সাতকাহনের দীপাবলি বন্দোপাধ্যায়ঃ
সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র দীপা ছিলো সাহসী ও স্বতন্ত্র চরিত্রের অধিকারীনি এক নারী।যার নামের মধ্যেই নিহিত ছিলো অন্ধকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পুর্বাভাস।সাহস আর একাগ্রতা ছিলো বলেই নিজের দুঃস্বপ্নবৎ নিষ্ঠুর অতীতকে মুছে ফেলে শুরু করেছিলো নতুন জীবন, জয় করেছিলো নিজের ভাগ্য,পড়াশুনা।কাছের মানুষ এমনকি নিজের মায়ের ঘৃণা,শত্রুতা,তাদের ভিতরকার বিভৎস লোভী চেহারাও দীপাকে পর্যুদস্ত করতে পারেনি।সে সময়ের কাঁধে মাথা ঠেকিয়েছে, কিন্তু ভেঙ্গে পড়েনি।কাছের মানুষ বলতে কেউই ছিলোনা দীপার,দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলার সময় কেউ কাঁধ বাড়িয়ে দেয়নি দীপার দিকে।সুযোগ ছিলো অনেক,চাইলেই তা হাত বাড়িয়ে নিতে পারতো দীপা।কিন্তু তা সে করেনি।সাধারনের মাঝেই দীপা অসাধারন।যার জীবনে এসে মিশেছে নানা নাটকীয়তা,আর এসব নাটকীয়তাকে ছাপিয়েই যার জীবন এগিয়ে গেছে সমান্তরালভাবে-সেই দীপা। দীপাবলি বন্দোপাধ্যায়।
কোথাও কেউ নেই এর মুনাঃ
মুনা সাধারন ঘরের আটপৌঁঢ়ে নারী। শান্ত-শিষ্ট, আর কোমল মনের অধিকারিনী।মুনার আশেপাশে এমন অসংখ্য মানুষের বসবাস ছিলো যাদের জীবনে মুনার প্রয়োজন অনেক,কিন্তু এত মানুষের ভীড়েও মুনা ভীষন একা।মুনা বেশ সেবাপরায়না এক মেয়ে,নিজে চাকরী করে মামা-মামীর সংসার চালিয়েছে।কখনো মুখ খুলে কারো কাছে কিছু চায়নি,তাই হয়তো জীবন তাকে কিছুই দেয়নি।জীবনের নানা জটিলতা আর সংগ্রাম মুনাকে রূঢ় হতে বাধ্য করেছে।মুনা হেসেছে,কেঁদেছে,রাগ করেছে,ঘৃনা করেছে,আবার ভালোও বেসেছে ভীষন।তারপরও জীবন নাটকের শেষ দৃশ্যে মুনাকে একাই থাকতে হয়েছে।
পথের পাচালীর দুর্গাঃ
দুর্গা বাংলার চিরাচরিত চঞ্চল কিশোরী কন্যার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি।দুর্গার চঞ্চলতা,হাস্যময়তা,ছোট্ট ভাইটির প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা দুর্গা চরিত্রকে মোহনীয় করে তুলেছিলো।দুর্গাকে ভালোবাসেনি, দুর্গার মৃত্যুতে কাদেনি এমন লোক খুব কমই আছে!আর এ সবই সম্ভব হয়েছে দুর্গা চরিত্রের ব্যাপকতার জন্য।এই উচ্ছল চপলা বঙ্গকিশোরী সাধারন কোন মেয়ে ছিলো না।সেই শৈশবেই নারীসুলভ স্বকীয়তায় বিশেষিত হয়েছিলো সে।যেন বুড়ী একটা মেয়ে, সব বুঝে!ট্রেনের ঊঁ ঝিঁক ঝিঁক শব্দে অপু আর দুর্গার দৌড় কল্পনা করে আমিও পিছু নিতাম ওদের।সত্যি সাহিত্যের এক অবিস্মরনীয় সৃষ্টি এই দুর্গা।
পদ্মা নদীর মাঝি এর কপিলাঃ
কপিলা রহস্যময়ী এক নারী।দারিদ্র্য,সামাজিক হেয়তা,নীচতা, মাঝিপাড়ার কোলাহল এইসবের মাঝেও কপিলা চরিত্র ছিলো নিজ স্বকীয়তায় পরিপুর্ন।লোভ, ঘৃনা,প্রেম, রিপুর তাড়না,বাচার ইচ্ছে,উচ্চাকাংক্ষা সব মিলিয়ে কপিলা প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হয়েছে।সমাজের চোখে দ্বন্দ্বময় এক সম্পর্কের বাধনে নিজেকে জড়িয়েছে।কেউ কেউ ঘৃনা করেছে কপিলাকে।তারপর ও কপিলা পাঠকের হৃদয়কে অনুরণিত করতে সক্ষম হয়েছে।স্বামীর ঘরের বন্ধনশৃংখলে রুদ্ধ কপিলা শেষ পর্যন্ত সামাজিক বাস্তবতাকে দু পায়ে মাড়িয়ে কুবের কে সঙ্গে নিয়ে স্বপ্নের ময়নাদ্বীপে পাড়ি জমায়।
দেবী চৌধুরানীর প্রফুল্লঃ
প্রফুল্ল অতি দরিদ্র ঘরের অশিক্ষিত অচ্ছ্যুত মেয়ে,তা সত্ত্বেও অসাধারন ব্যক্তিত্ব আর ভীষন আত্মমর্যাদার অধিকারী ছিলো সে।শ্বশুরবাড়ীতে নিগ্রহের শিকার প্রফুল্লর এই আত্মমর্যাদাই প্রফুল্লকে প্রফুল্ল থেকে দেবী চৌধুরানী বানিয়েছে।
মানবজমিনের তৃষাঃ
অন্যান্য উপন্যাসের নারীরা যেমন কোমল,শান্ত তৃষা তার ব্যতিক্রম।কঠিন ও দৃপ্ত চরিত্রের অধিকারী তৃষা,শরীরী আবেদন যার কাছে মিথ্যে।তৃষা স্বতন্ত্র ও লক্ষ্যাভিমুখী এক মেয়ে।মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভাংচুর,জোড় মেলানোর ঘাত প্রতিঘাতের দ্বন্দ্বময় পরিবেশেও দমে যায়নি তৃষা।সমাজের কাছ থেকে তার প্রাপ্য সে বুঝে নিয়েছে।জ়ীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সে লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছে,কখনো সমাজের,কখনো বা স্বামীর সঙ্গে লড়াই।এই সব কিছুই সে চরম সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করেছে।তাই সে তৃষা।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ২:২৯