ঘটনাটা কত সালের ঠিক মনে নেই। কোন এক দলের ২/৩ দিনের হরতাল চলছে। তখন হরতাল মানেই রাস্তাঘাট সব ফাঁকা থাকবে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সব ব্যস্ততা শেষ।
যেহেতু হরতালে ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্কুল বন্ধ, তাই ফজরের সালাতের পর আর একটা ঘুমের সুযোগ পেলাম। গভীর ঘুমে তলিয়ে আছি। হঠাৎই আমাদের কাজের মহিলা (উনাকে আপা বলে ডাকি) হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন, আমি লাফিয়ে উঠে বিছানায় বসলাম। তিনি চিৎকার করে বললেন বিথী আত্মহত্যা করেছে!
মানুষের মৃত্যুর খবর আমি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারি না। তার উপর যদি পরিচিত কেউ হয় তাহলে আরও অবস্থা খারাপের মধ্যে পড়ে যাই।
বিথী আমাদের বাসায় এক সময় পড়তে আসতো। ওর মামার মুদি দোকান থেকে আমাদের মাসের পুরা বাজার-সদাই করা হয়। মাস শেষে বেতন হলে তাকে টাকা দেওয়া হয়। ওর মামা আমার আম্মাকে খালা বলেন। আমার আম্মাকে তিনি প্রচন্ড শ্রদ্ধা করেন। উনার নাম ইস্রাফিল। কিন্তু সবাই তাকে ইছাই বলে ডাকে, এবং 'ইছাই এর দোকান' সর্ট হয়ে ইছাইদ্দোকান হয়ে গেছিয়েছিলো কোন ভাবে।
যাই হোক, একটা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন বিথী? আপা উত্তর দিলেন, ইছাইদ্দোকানের পাশে যে থাকে।
এলাকার সবাই সবাইকে চিনে, সবাই সবার খোঁজ রাখে (মফস্বলে যা হয় আরকি)। আমিও সেই হিসাবে অনেকেরই খোঁজ রাখি। খুব ছোট বেলা থেকেই আমি আত্মহত্যা জিনিষটা অপছন্দ করি। কেউ আত্মহত্যা করেছে শুনলে তার প্রতি আমার সব অনুভূতি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আমি সারাদিন আর বাসা থেকে বের হলাম না।
সন্ধ্যায় কোন কারণে বাজারে যেতে হবে। যেতে হবে মৃত বাড়ির সামনে দিয়েই। একটু অস্বস্তিতে ছিলাম। যাই হোক, ঐ বাড়ি পার করে এগিয়ে গেছি বেশ দূরে। মেইন রাস্তা দেখা যাচ্ছে, একটি পারিবারিক কবরস্থান অতিক্রম করছি। হঠাৎ চোখ পড়লো কবরের অন্য পাশে। বিথী!
হঠাৎই আমার পুরা গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে জমে গেলো। চেষ্টা করেও খুব একটা নড়তে পারলাম না। আমি যে রোড দিয়ে হাটছি, বিথীও কবরের পাশ দিয়ে সেই রোডের দিকে আসছে। বিথী যদি এই রোডে এসে নিজের বাড়ির দিকে যায়, তাহলে আমার সাথে মুখোমুখি দেখা হবে।
একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। পুরা রাস্তায় কেউ নাই। মেইন রোড দিয়ে দু একটা বেবি-ট্যাক্সি চলছে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই রোডে কেউ নেই। হুট করে বিদ্যুৎ চলে গেলো। একটা ঢোক গিলে এগিয়ে গেলাম, যা আছে কপালে।
বিথী তার বাড়ির দিকেই যাচ্ছে। মুখোমুখি দেখা হতেই জিজ্ঞাসা করলো, কেমন আছেন? আমি কোন মতে উত্তর দিয়ে এগিয়ে গেলাম। মেইন রাস্তায় উঠা পর্যন্ত পিছনে ফিরে দেখার সাহসটিও করলাম না। পুরা গা তখন মৃদ্যু কাঁপছে। দ্রুত কাজ শেষ করে সম্পূর্ণ অন্য পথে ফিরলাম। বাসার কাছে আসতে আসতে বিদ্যুৎ চলে এসেছে।
বাসায় ঢুকতে ঢুকতে মনে হলো কোথাও একটা সমস্যা আছে। আম্মার কাছেই আপা বসে ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কে আত্মহত্যা করেছে? উনি উত্তর করলেন বিথী। আমি বললাম একটু আগেইতো ওর সাথে দেখা হলো!
আম্মা পাশ থেকে বললেন, বিথী না, রুথী! বিথী আর রুথীদের বাড়ি পাশাপাশি, ইছাইদ্দোকানের পাশেই! আমাদের এই আপা প্রায়ই এমন কাছাকাছি শব্দ/নাম নিয়ে জটিলতা বাঁধাতেন।
Photo by Nathan Hurst on Unsplash