ছবি: ইন্টারনেট
রিনির সাথে আবার আমার এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি কখনও। কেন ভাবিনি জানি না। দেখা হওয়াটা তো খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ খুবই ছোট একটা দেশ। একদিন না একদিন হঠাৎ দেখা হওয়াটা খুব আশ্চর্যের কিছু নয়। তবু মন বলতো, হয়তো আর কোনদিনই দেখা হবে না আমাদের। ও যে এতদিন কোথায় ছিল তাই জানতাম না আমি। অবশ্য জানার চেষ্টাও করিনি কখনও। ওর চলে যাওয়া আমার জীবনে স্বস্তির নিঃশ্বাস এনে দিয়েছিল। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম আমি। তপ্ত গরমে জীবন যখন বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে, তখন হঠাৎ আসা এক পশলা বৃষ্টি যেমন স্বস্তি এনে দেয় ঠিক তেমন স্বস্তি। নাহ, উপমাটা বোধ হয় ঠিকঠাক হলো না। গলায় একটা বিশাল কাঁটা আটকে গেলে যে কষ্ট হয় এবং হঠাৎই সেই কাঁটাটা গলা থেকে সরে গেলে যেরকম ভারমুক্তির অনুভূতি হয় ঠিক তেমনই এক অনুভূতি হয়েছিল রিনি আমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার পর। শখ করে সেই কাঁটাকে আবার গলায় বিঁধতে কেই বা চাইবে। আমিও চাইনি। কিন্তু জীবনের এই মধ্যলগ্নে এসে রিনির কথা আজকাল প্রায়ই মনে পড়ে আমার। ভালবেসেছিলাম এক সময় দুজন দুজনকে। সেই ভালবাসায় এতটুকু খাদ ছিল না কোথাও। তারপরেও কী করে যে কী হয়ে গেলো। জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই ভালবাসার স্মৃতিটুকু আজকাল বড্ড জ্বালাতন করছিল আমায়। হয়তো ভালবাসার খরায় পড়ে, সেই স্মৃতিটুকু হাতড়ে মনটা একটু তৃষ্ণা মেটাতে চায়। কিন্তু তাতে তৃষ্ণা তো মেটেই না, বরং খরার তীব্রতা আরো বেড়ে যায়।
আমার সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে রিনি চলে যাচ্ছে। সিঁড়িতে পা রাখলো। এক সিঁড়ি দুই সিঁড়ি করে উপরে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু আমি ওকে ডাকতে পারছি না। আচমকা ওকে এভাবে দেখার ধাক্কা সামলে উঠতে সময় লাগছে আমার। দৌড়ে ছুটে গিয়ে যে ওকে ধরব তারও শক্তি পাচ্ছি না। এতটাই বিহ্বল হয়েছি আমি ওকে দেখে। আমি যখন বিহ্বলতার ধাক্কাটা সামলে উঠলাম ততক্ষণে রিনি সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমি ছুটে গেলাম সিঁড়িতে। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে হাঁফ ধরে গেলো। শরীরটাও আজকাল বিশ্বাসঘাতকতা করছে। কোন রকমে উপরে উঠে এদিক সেদিক তাকালাম। দর্শনার্থীরা ছবি দেখতে মগ্ন। এদের ভীড়ে রিনি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। গ্যালারিতে আজ ভীড়টাও একটু বেশি। সাধারণত চিত্র প্রদর্শনীতে এত দর্শক হয় না। কিন্তু আজ হয়েছে। এর কারণটা কী আমি জানি। সেই কারণটার কথা মনে হলেও বুকের ভেতর চিন চিন ব্যথা শুরু হয়। হ্যাঁ, হিংসে হয় আমার। খুব হিংসে। আর হবেই বা না কেন? এত বছর ধরে ছবি আঁকছি আমি। আমার ছবির খ্যাতি দেশের বাইরে পর্যন্ত চলে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কখনও আমার আঁকা ছবি এত দর্শক টানতে পারেনি। অনেকদিন ধরেই দেশের এক নম্বর চিত্রশিল্পির আসনটা আমার দখলেই ছিল। প্রায় সব প্রদর্শনীতেই আমার আঁকা ছবি সেরা ছবির পুরস্কার পেয়ে থাকে। কিন্তু এবার আমি নিশ্চিত, সেরা ছবির এওয়ার্ডটা ঐ রওনকই পাবে। এই রওনক যেন হঠাৎ করেই উড়ে এসে জুড়ে বসেছে চিত্রজগতে। ছ’মাস আগে হঠাৎ করেই একক চিত্র প্রদর্শনী করে সে। ওর সেই চিত্রপ্রদর্শনী রীতিমত সারা ফেলে দেয়। টিভিতেও ফলাও করে ওর আঁকা ছবিগুলো প্রদর্শন করা হয়। সবগুলো ছবিই খুব প্রশংসিত হয়। আমি নিজেও দেখেছি ওর ছবিতে অন্যরকম একটা আকর্ষণ আছে যা ছবিবোধ্যাদের তো আকর্ষণ করেই, সাধারণ মানুষ যারা হাতে আঁকা ছবি তেমন একটা বোঝে না তাদেরকেও আকর্ষণ করতে সমর্থ। অদ্ভুত একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে ও ছবিতে যা এখনও আমি আমার ছবিগুলোতে ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি। এই প্রদর্শনীতে ওর একটা ছবি ভীষণভাবে আলোড়িত করছে সবাইকে। মায়ের কোলে শিশু। এত আশ্চর্য সুন্দরভাবে ছেলেটা ছবিটা এঁকেছে যে ছবিটার সামনে গেলে শরীর ও মনে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগে। বিভোর হয়ে ছবিটার দিকে কেবল তাকিয়েই থাকতে হয়। আমার মন বলছে এই ছবিটাই সেরা ছবির পুরস্কার পাবে এবার। রওনককে এখনও আমি দেখিনি। ছেলেটা জনসমক্ষে আসা পছন্দ করে না।
রিনিকে খুঁজে চলেছি আমি। একবার মনে হলো হয়তো আমার ভুল হবে। রিনি এখানে কেন আসবে? যেসব প্রদর্শনীতে আমার ছবি থাকবে সেসব প্রদর্শনী এড়িয়ে যাওয়াই ওর জন্য স্বাভাবিক। ও কোনভাবেই আমার মুখোমুখি হতে চাইবে না। আর এজন্যই ওর সাথে যোগাযোগের সব উপায় ও নষ্ট করে রেখেছে। এমন কি ওর বাবা মা যে বাসায় আগে থাকতেন সেই বাসাও ওরা বিক্রি করে দিয়েছে। অতএব, এই রিনি নিশ্চয়ই আমার অলিক কল্পনার সৃষ্টি। বেশি বেশি ভাবছি ওর কথা কিছুদিন ধরে। তাই মস্তিষ্ক ওকে সৃষ্টি করে আমার সামনে নিয়ে এসেছে। এসব চিন্তা করে ফিরেই যাচ্ছিলাম হঠাৎই চোখ পড়লো রওনকের আঁকা সেই চিত্রকর্মটির দিকে। অনেকে ভীড় করে রেখেছে সেখানে। চিত্রকর্মটির পাশে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলছে কেউ কেউ। সেই ভীড়ের ভেতরে রিনির মুখটা এক ঝলক দেখা গেলো। সেই পরিচিত মুখখানি। যে মুখ চিনতে ভুল হবার কথা নয় কখনোই। তাহলে রিনি সত্যি সত্যি এসেছে প্রদর্শনী দেখতে! আমার আঁকা ছবি এই প্রদর্শনীতে আছে জেনেও এসেছে! নাকি আমার ছবি দেখতেই এসেছে ও? ভাবতেই সারা শরীরে এক মধুর শিহরণ বয়ে গেলো। সেই প্রথম প্রেমের শিহরণের মত। কী অদ্ভুত জীবন! এই মধ্য বয়সে এসেও সেই প্রথম প্রেমের শিহরণ জাগে কী করে? তাও আবার মধ্যবয়সী প্রাক্তনকে দেখে। আমি এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। ও বিভোর হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আস্তে করে ডাকলাম,
-----রিনি।
ও একটুও চমকে উঠলো না। স্বাভাবিক নিস্পৃহ কণ্ঠে উত্তর দিলো,
-----হু।
আমি ভাবলাম হয়তো ও ছবিতে ডুবে আছে। ঘোরের মধ্যে উত্তর দিচ্ছে। তাই আবার ডাকলাম,
----রিনি।
এবার ও ঘাড়টা আমার দিকে ফেরালো। সেই একই নিস্পৃহ কণ্ঠে জবাব দিলো,
-----কী, কিছু বলবে?
ওর দৃষ্টিতেও কণ্ঠেরই মত সেই একই নিস্পৃহতা। যেন ও আগে থেকেই জানে আমি এখানে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। যেন আমাদের মধ্যে কখনোই কোন বিচ্ছেদ ঘটেনি। আমরা একসাথেই ছিলাম এমন আটপৌরে ভাব। যেন আমাদের শেষ দেখা আর এই দেখার মধ্যে প্রায় পঁচিশ বছরের ব্যবধান নয়, বরং মাত্র পঁচিশ সেকেন্ডের ব্যবধান।
-----কী হলো? কিছু বলবে?
আবার সেই নিস্পৃহ, নিরুত্তাপ কণ্ঠ। নেই কোন বিস্ময়, অভিমান কিংবা রাগ। নেই বহুদিন পর ভালবাসার মানুষের সাথে দেখা হওয়ার উচ্ছ্বাস। আমি কিছুটা হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
-----কেমন আছ?
রিনি আবার ছবিটার দিকে মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
-----ভাল।
এই পঁচিশ বছরে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি রিনির। শরীরে বাড়তি কোন মেদ নেই। বয়সের কারণে সামান্য একটু মোটা হয়েছে। আর চোখে উঠেছে চশমা। বয়সের ছাপ বলতে এটুকুই। আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল ওর এই ভাবলেশহীন ব্যবহার দেখে। একবার ভাবলাম চলে যাই। কিন্তু নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমার দৃষ্টি ওর দৃষ্টিকে অনুসরণ করে ছবিটার দিকে চলে গেলো। হঠাৎই এক রাশ বিস্ময় এসে জমা হলো আমার চোখে মুখে। ব্যাপারটা আমি আগে কেন ধরতে পারলাম না বুঝতে পারছি না। আমি একবার ছবিটার দিকে তাকাচ্ছি আর একবার রিনির দিকে। চিত্রকর্মটিতে মায়ের ছবিটা যেন রিনিরই প্রতিচ্ছবি। আমি বিহ্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
-----এই ছবির মডেল কি তুমি?
রিনির ঠোঁটের এক কোণে একটু হাসি দেখা গেলো। এক চিলতে হাসি। সেই হাসিতে যেন রাজ্যের রহস্যময়তা ভীড় জমিয়েই আবার মিলিয়ে গেলো। হাসিটাও আর দেখা গেল না। রিনি আমাকে পাশ কাটিয়ে আবার সিঁড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। রিনি যেন একটা চুম্বক। আমি যেন একটা লোহা। আমি নিজের অজান্তেই ওর পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম এবং ওর সাথে সাথে হাঁটতে লাগলাম।
আমি রিনিকে বললাম,
-----রিনি, একটু কথা ছিল তোমার সাথে।
আমার দিকে না তাকিয়েই সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রিনি বলল,
-----তোমার আমার সব কথা সেই পঁচিশ বছর আগেই ফুরিয়েছে। এখন আবার নতুন করে কী কথা বলতে চাও তুমি।
আমি মরিয়া হয়ে বললাম,
----প্লীজ রিনি।
-----তুমি এত বড় আর্টিস্ট। সারা দেশের মানুষ তোমাকে চেনে। চারিদিকে সাংবাদিকরা ঘুর ঘুর করছে। এমন অসহায়ের মত একজন মধ্যবয়সী মহিলার সাথে কথা বলতে দেখলে নানা স্ক্যান্ডাল তৈরি হবে।
-----স্ক্যান্ডাল হলে হোক। তুমি কি আমার অনুরোধ রাখবে না?
রিনি একটু সময় ভেবে বলল,
-----আচ্ছা, ঠিক আছে। চলো ঐ ফাঁকা জায়গাটায়।
আমরা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। রিনি বলল,
----কী বলতে চাও তাড়াতাড়ি বলে ফেলো। আমার হাতে সময় বেশি নেই। রিনির চোখে মুখে আশ্চর্য এক দীপ্তি ছড়িয়ে আছে। ওর প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় ম্লান মনে হচ্ছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখছিলাম। ইচ্ছে করছিল এখনই ক্যানভাসের কাছে ছুটে যাই, ওর এই প্রতিমূর্তিটা সেখানে ফুটিয়ে তুলি।
-----কী হলো? বলো।
-----এই মুহুর্তে তোমার একটা ছবি আঁকতে খুব ইচ্ছে করছে।
রিনি সেই একই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
-----হেয়ালীপনা রেখে কী বলতে চাও বলো।
-----এই বয়সেও এত শক্তি, এত দীপ্তি কোথা থেকে পাও, রিনি?
আবার সেই রহস্যময় এক চিলতে নিশ্চুপ হাসি ঠোঁটের কোণে দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেলো। কোন উত্তর দিলো না ও। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম,
-----কোথায় আছো এখন? ঠিকানাটা বলো। অনেক খুঁজেছি তোমায়। কিন্তু তুমি তোমার সাথে যোগাযোগের কোন চিহ্নই রাখোনি।
-----এতদিন পর কেন এই খোঁজাখুঁজি? কী চাও তুমি?
-----কিছু না। শুধু এক পলক তোমাদের দেখতে চেয়েছিলাম। খুব বেশি মনে পড়ছিল তোমার কথা।
রিনি হাসলো। ব্যঙ্গের হাসি। আমি বললাম,
-----জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করার কথাও না। আচ্ছা এসব বাদ দাও। কোথায় ছিলে এতদিন এটা তো বলো।
-----ইউ কে তে।
-----ওহ। কবে ফিরলে?
-----সাত মাস আগে।
-----রিংকুও এসেছে?
-----হুম।
-----কেমন আছে সে?
হঠাৎ রিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলো। তাও ভাল, একটা এক্সপ্রেশন তো দেখালো। ওর এই নির্লিপ্তি আমাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছিল। উত্তেজিত কণ্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে রিনি বলল,
-----কেন জানতে চাও? তার সম্পর্কে কিছু জানার অধিকার তোমার নেই। পঁচিশ বছর আগে সেই অধিকারকে তুমি নিজের হাতে গলা টিপে মেরেছ।
----জানি। সেই অধিকার আমি অনেক আগেই হারিয়েছি। তবু জানতে চাই। তবু একটিবার তার সাথে দেখা করতে চাই।
-----কেন? হঠাৎ করে এই দরদ উথলে ওঠার কারণ কী? সেদিন তো তোমার আর তার মাঝে যেকোন একজনকে বেছে নিতে বলেছিলে। আমি তাই করেছিলাম। আমি তাকে বেছে নিয়েছিলাম এবং তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। তুমি আমাদের দিকে একবার ফিরেও তাকাও নি। তবে আজ কেন এই ন্যাকামো করছ?
এমন সময় কয়েকজন দর্শনার্থী "ঐ যে রওনক হাসান" এসেছেন বলে এগিয়ে গেলো। আমি ওদের গন্তব্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অল্প বয়সী একটা লোক হেঁটে আসছে। লোকটাকে মোটেই স্বাভাবিক মানুষ মনে হলো না। যদিও তার বেশভূষা খুবই রুচিশীল। চেহারাও খুব সুন্দর। কিন্তু তার অঙ্গভঙ্গি বলে দিচ্ছিলো সে একজন প্রতিবন্ধী। দর্শনার্থীরা অটোগ্রাফের জন্য তাকে ঘিরে ধরলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
আমার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছিল না। একজন প্রতিবন্ধী লোক কীভাবে রওনক হতে পারে? একজন প্রতিবন্ধী কীভাবে এত ভাল ছবি আঁকতে পারে। কয়েকজন সাংবাদিক ওর সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য এগিয়ে গেলো। ও খুব সুন্দরভাবে ওর নিজের মত করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। কথাগুলোর মধ্যে জড়তা আছে। কিন্তু সেই জড়তাকে অত্যন্ত দক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সে তার কথাগুলো খুব গুছিয়ে উপস্থাপন করতে পারছে। কেউ ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল না। বরং সিরিয়াসলি ওর কথা শুনছিল। আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। চোখের কোণে জল জমলো।
-----তোমার বউ আর ছেলেরা কেমন আছে?
রিনির কথায় চমকে উঠলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
-----তাহলে আমার খবর তুমি রাখো। আমার দুই ছেলে আছে তাও জানো। আছে ওরা যে যার নিজেদের মত।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুকের গভীর থেকে। বলতে পারলাম না, ওরা সবাই ভাল আছে। শুধু ভাল নেই আমি। এত বড় পৃথিবীতে আজ আমি বড় একা। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে জিজ্ঞেস করলাম,
-----তোমাকে এখানে দেখে খুবই অবাক হয়েছি।
-----কেন,? আমি কি এখানে আসতে পারি না?
-----না মানে, আমার ছবি এই প্রদর্শনীতে আছে তা নিশ্চয়ই জানো তুমি। তাই স্বভাবতই এখানে আসাটা এড়িয়ে যাওয়ার কথা তোমার।
এই কথা শুনে রিনি হেসে উঠলো। বলল,
----তুমি ভাবছ তোমার ছবি দেখতে আমি এখানে এসেছি? কিংবা তোমার সাথে দেখা করার লোভে আমি এখানে এসেছি?
আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কথা গুলিয়ে ফেললাম। কী বলব ভেবে পেলাম না। রিনি আবার বলল,
----কী করে এমন অদ্ভুত খেয়াল তোমার মাথায় এলো। তোমার ছবি দেখার কিংবা তোমার সাথে দেখা করার বিন্দুমাত্র আগ্রহও আমার নেই।
রিনির কথা শুনে খুব কষ্ট হতে লাগলো বুকের ভেতর। রিনি আর আগের সেই রিনি নেই। এই রিনির মনে আমার জন্য এতটুকু ভালবাসা অবশিষ্ট নেই। আমি করুণ চোখে ওর দিকে তাকালাম। এমন সময় আমার খুব কাছে এসে কেউ বলল,
-----মা, চলো।
আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার খুব কাছাকাছি রওনক দাঁড়িয়ে। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। কী সুন্দর পবিত্র নির্মল এক হাসি ছড়িয়ে আছে ছেলেটির সারা মুখে। ও তাকিয়ে আছে রিনির দিকে। রিনি রওনকের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,
-----চল্ বাবা।
যেতে যেতে কী মনে করে আবার আমার কাছে ফিরে এসে বলল,
-----ঐ যে আমার শক্তি, আমার দীপ্তি। এবং তোমার লজ্জা। যে ছিল সমাজের কাছে তোমার লজ্জার কারণ, দুই বছর বয়সে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ার সাথে সাথে সমাজের কাছে লজ্জার ভয়ে যাকে তুমি দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলে, সেই আজ সমাজ ও দেশের রওনক। সকলের দীপ্তি ও অহংকার। আর হ্যাঁ, তোমার দেয়া নাম পাল্টে আমি ওর নাম রেখেছি রওনক। রওনক অর্থ দীপ্তি, সৌন্দর্য, আনন্দ।
বলে রিনি আবার চলে গেলো রওনকের কাছে। রওনক মাকে জড়িয়ে ধরে হাত নেড়ে নেড়ে, কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর দৃশ্য বোধহয় এটি। এই আলিঙ্গনে আমারও স্থান থাকতে পারতো। লজ্জায়, দুঃখে, ধিক্কারে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার। আমি এমনই অক্ষম এক বাবা, নিজের সন্তানকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরার ক্ষমতাও আজ আমার নেই।
লজ্জা রওনক নয়। অক্ষম রওনক নয়। লজ্জা আমার মত অক্ষম লোকের যারা প্রতিবন্ধী শিশুকে লজ্জা ভেবে লুকিয়ে রাখে কিংবা দূরে সরিয়ে দেয়। লজ্জা আমার মত কাপুরুষদের, যারা রওনকের মত শিশুদের বিশেষত্বকে বুঝতে না পেরে দাবিয়ে রাখে। আমরাই আসলে প্রতিবন্ধী। রওনকরা নয়।
-----
©নিভৃতা
রচনাকাল: ১১-০২-২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:১৩