আজ সন্ধ্যায় নাস্তা করার জন্য একটা ফাস্টফুডে গিয়েছিলাম । রিক্সা থেকে নেমেই দেখি একটা বাচ্চা , বয়স খুব বেশি হলে ৯-১০ বছর হবে । এই শীতে আমি যেখানে জ্যাকেট , জুতা – মোজা পড়ে অস্থির সেখানে এই বাচ্চাটি কেবল একটা হাফ গেঞ্জি আর একটা ময়লা হাফ প্যান্ট পড়ে আছে । প্যান্টটা অগোছালোভাবে তার পেটের নিচের দিকে কোন ময়লা ফিতা দিয়ে বাধা । সে শীতে কাঁপছে আর ক্রমাগত চেষ্টা করছে তার প্যান্টটাকে টেনে একটু বড় করতে , যাতে শীত একটু কম করে । তার দৃষ্টি ফাস্টফুডের স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল ভেদ করে সুন্দরী ললনার ধোঁয়া তোলা ফ্রাইড চিকেনের দিকে । নিজের ভেতরে এক সূক্ষ্ম অপরাধবোধ কাজ করলো , বাচ্চাটার জন্য সত্যিই খারাপ লাগছিল । মাথায় একটা লাইনই ঘুরছিল – “ জন্ম আমার আজন্ম পাপ “ ; হয়তো এই বাচ্চাটিরও তাই মনে হচ্ছিল ।
বাচ্চাটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – “ কি নাম তোর ? “
বাচ্চাটি প্যান্ট টেনে বলল – “ অপু “
আমি বললাম – “ অপু বিশ্বাস? ঠান্ডা লাগে না তোর , নাকি তুই অপু বিশ্বাসের জিরো ফিগার দেখাচ্ছিস ?”
ও বলল – “ হুম শীত লাগে কিন্তু কাপড় নাই “
সত্যিই শুনে খুব খারাপ লাগলো । যে দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরই পরিবারের চার সদস্যের জন্য চারটা গাড়ি লাগে সেখানে একই দেশের নাগরিক হয়ে এই বাচ্চাটির শীত থেকে বাঁচার জন্য সামান্য একটা গরম কাপড় নেই ।
আমি বাচ্চাটিকে বললাম – “ এখানে কি করস ?”
বাচ্চাটি কিছু বলল না ( তার দৃষ্টি তখনো সুন্দরীর চিকেনের দিকে )
জিজ্ঞেস করলাম – “ দুপুরে খাইছিস ?”
- “না”
- “ক্যান বাসায় রান্না হয় নাই?”
- “না , বাসা নাই”
- “ঘুমাস কই ,তোর মা – বাবা কই থাকে”
- “মা ভিক্ষা করে , বাপ কই থাকে জানি না আর ঘুমাই বাসস্টান্ডের বেচ্চিতে “
আমার কিঞ্চিৎ সন্দেহ হল এই বাচ্চার বাবা আরেকটা বিয়ে করে ভাগছে তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম । বাচ্চাটি কোন উত্তর দিল বা । বুঝলাম সে এই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতে চায় । তাকে আর এই ব্যাপারে ঘাটলাম না ।
-“টাকা আছে তোর কাছে?”
-“আছে” বলে সে কিছু খুচরা টাকা পকেট থেকে বের করলো ।
-“টাকা আছে তো দুপুর থেকে না খ্যায়া আছিস ক্যান?”
-“রাতে শীত করে তাই একটা কম্বল কিনমু”
-“এখানে কেউ খেতে দেয় না?”
-“না , খালি পিপসির ( পেপসির ) খালি বোতল দেয় , ওইখানে যা থাকে তাই খাই”
-“কেউ আর কিচ্ছু দেয় না !!!”
-“না”
-“চাইছিলি?”
-“হুম , উই আফার কাছে চাইছিলাম”
তার আঙ্গুল সেই সুন্দরীর দিকে
-“কি কয়?”
-“কইছে মাফ কর”
হঠাৎ করে জানিনা কেন মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল । আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে ভেতরে গেলাম । বাচ্চাটাকে দেখার সাথে সাথে একজন বয় এগিয়ে এসে বাচ্চাটিকে ধমকাতে লাগলো । আমি বললাম- “ও আমার সাথে এসেছে”
বয় বলল – “সারাদিন এরা জ্বালায় মারে , এদের জন্য কাস্টমার আমাদের সাথে রাগ করে “
আমি বললাম –“এখন ও আমার সাথে এসছে , ও আমার গেস্ট আর আপনি বা আপনারা তার সাথে খারাপ ব্যাবহার করতে পারেন না । আমি নিশ্চয় আপনাদের কাছে টাকার বিনিময়ে খাবো আর এও খাবে ।“
আমি বাচ্চাটিকে সেই সুন্দরীর পাশে বসালাম আর আমি পাশের টেবিলে । সুন্দরী যেন ভুত দেখছে এভাবে তাকালো আর বাচ্চাটিকে বলল – “ এই সর সর ...”
বাচ্চাটি কি করবে বুঝতে পাড়ছে না ।
আমি বললাম –“ সিস্টার ও এখানেই বসবে । আপনি যেমন টাকা দিয়ে খেতে এসেছেন , ও ও এসেছে ; আপনি যত টাকা বয়কে বকশিস দেবেন , ও ও তাই দেবে ; হয়তোবা আপনার থেকে বেশিই দেবে “
সুন্দরী বলল – “ আজিব তো “
- “ হুম , আজিব “
সুন্দরী ম্যানেজার , বয় – টয় কে ডেকে অস্থির । তার কথা একটাই এই বাচ্চা তার পাশে বসবে না । আমারও জিদ আমি এই বাচ্চাকে এই মেয়ের পাশে বসাবোই । মানুষজন যোগার হয়ে গেল , সবাই আমার বিপক্ষে । তারা আমার কোন কথাই শুনবে না , পারলে বাচ্চাটিকে মেয়েটির পাশে বসাবার অপরাধে আমাকে গণধোলাই দেয় । সেই মুহূর্তে ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করে বললাম রিপোর্টার । যারা যারা আমার বা এই বাচ্চাটির বিপক্ষে তারা তারা তাদের নাম ,পরিচয় বলে বলুন কি বলতে চান । পকেট থেকে মোবাইল বের করে রেকর্ডিং চালু করলাম , কয়েকটা ছবিও উঠালাম । এতে কাজ হল সবাই আমতা আমতা করছে । একজন জিজ্ঞেস করলো –“কোন পেপার?”
আমি একটা পেপারের নাম বললাম ( ফেসবুকে পেপারের নামটা বলছি না , এতে হয়তো সমস্যা হতে পারে) আর পেপারের নাম দিয়ে কি করবেন , পেপারে নিজের ছবি দেখলে এমনিতেই চিনবেন । একরকম বিদ্রোহ করেই বাচ্চাটিকে আমি ওই মেয়েটির পাশে বসালাম , বয়কে বললাম ওই আপু যা যা অর্ডার করেছে তাই এই বাচ্চাটাকে দাও । মেয়েটি চোখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল – “ হ্যালো মিস্টার এটা কি ঠিক হল ?”
আমি বললাম – “ আপনি যখন এই বাচ্চাটির সব কথা শোনার আগে “মাফ করো” বলে এসে খাওয়া শুরু করেছিলেন তখন কি সেটা ঠিক ছিল ?”
তারপর আর কোন ঝামেলা হয়নি । বাচ্চাটি অনেক তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে । কোক খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে গিয়ে চোখে পানি এসেছিল তার । নিজেকে আজ মানুষ ভাবতে খুব ইচ্ছা করছে । হয়তো আমি এটা করার জন্য মিথ্যা বলছি কিন্তু এই মিথ্যা বলার জন্য আমার মাঝে আজ সামান্য অপরাধবোধ নেই । খাওয়া শেষে আমি বাচ্চাটির মুখে যে হাসি দেখেছি তাতে মনেহচ্ছে এই জীবন আমার সার্থক । সত্যিই আজ নিজেকে অনেক বড় মনেহচ্ছে ।
আমার সামর্থ্য খুব সীমিত , আমি এই ধরনের বাচ্চাকে হয়তো একদিন খাওয়াতে পারি কিন্তু যাদের সামর্থ্য থাকার পরও সামান্য দুইটাকা দিতে বাধে আমি তাদের মানুষ বলি না আর বলবও না । আমার উদ্দেশ্য ছিলনা মেয়েটাকে এভাবে অপদস্ত করার কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম যাতে এই বাচ্চাটাকে মানুষ ভাবা হয় , এই বাচ্চাটাও তাদের কাতারে বসতে পারে এটা বুঝানোর , তাই মিথ্যা বলেছি । আমার মনেহয় আজ ওই ফাস্টফুডের সবাই এই জিনিসটা মাথায় রাখবে ।
সত্যি আজ যদি আমি গণধোলাই খেতাম তাহলে আমার এতটুকু খারাপ লাগতো না , হয়তোবা শারীরিক কষ্ট হতো কিন্তু মানসিকভাবে এতটুকু কষ্ট পেতাম না ।
সত্যিই নিজেকে মানুষ ভাবতে ভালো লাগছে আজ ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



