দিতে পারে তার গোপন স্বভাব, সেটা কখনোই বিশ্বাস হয়নি তোমার। সেদিন অবশ্য তুমি বিস্মিত হয়েছিলে যেদিন তোমার ও নওরিনের প্রেমের ঘটনাটা দেখতে পেলে গল্পের ছাঁচে।‘হতে পারে’ বলে একটা অবহেলার ভাব দেখিয়ে চলে গিয়েছিলে।তবে যেদিন তোমার বউ জ্যেতিরিন্দ্র নন্দীর গল্পের বইটা হাতে ধরিয়ে দিলো সেদিন এই অবহেলার ভাবটা রুপান্তরিত হলো তাচ্ছিল্যে।‘সমুদ্র’ গল্পটপার কথা তুমি আগেই শুনেছিলে আর হেসে বলেছিলে-‘যত্তসব গাঁজাখুঁরি গল্প, কারো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই সমুদ্রকে খাওয়াতে যাবে, বউ বিসর্জনের তো প্রশ্নই আসেনা; উন্মাদের কাছেও বউ বড় প্রিয় বুঝলে? আর পেটে যখন কিছু পড়বেনা তখন ওই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মায়া গ্যাস হয়ে কোথায় উরে যাবে টেরও পাবেনা।’ খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে তোমার বউ, উচ্চবাচ্চ করেনা কখনো, কিন্তু সেদিন তার যে রূপ তুমি দেখেছিলে তা ভুলতে পারনি এখনো। মুখে তার কোন কথা ছিলোনা শুধু বট ফলের মত লাল হয়ে উঠেছিলো চোখ।বিশেষ কিছুই বলে নি কেবল বলেছিলো ‘পড়ে দেখো’। তুমিও না পড়ে পারনি।গল্পের শুরুতেই একটা উত্তেজনা ছিলো, প্রথম লাইনেই প্রকাশ-‘সে রাত্রে আমি ঘুমোতে পারিনি।’ তারপর গল্পটার সাথে চলতে শুরু করলে তুমি। বারবার মনে হচ্ছিলো ‘ধুর কি যে পড়ছি এত মনোযোগ দিয়ে’ কিন্তু কিছুতেই উঠতে পারছিলে না। সমুদ্রের গর্জন, ঢেউয়ের আছাড়, বাতাসের মাতলামি আর উদ্ভট মামা চরিত্রটি আবিষ্ট করছিলো তোমাকে। এক এক সময়ে শিউরেও উঠছিলে কিন্তু নিজেকে লাগামছাড়া হতে দাওনি। কি প্রভাব, ‘কি দূর্দান্ত প্রতাপ সমুদ্রের! মানুষটাকে পাগল বানিয়ে ছাড়লো? মানুষের কথায় মানুষ প্রভাবিত হয়, কিন্তু একটা নির্বাক প্রাকৃতিক বস্তু দিয়ে মানুষ এতটা আবিষ্ট হতে পারে কি, যা তাকে বদ্ধ উন্মাদে পরিণত করবে? সত্যিই কি এতটা ক্ষমতা সমুদ্রের?’
গল্পটা পড়া শেষ করলে তুমি। নিজের বিশ্বাসকে কখনোই ভাঙতে চাওনি আজও ভাঙলেনা।‘গল্পকার গল্প লেখে মন ভোলাতে, বিনোদনের জন্য, তাই তার প্রয়োজন বিচিত্র বিষয়।এই গল্পটাও একটা অদ্ভুত বিষয়কে তুলে আনার প্রয়াসেই লেখা যার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই।’ মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে বিছানায় গেলে, ইচ্ছে ছিলো বউকেও শোনাও কিন্তু রাত বেড়ে গেলো আর সেও ঝিম ধরা পাখির মত গভীর ঘুমে মগ্ন।শরীরটা খুব ক্লান্ত ছিলো তোমার তবু ঘুম নেই, কোথায় যেন একটা প্রশ্ন একটা পরখ করার বাসনা। মনে আনতে না চাইলেও বার বার মনে আসছিলো গল্পের লাইনটা-‘সমুদ্র যেন সাংঘাতিক জীবন্ত একজন কেউ।’ সে রাতে যে তোলপাড় তোমার মনে চলছিলো তার কারণও তুমি বুঝতে পারনি কখনো।এরপর চলে গেলো কয়েকদিন। তুমি অফিস কামাই করতেনা সহজে, বউয়ের আব্দারে এবারে ছুটিটা একটু বেশিই নিয়ে ফেলেছিলে বলে সেই মাসে তোমার জন্য কোন ছুটি বরাদ্দ ছিলোনা, যদি কামাই দাও তবে চাকরিটা খোয়াতে হবে। তাই যে বাসনাটা বারবার তোমার মনে জাগছিলো তা পূরণ করা ছিলো অসম্ভব যাকে অতিক্রম করাও তোমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। তবে প্রতিরাতে যে প্রচণ্ড আকর্ষণ তুমি অনুভব করছিলে তা কাটানো কঠিন হচ্ছিলো তোমার পক্ষে। বউকে তুমি জানিয়েছিলে বিষয়টা। তবে অবহেলাটুকু, আকর্ষণটুকু গোপনই ছিলো তার কাছে।হঠাৎ করেই তুমি চলে গেলে বন্ধুর সাথে সমুদ্র দেখতে। বলে গেলে দুদিন পরেই ফিরে আসবে। আজ দুবছর হতে চললো তুমি আসনি, আসবে কিনা তাও জানোনা।এখন তোমার বউয়ের হাতে প্রিতিদিন সেই বইটা থাকে, খোলা থাকে একটা পৃষ্ঠা শিরোনামে লেখা-‘সমুদ্র’।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




