somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৌমিতা আর ফুটপাথের ময়নার গল্প...........(ঈদ স্পেশাল !)

০২ রা অক্টোবর, ২০০৮ ভোর ৬:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'বাপি ; দ্যাখো ! পেটুক আঙ্কেল !'
মোটা লোকটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায় মৌ ! আমরা বাপ-বেটি মিলে ফুটপাথ ধরে হাঁটছি । আমাদের সামনের দিক থেকে আসছে লোকটি । হাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার বড় সাইজের পেটটা দুলছে । মৌ'র কথা লোকটার কানে গেছে বলে মনে হয় । তিনি হাসছেন । হাসি হাসি মুখে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন । মৌ'র মাথায় আলতো হাত রেখে চুলগুলো এলোমেলো করে দিলেন খানিকটা । চোখ বড় বড় করে মৌ তখন তার 'পেটুক আঙ্কেলকে' আরো কাছে থেকে দেখছে খুঁটিয়ে । ভদ্রলোক এক ঝলক আমার দিকে তাকালেন । মৌ'র কথায় নিদারুণ বিব্রত আমি । ভদ্রলোকের হাসির জবাবে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির মতো কিছু একটা ঝুলিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। সেটা কদ্দুর কি হলো জানিনা, ভদ্রলোকের দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়া দেখে সুবিধের কিছু যে হয়নি, তা অনুমেয় । আমাদেরকে পেছনে ফেলে ভদ্রলোক চলে গেলেন । মৌকে বললাম,-
'মা মণি ! আঙ্কেলকে পেটুক বললে যে ?'
'কত্তো মোটা না ?'
'হুঁ, মোটাতো একটু আছেই, তবে ওটা অসুখ !'
'অসুখ ?'
'হুম, ক'দিন আগে তোমার ঠান্ডা লেগে অসুখ হলো না, ওরকম অসুখ ।'
'ওনারও কি ঠান্ডা লেগেছে, বাপি ?'
'নাহ্ ! এটা অন্যরকম । তুমি বুঝবে না ।'
'তাহলে পেটুক বললে কি হয় !'
'মন খারাপ হয় । মনে কষ্ট যায় ।'
'মনে কষ্ট গেলে কি হয়, বাপি ?'
'কান্না পায় !'
'আঙ্কেলেরতো কান্না পায়নি ! আঙ্কেলতো হাসছেন !'
'তা ঠিক ! কিন্তু, তোমার যখন মন খারাপ হয়, কান্না পায়না ?'
'পায়তো !'
'তাহলে, কারুর মনে কষ্ট দেয়া কি ঠিক ?'
' না ! আঙ্কেলকে কি সরি বলা উচিত, বাপি ?'
'সেটা করতে পারলে খুব-ই ভালো হয় । কিন্তু তোমার আঙ্কেলতো আজ চলে গেছেন । পরে কোনদিন দেখা হলে, আমরা ওনাকে সরি বলবো । ঠিকাছে ?'
'আচ্ছা !' বলে নিজের কাজে মশগুল হয়ে যায় মৌমিতা । ছোট্ট ছোট্ট পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতে থাকে । ওর বাম হাতটা আমার হাতে ধরা । গুনগুন করে গানও গায়তে থাকে আপনমনে । সে গানের কথা আমার কান অব্দি আসেনা । মেয়েটা আজ ভীষণ খুশী । প্রায় ও ঘুরে বেড়াতে চায়, সম্ভব হয়না । আজ ঈদ । ফাঁকা নগরীর ফাঁকা রাস্তা, ফাঁকা ফুটপাথ । আয়েশ করে হেঁটে বেড়াচ্ছে ও,-সে আনন্দে আনন্দীত । নিজের ভেতরে মগ্ন ওর এই আনন্দ দেখে আমি মুগ্ধ । ভাবি, শিশুদের জগতটা কতোইনা নির্দোষ, অকৃত্রিম । কতো সহজেইনা ওরা সত্যিটা উচ্চারণ করে ফেলে । পেটুককে পেটুক বলে ফেলে । আমরা বড়োরা পারিনা । আমাদের দেশটাকে প্রতিদিন একটু একটু করে গিলে খচ্ছে যারা, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে বলতে পারিনা," আপনি জনাব, মস্ত বড়ো পেটুক !" ঘুষখোরকে বলতে পারিনা,- "ঘুষখোর !" একজন শিশু যদি ঘুষখোরকে চিনতে পারতো, নিশ্চয় বলে ফেলতো- 'ওই যে ঘুষখোর আঙ্কেল...!'


মৌ দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ । ফুটপাথের বৃদ্ধ পঙ্গু ভিক্ষুকটির ওপর তার দৃষ্টি । দু'এক টাকা
সাহায্যের জন্য তারস্বরে চিৎকার করেন বৃদ্ধ । বৃদ্ধের করুণ স্বর আহাজারীর মতো শুনায় । তার অল্প দূরেই মৌ'র বয়েসী একটি মেয়ে ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে কি যেন খায় । মৌ বললো,-
'উনি কাঁদছেন কেন, বাপি ? উনার কি অনেক কষ্ট ?'
'হ্যাঁ ।'

আমরা দাঁড়িয়ে থাকি আরো খানিকক্ষণ । ব্যস্ত পায়ে মানুষগুলো পঙ্গু ভিক্ষুককে পাশ কাটিয়ে যায় দ্রুত । কেউ ফিরে চায়, কেউ চায় না ! অভ্যস্ত চোখগুলোও মানুষের মতো সামনে ছুটে । এ যেন উজান স্রোতের বিপরীতে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দৌঁড় ! মাঝে মাঝে বৃদ্ধের দূর্ভাগ্যের আদি থালায় টুংটাং ঝংকার তোলে আধুলী-কয়েন । মৌর হাতটা আরো বেশী শক্ত করে ধরে আমিও বৃদ্ধকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় । জনগণের জীবনদৌড়ে শামিল হই ! খুব বেশী এগুতে পারিনা । রাস্তা থেকে কুড়িয়ে খাওয়া মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়াতে হয় । পা চলেনা । শীর্ণ দেহের শিশুটি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে বিস্কিট খাচ্ছে, পথচারী কারো পায়ে পিস্ট হয়ে থ্যাঁতলে যাওয়া বিস্কিট ।


পথশিশুটির সামনে গিয়ে আমি হাঁটুগেড়ে বসে পড়ি । আমি যেন নতজানু হই, লজ্জায় । বিড়বিড় করে উচ্চারণ করি,--
'তোর নাম কি রে; মা ?'
'ময়না !'
মেয়েটার গাল দুটো একটু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে আমার । মেয়েটির কপালে চুমো খেতে ইচ্ছে করে । আমি পারিনা, আমাদের সভ্য সমাজে এই প্রথা চালু নেই ! মেয়েটির চেহারা ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করে । আমি আঁতকে উঠি । এই মেয়েটি অবিকল দেখতে আমার মৌমিতার মতো ! লক্ষ্য করি, মৌর হাতটি আমার হাতে ধরা নেই । চমকে ওঠে পেছন ফিরে তাকাই । মৌ নেই ! পঙ্গু বৃদ্ধ ভিক্ষুকটি আমার দিকে চেয়ে হাসে ! ক্রুর হাসি । ক্রুদ্ধ হতে হতে আমি থেমে যাই । আমি আবিস্কার করি,- ভিক্ষুকটি আর কেউ নয়, আমি নিজেই !


দুঃস্বপ্ন ভেঙ্গে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসি আমি। ঢকঢক করে পানি খাই দু'গ্লাস । ঘামের তোড়ে দুঃস্বপ্নকে ভাসিয়ে দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে কিছু শব্দ গলা দিয়ে বের করে দিতে চাই, -- " আমার অনাগত শিশুর জন্য, আমার মৌ মা মণির জন্য আমি, খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি নিরাপদ পৃথিবী চাই !"










সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৩৬
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×