অনেককাল আগের কথা।
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু আরশীনগরে জমিদার বাড়ির ছেলে আজিম উদ্দিন চৌধুরীর দাপট ও প্রতাপ তখনো বিদ্যমান। বাড়ি ভর্তি ছিল দাস দাসী। ছিল পোষা লাঠিয়াল। ছিল জাঁকজমক, শৌখিনতা আর বিলাসিতার বাহার। ছেলে মেয়ে বড় হত দাসীর কোলেই। বাড়ির ভেতরেই গুরু থাকতো জমিদার বাড়ির ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য। আজিম উদ্দিন চৌধুরীর একমাত্র ছেলে ছিলেন নিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী। দাসী আমেনা কোলে পিঠে করে তাকে মানুষ করে। অনেক পুরোনো দাসী হওয়ায় আমেনা ছিল জমিদার বাড়ির সব দাসদাসীর সর্দারনী। সে সবার উপর কর্তৃত্ব করতো। আমেনা জমিদার বাড়ির একজন আত্মীয়ের মতই হয়ে উঠেছিল। তার চলনে বলনে দাসীত্বের কোন ছাপ ছিল না। বেশবাসে মনে হতো সে যেনো জমিদার বাড়িরই একজন। আজিম উদ্দিনের স্ত্রীর সাথেও তার ছিল দারুণ সখ্যতা। আজিম উদ্দিনের স্ত্রী আমেনার উপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে দিন যাপন করতেন। এই জমিদার বাড়ির এক কর্মচারীর সাথেই আমেনার বিয়ে হয়। একটা মেয়ের জন্ম হতেই সেই কর্মচারী কোন একটা কঠিন অসুখে পড়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। আমেনা অল্প বয়সে বিধবা হয়ে যায়।আমেনার সেই মেয়েই হলেন জাহানারা বেগম। নিয়াজ উদ্দিনের ছেলের বয়স তখন দুই বছর। আমেনার তত্ত্বাবধানে নিয়াজ উদ্দিন আর জাহানারা বেগম পাশাপাশি বড় হতে থাকেন। একসাথে হেসে খেলে কাটতে থাকে তাদের সময়। রাতের বেলা তারা আমেনার দুই দিকে শুয়ে লাল পরি, নীল পরি, রাজপুত্র রাজকন্যার গল্প শুনতে শুনতে কখন যে দুজন ঘুমিয়ে পড়তেন টেরও পেতেন না। আর দুজনের দুটি হাত আমেনার কোলের উপর খেলা করতে করতে নেতিয়ে পড়তো ঠিকই কিন্তু আলাদা হতো না। দুটো সংযুক্ত কচি হাত বুকে নিয়ে আমেনাও এক সময় ঘুমের কোলে ঢলে পড়তেন।
এভাবেই তাদের শৈশব কাটে। শৈশব পেরিয়ে আসে কৈশোর। শৈশবের খেলার সাথী কৈশোরে হয়ে উঠে প্রাণের বন্ধু। এক মুহুর্ত দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারেন না তারা। এক সাথে পড়াশোনা, খেলাধুলা আর ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে গেঁথে কেটে যায় কৈশোর। কৈশোর পেরিয়ে আসে যৌবন।
যত দিন যায় জাহানারার রূপের ছটা যেনো তত আলো ছড়াতে থাকে। আর সেই রূপের আলোয় পৃথিবীর সব আলো ফিকে হয়ে উঠে নিয়াজের চোখে। বুকের ভেতরটায় ঝলমল করে শুধু একটি মুখ। জাহানারার প্রেমে বিভোর হয়ে দিন রাতের হিসেব ভুলে যান নিয়াজ। ওদিকে জাহানারা তো সেই কবেই নিজের মন প্রাণ সব সপে দিয়েছেন নিয়াজকে। দুজনে স্বপ্নের জাল বুনতে থাকেন। এঁকে চলেন ভালবাসার স্বর্গ নীড়। কিন্তু ওদের এই অবাধ মেলামেশার খবর নিয়াজ উদ্দিনের মায়ের কানে তুলে দেয় কোন এক দাসী। নিয়াজের মা ব্যাপারটা স্বামীকে জানান। আজিম উদ্দিন সব শুনে রাগে অগ্নিমূর্তী ধারণ করেন। আমেনা যতই এ পরিবারের আপন লোক হোক না কেন শেষ অবধি সে তো ঐ দাসীই। আর একটা দাসীর মেয়ে কোনভাবেই চৌধুরী বাড়ির বৌ হতে পারে না।
আমেনাকে তিনি বাড়ি থেকে বিতাড়িত করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু এতদিনের পুরোনো দাসীকে তাড়িয়ে দিতে রাজী হলেন না আজিম উদ্দিনের স্ত্রী। তিনি পরামর্শ দিলেন ছেলেকে বিয়ে দেয়ার। এরকম পদস্খলন জমিদার বাড়ির ছেলেদের একটু আধটু হয়েই থাকে। বিয়ে করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। নিয়াজের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো আরেক জমিদার বাড়ির মেয়ে সুরাইয়া বেগমের সাথে। জাহানারাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতে পারতেন না নিয়াজ। কিন্তু বাবার কথার অবাধ্য হওয়ারও সাহস ছিল না তার।
ভগ্ন হৃদয় নিয়ে একটা কাপুরুষের মত জাহানারাকে ছেড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লেন তিনি। কিন্তু ওদিকে তো অঘটন যা ঘটার তা ঘটেই গেছে। হৃদয় উজাড় করে যাকে ভালবেসেছিলেন, যার সাথে স্বর্গ নীড় গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তাকে যে শরীরটাও দিয়ে বসেছিলেন জাহানারা। একদিকে নিয়াজের বিয়ে হয় সুরাইয়া বেগমের সাথে আর অন্যদিকে জাহানারার গর্ভে ভ্রুণরূপে জন্ম নেয় নিয়াজের শরীরেরই একটি অংশ। রাগে, দুঃখে, ঘৃণায়, অপমানে আর যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে গলায় দড়ি দিতে চান জাহানারা। কিন্তু শরীরের ভেতরে বেড়ে উঠতে থাকা সেই ছোট্ট প্রাণটির জন্য মমতায় ভরে উঠে মনটা। মরতে গিয়েও মরতে পারেন না তিনি। এদিকে জমিদার বাড়িতে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। সেই কানাঘুষা সুরাইয়া বেগমের কান পর্যন্তও চলে গেছে।
আজিম উদ্দিন সব জানতে পেরে মেয়েকে নিয়ে আরশীনগর থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন আমেনাকে। সেই সাথে বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলারও আদেশ দিলেন। আমেনা আর জাহানারা বুকে পাথর বেঁধে আরশীনগর ছাড়লেন। অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা সইতে হলো তাদের। কিন্তু জাহানারা কিছুতেই বাচ্চাটাকে নষ্ট করলেন না। শেষ পর্যন্ত আরশীনগর থেকে অনেক দূরের একটি গ্রাম রূপশপুরে গিয়ে স্থায়ি হলেন তারা। অনেক সংগ্রাম করে ছেলেকে ধীরে ধীরে বড় করতে লাগলেন জাহানারা। এর মধ্যেই একদিন মাও চলে গেলেন তাকে ছেড়ে। ছেলে বড় হয়ে মোহনপুরে গেলো পড়তে। এবার ছেলেকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনেন তিনি। কিন্তু তার মত অভাগিনীর জন্য যে স্বপ্ন দেখাটাও পাপ। স্বপ্ন দেখলেই দুঃস্বপ্ন এসে কড়া নাড়তে শুরু করে তার দ্বারে।
হঠাৎই একদিন বিয়ে করে বউ নিয়ে হাজির হলো ওসমান। ওদের কাছে জানতে পারলেন মোহনপুরের কোন চৌধুরী বাড়ির মেয়ে ওসমানের বউ রজনী। মোহনপুরে নাকি ওদের খুব দাপট। কিন্তু তিনি জানতেন না যে আরশীনগরের সেই জমিদার বাড়ির চৌধুরীরাই এখন মোহনপুরের ত্রাস। ছেলে জেদ করে জাহানারা বেগম আর রজনীকে নিয়ে এলো মোহনপুরে। রজনী তখন সন্তানসম্ভবা। জাহানারা মোহনপুরে এসে একটা বিপদের গন্ধ পেলেন। তিনি বিপদটা এড়াতে চৌধুরীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটা আপোষ করার কথা ভাবতে লাগলেন। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি গোপনে চৌধুরী বাড়িতে হাজির হলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে যাদের দেখলেন তাতে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সুরাইয়া বেগম আর নিয়াজ উদ্দিনই যে রজনীর খালা আর খালু সেটা তার কল্পনাতেও ছিল না। জাহানারা বেগমই ওসমানের মা জানতে পেরে নিয়াজ উদ্দিন আর সুরাইয়া বেগমেরও বিস্ময়ের সীমা রইল না। নিয়াজ উদ্দিনের মনে ওসমানের জন্য মমতা উথলে উঠলো। কিন্তু স্ত্রীর সামনে তা প্রকাশ করার সাহস তিনি পেলেন না। সুরাইয়া বেগম জাহানারাকে দোতলায় নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে যা তা বলে গালি গালাজ আর অপমান করলেন নিয়াজ উদ্দিনের সামনেই। জাহানারার জন্য কষ্টে নিয়াজ উদ্দিনের অন্তর ফেটে গেলো। কিন্তু তবু তিনি চুপ করেই রইলেন। কারন তিনি যে আজন্মই মানুষ নামের এক মেরুদন্ডহীন প্রাণী।
সেদিন চোখের জল ফেলতে ফেলতে চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন জাহানারা বেগম। ওদিকে সুরাইয়া বেগমের ঘর থেকে জাহানারা বেগমকে উপরে নিয়ে যাওয়া দেখে ফেলেন আজগর উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বিস্মিত হন মায়ের এমন আচরণ দেখে। সচরাচর সুরাইয়া বেগম বাইরের কোন লোককে উপরে উঠতে দেন না। আর ইনি তো ওসমানের মা। ঘটনাটা বোঝার জন্য তিনি মায়ের ঘরে আড়ি পাতেন। আজগর উদ্দিনের সামনে বেরিয়ে আসে আসল সত্য। তিনি জানতে পারেন ঐ বিশ্বাসঘাতক ওসমানের শরীরে বইছে এই চৌধুরী বংশেরই রক্ত। ঐ ওসমান তার বাবারই অবৈধ সন্তান। একটা দাসীর ছেলে, একটা নর্দমার কীট কিছুতেই তার ভাই হতে পারে না। এই খবর যদি লোকে জানতে পারে চৌধুরী বাড়ির সব সম্মান, সব অহঙ্কার ধুলোয় মিশে যাবে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় আজগর উদ্দিনের। ঐ ওসমানকে খতম করে ফেললেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। রমিজ মিয়াকে সাথে নিয়ে ওসমানকে মারার সুযোগ খুঁজতে থাকেন আজগর উদ্দিন চৌধুরী। একদিন সেই সুযোগ পেয়েও যান। মনের সমস্ত আক্রোশ মিটিয়ে খুন করেন তিনি ওসমানকে। তারপর টূকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেন নদীতে।
------
চৌধুরী বাড়ি আর তাওফা ফুডের সব কীর্তিকলাপ ফলাও করে ছাপা হতে থাকলো সব দৈনিক পত্রিকায়। টিভিতেও বিভিন্ন ক্রাইম শো আর নিউজে প্রচার হতে লাগলো তাদের সব কুকীর্তির ভিডিও। তাওফা ফুডকে ব্যান করা হলো। বোরহান উদ্দিনের সংসদ সদস্যপদ বাতিল করা হলো। এমন কি তাকে দল থেকেও বহিষ্কার করা হলো। গ্রেফতার হলেন আজগর উদ্দিন। গ্রেফতার করা হলো বোরহান উদ্দিনকেও। রমিজ মিয়াও আজগর উদ্দিনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজী হলো। আজগর উদ্দিনকে রিমান্ডে নেয়া হলো। তিনি সব স্বীকার করে নিলেন। কিন্তু কী জন্য তিনি খুনটা করেছেন তা কিছুতেই প্রকাশ করলেন না। জাহানারা বেগম কী গোপন করলেন তা আর কেউ জানতে পারলো না। পল্লব সেই বিষয়ে আর দাদীকে জোর করতে চাইলো না। সে যে উদ্দেশ্যে মোহনপুরে এসেছে সেই উদ্দেশ্য তো সফল হয়ে গিয়েছেই। তার বাবার খুনীর ফাঁসি প্রায় নিশ্চিত। ওদিকে মোহনপুরও আজ দূর্নীতিমুক্ত। দাদীর কষ্টের কোন অতীত হয়তো আছে। অতীত খুঁড়ে দাদীর সেই কষ্টটাকে জাগিয়ে তোলার কী দরকার।
সময়ের অতল কবরে চাপা পড়ে ঢাকা পড়ে গেছে যে সত্য তাকে আর নাইবা টেনে উলঙ্গ করা হলো। যে সত্য জীবনের সব অর্থই মিথ্যে করে দেয় সে সত্য চাপাই থাক না চিরতরে।
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫০