
রাতে হঠাৎ লোবান জ্বালালে ঘরের বাতাস বদলে যায়।
শব্দগুলো যেন ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে।
মনের ভেতর জমে থাকা এলোমেলো চিন্তাগুলো একটু চুপ করে বসে থাকে।
লোবান এমন এক জিনিস, যা সাধারণ চোখে অসাধারণ কিছু নয়, কিন্তু অনুভব করলে, চিন্তা করলে এর প্রভাব, অদ্ভুত রকম গভীর। মানুষ হাজার বছর ধরে এই গন্ধের সঙ্গে চলছে, কথা বলছে, কখনো ঈশ্বরের সাথে, কখনো নিজের সঙ্গে।
কিন্তু আজ এই গন্ধের উৎস, লোবানের গাছগুলো, নীরবে বিপদের দিকে হাঁটছে।

লোবান হলো বসওয়েলিয়া (Boswellia) গাছের শুকনো রজন। এরা মরুভূমির গাছ। পাহাড়ের খাড়া দেয়ালে, শুষ্ক মাটিতে, খুব কম পানিতে টিকে থাকতে পারে। দেখতে একটু রুক্ষ, বাকল খসখসে, পাতাও কম।
গাছের গায়ে ছোট করে কাট, দিলে দুধের মতো তরল বের হয়। এই তরলই ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে ছোট ছোট দানায় পরিণত হয়। দেখতে যেন স্বচ্ছ পাথরের টুকরো। এই দানাই লোবান।

আগুনে দিলে দানা গলে যায়, ধোঁয়া ওঠে। সেই ধোঁয়াই হাজার বছরের পরিচিত গন্ধ।
খ্রিস্টধর্মে লোবান ছাড়া প্রার্থনার কথা কল্পনাই করা যায় না। গির্জায় ধোঁয়ার যে আবহ, তার বড় অংশ জুড়ে আছে লোবান। বাইবেলের গল্পে যিশুর জন্মের সময় তিন জ্ঞানী পুরুষ যে তিনটি উপহার এনেছিলেন, সোনা, গন্ধরস আর লোবান। তার মানে ছিল রাজকীয়তা, পবিত্রতা আর আত্মিক মূল্য।

মুসলিম সমাজেও অনেক জায়গায় লোবান ব্যবহৃত হয়। বিশেষ রাতে, নতুন ঘরে ওঠার সময়, কিংবা ঘর শুদ্ধ করতে। কেউ কেউ বলে, লোবান জ্বালালে শয়তান দূরে থাকে। এর কোনো প্রমাণ নেই, তবে বিশ্বাস করে অনেকে।
হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মীয় আচারে, ধূপের ভেতরেও বহু সময় লোবানের ব্যবহার থাকে।
আধুনিক ভাষায় যাকে বলা হয় “মেডিটেশন স্পেস”—সেখানেও লোবান আছে। লোবানের গন্ধ মনকে ধীর করে। বিজ্ঞান বলছে, লোবানের ধোঁয়ার কিছু উপাদান মানুষের স্নায়ুতে প্রশান্তির সংকেত পাঠায়। তাই হয়তো এই গন্ধে মানুষ একটু চুপ হয়ে যায়।
প্রাচীন আয়ুর্বেদ ও চীনা চিকিৎসায় লোবান ব্যবহার হতো প্রদাহ কমাতে, ব্যথা উপশমে, ক্ষত সারাতে। আধুনিক চিকিৎসায়ও লোবানের নির্যাস নিয়ে গবেষণা চলছে। আজকের “ওয়েলনেস ইন্ডাস্ট্রি”-তে লোবান একটি বড় নাম।
আমাদের গ্রামবাংলায় আজও কেউ কেউ সন্ধ্যায় লোবান জ্বালান। কেউ বলেন, মশা কমে। কেউ বলেন, মন ভালো থাকে। কেউ কিছু বলেন না, শুধু গন্ধটা উপভোগ করেন।
লোবানের ইতিহাস: গন্ধের পথ ধরে সভ্যতা
একসময় পৃথিবীতে ছিল “লোবান পথ”।
উটের কাফেলায় লোবান যেত সোমালিল্যান্ড, আরব উপদ্বীপ থেকে রোম, গ্রিস, ভারত পর্যন্ত। তখন লোবান ছিল বিলাসিতা। রাজারা লোবান ছাড়া পূজা করতেন না। ধনীরা ঘরে লোবানের গন্ধ ছড়িয়ে ক্ষমতার জানান দিতেন।
লোবান ছিল এত মূল্যবান যে যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে।
সময় বদলেছে। এখন লোবান পাওয়া যায় সুগন্ধি মোমবাতিতে, এসেনশিয়াল অয়েলে, অনলাইন শপে।
কিন্তু গাছগুলো এখনো সেই পাহাড়েই আছে। শুধু চাপটা বেড়েছে।
গাছের ক্ষত, কেউ দেখে না
লোবান সংগ্রহ করা হয় গাছ কেটে। খুব হিসেব করে কাটলে সমস্যা নেই। কিন্তু আজ বিশ্বজুড়ে চাহিদা এত বেশি যে অনেক জায়গায় গাছকে বিশ্রাম দেওয়া হচ্ছে না।
একটা বসওয়েলিয়া গাছের ক্ষত সারাতে লাগে দশ বছর বা তারও বেশি সময়। অথচ বাস্তবে গাছ কাটা হচ্ছে প্রতি মৌসুমে।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে—
জলবায়ু পরিবর্তন
খরা ও হঠাৎ বন্যা
পোকার আক্রমণ
পশুচারণ
আর মানুষের তাড়াহুড়া
গবেষণা বলছে, অনেক এলাকায় নতুন গাছই জন্মাচ্ছে না। গাছগুলো বুড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের জায়গা নিতে কেউ আসছে না।
মানুষের গল্প: গাছের ছায়ায় জীবন
সোমালিল্যান্ডের পাহাড়ে সালাবান সালাদ মুসের মতো মানুষরা আজও মাসের পর মাস গুহায় থাকে। গাছের পাশে ঘুমায়। গাছের দিকেই তাকিয়ে দিন শুরু করে।
কিন্তু লোবানের শেষ বাজারমূল্যের মাত্র ২–৩ শতাংশই যায় তাদের হাতে। বাকিটা হারিয়ে যায় মধ্যস্বত্বভোগী আর দূরের বাজারে।
লোবান যখন শেষ আয়ের পথ হয়ে দাঁড়ায়, তখন মানুষ বাধ্য হয় আরও বেশি গাছ কাটতে।
গাছ মরে। মানুষ বাঁচে।
এটাই নির্মম সমীকরণ।
আশার ছোট আলো
সব গল্প অন্ধকারে শেষ হয় না। কিছু জায়গায় এখন প্রযুক্তি দিয়ে লোবানের পথ অনুসরণ করা হচ্ছে। কোন গাছ থেকে লোবান এসেছে, গাছটির বয়স কত, কতবার কাটা হয়েছে, সব তথ্য রাখা হচ্ছে।
এতে গাছ বাঁচে, মানুষ ন্যায্য দাম পায়। কাজটা ধীরে চলছে, কিন্তু চলছে।
লোবান নিয়ে একটাই প্রশ্ন নিজেদের করা উচিত।
আমরা কি শুধু ধোঁয়াটা চাই,
নাকি সেই গাছ, সেই পাহাড়, সেই মানুষগুলোও?
আগুনে দিলে লোবান জ্বলে।
ধোঁয়া ওঠে।
যদি ভাগ্য ভালো হয়, একটু সচেতনতা উঠেও বাতাসে মিশে যায়।
গন্ধটা যেন থাকে।
কিন্তু গাছ কেটে নয়,
গাছ বাঁচিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ২:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


