বক্বার ভাই আমাদের ২ক্লাস উপরে পড়িতেন। কোন কারণে তাহার সাথে তাহার ক্লাসমেটদের বনিবনা হইতো না। তাই তিনি হাইস্কুলে আড্ডাবাজি না করিয়া প্রাইমারিতে আমাদের সাথে আসিয়া আড্ডাবাজি করিতেন।
আমাদের সাধারণ জ্ঞানের একটি বড় অংশ আসিত তাহার কাছ হইতে। তিনি মাস শুরু হইতে না হইতেই কিছু ম্যাগাজিন কিনিতেন, যেখানে গত মাসে কি কি হইয়াছে তাহা একত্রে লিপিবদ্ধ থাকিত।
তিনি আমাদের কাছে মোটেও প্রিয়পাত্র ছিলেন না। তাহার কথাবার্তা বা আচার-আচরণ কোনটাই আমাদের পছন্দ হইতো না। কিন্তু তিনি প্রায়সই চিড়ার মোয়া সহ বিভিন্ন বস্তু আনিয়া আমাদের গিফট করিতেন। কখনও কখনও তার কাছে অনুরোধ রাখিলে কদবেলও পাওয়া যাইতো। এ জন্যই খুব সম্ভবত ক্লাস ফাইভের ছেলেপেলে তাকে মানিয়া লইতো।
বক্কার ভাইয়ের একটা প্রতিভা ছিলো, সেটি কোন গুপ্ত প্রতিভা নয়, সুপ্তও নয়। বরং সেটা ছিলো উন্মুক্ত। তিনি কবিতা লিখিতেন।
তাহার কবিতা গুলির পাঠোদ্ধার আমাদের দ্বারা হইতো না। তবে সব্বাই মিলিয়া আমরা বড়ই একটা আকাজ করিতাম।
ধরেন বাথরুমের দরজায় বা দেয়ালে, ক্লাসের বেঞ্চ বা ব্লাকবোর্ডে, যেথায় দু-লাইন কবিতা টাইপের কিছু মিলিত, সকলে বক্কার ভাইয়ের দিকে আঙ্গুল তুলিত। আমরা প্রাইমারীতে থাকিতেই তাহার মুখে এ বিষয়ক আফসোস শুনিয়াছি। কিছু না করিয়াও সকল দোষ তাহার!
কিন্তু হাই-স্কুলে উঠিবা পর্যন্ত তিনি বদলাইয়া গেলেন। তখন আর তিনি কোন অপবাদ গায়ে মাখিতেন না। বরং অপবাদ যাতে কাউকে দিতে না হয়, তাহার জন্য তিনিই অগ্রগামী হইয়া এখানে ওখানে কবিতা লিখিয়া বেড়াইতেন।
বক্কার ভাই পিতার ৮ সন্তানের মধ্যে তৃতীয়, ছেলে সন্তান হিসাবে প্রথম, পিতার বড় বউয়ের প্রথম সন্তান এবং সর্বপোরী সকল সন্তানের মধ্যে একমাত্র বোকা টাইপের সন্তান ছিলেন।
তাহার বাবা তাহাকে বড়ই ভালোবাসিত; সংসারের প্রথম সন্তান হিসাবেই শুধু নয়, বরং অন্য ৭জনের মত তাহার ঘর ছাড়িয়া পলাইবার বাতিক ছিলো না দেখিয়।
বক্কার ভাই কোন রকমে এইচএসসি পাশ করিয়া যখন অনার্স করিতে উদ্দত হইলেন, তখন তিনি জানিলেন যে চাকুরিতে বেতন ১০-১২হাজার টাকা হয়। যাহা ঐ সময়ে তাহার কাছে নিতান্তই নগণ্য মনে হইলো। তাই তিনি লেখা পড়া ছাড়িয়া পিতার সরদারী ব্যবসায় মনোনিবেশ করিলেন।
তাহার ব্যবসায় আগমন তাহার পিতার জন্য ছিলো এক আনন্দক্ষণ সময়। এই উপলক্ষে তাহার পিতা একটা বড় ভোজের আয়োজন করিলেন। বক্কার ভাইয়ের প্রিয়ভাজন হিসাবে আমিও দাওয়াত পাইলাম। গিফট ছাড়া খাইতে গিয়া, হাতে করিয়া গিফট লইয়া ফিরিলাম।
২০০৭ এর দিকের কথা; বক্কার ভাইয়ের ফোন পাইলাম; তিনি শুধাইলেন বই মেলায় কিভাবে বই লিষ্টিং করা যায় ইহা জানি কি না। লিষ্টিং এর সিষ্টেম জানা ছিলো না। আমি ঢাকার বই মেলার নাম তখন শুনিয়াছি; কিন্তু চোখে দেখি নাই কখনও। আমাদের সিটিতে একটা ছোটখাট বই মেলা হইতো আরকি, তবে সেটা বলার মত তেমন কিছু না। কোন এক অজানা কারণে আমাদের সিটির বই মেলা প্রায় বর্ষাকালে হইতো!
২০০৯ এ বক্কার ভাইয়ের কল পাইলাম। তিনি বই পাবলিশ করিয়াছেন, এবং আমাকে অনুরোধ করিলেন তাহার বইয়ের স্টল ঘুরিয়া আসিতে। তিন দফায় স্টলে গিয়া তাহার বই মিলিল।
বইয়ের মলাট খুলিয়া আবেগাপ্লুত হইয়া পড়িলাম। তাহার বই তিনি যে ৮জনের নামে উৎসর্গ করিয়াছেন, তাহার মাঝে আমার নাম তৃতীয় স্থানে! বইয়ের একটা কবিতাও আমার নামে রহিয়াছে! বই বিক্রেতা ইহা জানিয়া আমার কাছ হইতে কোন টাকা রাখিলেন না।
এরপর বক্কার ভাইয়ের সাথে দেখা সেই ২০১৯এ। আমিই সাধিয়া তাহার সাথে দেখা করিতে গেলাম। তিনি তখন ৪সন্তানের জনক।
তাহার স্ত্রী আমারই ক্লাসমেট, যদিও ক্লাসে তাহার সাথে আমার তেমন পরিচয় ছিলো না।
চলিয়া আসিবার সময় তাহার স্ত্রী আমাকে একটা অনুরোধ করিলো; বলিলো বক্কারকে একটু বুঝাও। সে তো কবিতা লইয়া দিন দিন আরও পাগল হইয়া যাইতেছে। তাহার ধারণা রবীন্দ্রনাথ বাবুর থেকেও তিনি নিজে বড় একজন কবি; কাজী নজরুলতো কোন ছাই!
বক্কার ভাইকে বুঝাইবো বলিয়া চলিয়া আসিলাম। তাহার দুইদিন পর আবার বিমানের সীটে বসিয়া বাহিরে। বক্কার ভাইয়ের সাথে কথা হয়নি তেমনটা।
শুনিয়াছি বক্কার ভাইয়ের কিছু সাগরেদও আছে। তাহারাও বলে (হয়ত বিশ্বাসও করে) যে বক্কার ভাই মহান একজন কবি।
আমার বইয়ের ভান্ডার খুঁজিয়া দেখিয়াছি; তবে বক্কার ভাইয়ের সেই বইটি খুঁজিয়া পাইনি। কখনও পড়েও দেখা হয়নি। আমাকে নিয়া লেখা কবিতাটিও নয়।
ঠিক করিয়াছি এবার দেশে গেলে বক্কার ভাইকে বুঝাইবো যে তিনি কবি হইলেও অত বড় মাপের নন যে রবীন্দ্রনাথও তার কাছে কিছু না। বুঝাইয়া কাজ হইবে কি হইবে না ইহা নিয়া যথেষ্ট সঙ্কা আছে। তাছাড়া তাহার ফ্যান লিষ্টে যারা আছে, তাদের কথাই হয়ত উনার মনে ধরিবে বেশী! আমি ফাঁকতলে শত্রু না হইয়া যাই।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০২২ রাত ২:৪৬