জর্জ অলওয়েলের একটা সুন্দর উক্তি আছে, "সাংবাদিকতা হচ্ছে তা প্রকাশ করা যা কেউ প্রকাশ করতে চায় না। বাকি সব 'পাবলিক রিলেশন' (পিআর)।"
২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর আন্তর্জাতিক চাপ ছিল, আর বাস-ট্রেন পুড়িয়ে মানুষ মেরে লাগাতার হরতাল দিয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয়ভাবে একটা চাপ তো তৈরি করছিলোই। সবার প্রশ্ন ছিল কে করলো এই হামলা।
সিআইডির মুন্সী আতিক এই চাপের কাছে পরাজিত হয়েছিলো। তড়িঘড়ি করে জজ মিয়া নামে একজনকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ানো হয়েছিলো। তদন্ত কর্মকর্তার উপর যে চাপ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় জজ মিয়ার বক্তব্যেই। সিআইডির কর্তারা তাকে বলেছিলেন, "তুই বাঁচ, আমাদেরকেও বাঁচা।"
কিন্তু তারপরও সেই সরকারের চোখে এই অসঙ্গতি ধরা পড়ার পরে পরই তারা তদন্ত কর্মকর্তা বদল করেছে। এবং সেই সরকারের আমলেই মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
২০০৭ সালে যখন আবার তদন্ত শুরু হলো এবং সিআইডি তদন্ত করছিলো তখন নভেম্বর মাসে মুফতি হান্নান একটা জবানবন্দি দেয়। সেই জবানবন্দি নেয়ার আগে শেখ হাসিনাসহ আরও বহু মানুষের সাক্ষ্য নেয়া হয়।
অবশেষে ২০০৮ সালের মাঝামাঝি বর্তমান আইজিপি ও তৎকালীন সিআইডি কর্মকর্তা জাবেদ পাটওয়ারী মিডিয়ায় ব্রিফ করেন যে এই হামলায় জড়িত হিসেবে তারা ২২জন মানুষের নাম পেয়েছে। যাদের মধ্যে একজন বাদে বাকি সবাই হুজি-বির সদস্য।
এই চার্জশিটের উপর ভিত্তি করে কিন্তু বিচারও শুরু হয়ে গিয়েছিলো এবং তা ঠিকঠাক মত এগোচ্ছিলো। কিন্তু বাদ সাধে আওয়ামী লীগ, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর।
যদিও এর আগে যখন আদালতে চার্জশিট দাখিলের সময় তারা কোন নারাজি দেয়নি, কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর তাদের মনে হলো যে চার্জশিটে আরও কিছু নাম ঢুকানো উচিৎ।
তাই অধিকতর তদন্তের নামে মুফতি হান্নানের উপর নিজেদের পছন্দের পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন চালিয়ে তারেক রহমানসহ আরও অনেক জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের নাম বের করা হয় যারা জীবিত থাকতে তাদের আসনে তাদেরকে হারানো আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
অবশ্য মুফতি হান্নানকে দিয়ে ২০১১ সালে যে জবানবন্দি দেয়ানো হয়েছিলো সেখানে অনেক গোঁজামিল ছিল, মিথ্যা গল্পে গোঁজামিল থাকাটাই অবশ্য স্বাভাবিক। যেমনঃ
০১/ মুফতি হান্নান এর আগে প্রতিটি ঘটনার সঠিক সঠিক দিন-সময়-স্থান বলতে পারলেও তারেক রহমানের সাথে বৈঠকের তারিখ-সময় একবারও মনে করতে পারেননি। কারণ তারেক রহমানের মত পাবলিক ফিগার কবে-কখন-কোথায় গিয়েছিলেন সবকিছুর প্রমাণ আমাদের হাতে আছে, তাই কোন নির্দিষ্ট সময় বললে সেটা প্রমাণ করা অসম্ভব হয়ে পড়তো প্রসিকিউশনের জন্য।
আর শুধু তারেক রহমানই না, এই বৈঠকে লুৎফুজ্জামান বাবর, আলী আহসান মুজাহিদ, এনএসআই-ডিজিএফআই প্রধানসহ অনেকের উপস্থিত থাকার কথা উল্লেখ আছে। এত হাই প্রোফাইল মানুষের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এক জায়গায় থাকা প্রমাণ করাটা ছিল প্রসিকিউশনের জন্য আরও অসম্ভব।
০২/ মুফতি হান্নান বৈঠকে তার সাথে আবু জান্দাল-শেখ ফরিদের উপস্থিত থাকার কথা বলেছেন। কিন্তু আবু জান্দাল বা শেখ ফরিদের জবানবন্দিতে এই বৈঠকের কথা উল্লেখই নাই। কিংবা তাদের জেরাতেও উঠে আসেনি।
এই অবস্থায় মুফতি হান্নানকে জেরা করা হলে গোঁজামিলগুলো একে একে ধরা পড়ে যেত।
ফৌজদারি মামলায় জেরার শুরু হয় সাধারণত শনাক্ত করার মধ্য দিয়ে। তারেক রহমান পাবলিক ফিগার হলেও, সামরিক আর পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউই পাবলিক ফিগার নন। তাই মুফতি হান্নানের পক্ষে তাদেরকে শনাক্ত করাও সম্ভব ছিল না।
তাই যেকোন মূল্যে এই জেরা আটকানোর ফন্দি আঁটে আওয়ামী লীগ। এবং জেরার আগে আগে মুফতি হান্নানকে অন্য একটি মামলায় ফাঁসি দিয়ে সত্য প্রকাশের পথগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।
এই অবস্থায় কোন সভ্য দেশের আদালতের মুফতি হান্নানের মত ব্যক্তি, যে দুইবার জবানবন্দি দিয়েছে, যার প্রথম জবানবন্দির সাথে দ্বিতীয় জবানবন্দির মিল নেই, এর উপর যাকেও জেরাও করা হয়নি, তার জবানবন্দিকে আমলেই নিতেন না।
কিন্তু যেহেতু এইটা বাংলাদেশের আদালত, যেখানে বিচারকদের ডিজিএফআই-এর ভয় দেখিয়ে আইন সচিবের লেখা রায় পড়তে বলা হয়, সেখানে মুফতি হান্নানের এই অগ্রহণযোগ্য বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে এতজন মানুষের ফাঁসি এবং যাবজ্জীবনের রায় হয়ে গেল।
একজন মানুষকে জেরা করার সুযোগ না দিয়ে, তার দুইটা জবানবন্দির উপর ভিত্তি করে, এভাবে ডজন ডজন মানুষের ফাঁসি-যাবজ্জীবন হয়ে যাওয়াটা শুধু হাস্যকর নয়, দেশের বিচারব্যবস্থার একটা কলঙ্ক।
কিন্তু এই দেশের একটা মিডিয়াতেও আপনি দেখবেন না এই প্রশ্নগুলো তোলা হচ্ছে। একটা মেরুদণ্ডী সাংবাদিক নাই এই বিষয়গুলো নিয়ে শুধু দুইটা প্রশ্ন করবে।
কেউ এই যৌক্তিক প্রশ্নটা করতে পারছে না- 'মুন্সী আতিকের জজ মিয়া দায় সরকারের ঘাড়ে বর্তালে মুফতি হান্নানকে গ্রেফতারের কৃতিত্বও তো সরকারেরই প্রাপ্য। সরকার নিজেই যদি মুফতি হান্নানকে দিয়ে গ্রেনেড হামলা করিয়ে থাকে, তাহলে সরকার নিজেই আবার তাকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করলো কেন?'
সাংবাদিকদের কাজ সত্য খুঁজে বের করা এবং তা প্রকাশ করা। কোন দলের মতামত প্রচার করা না। দলের মতামত প্রচারের কাজ দলগুলোর পিআর সেকশন করবে। আর যদি কোন সাংবাদিকের কোন দলের পিআরের কাজ করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে তার সাংবাদিকতা বাদ দিয়ে সেই দলে যোগ দেয়া উচিত।