এক
"পনেরো।“ তিতলি ডান হাতের তর্জনীর তিন নম্বর কড়ায় বাঁ হাতের তর্জনীটা দিয়ে স্পর্শ করে বলল। এই নিয়ে পনেরোটা পাখির ডাক শুনলো ও। একেকটা পাখি একেক সুরে ডাকে। কেউ ডাকে টিউ টিউ টিউ। কেউ ডাকে টুই টুই টুই। কেউ ডাকে পিউ, পিউ। কেউ ডাকে একেবারে চিকন সুরেলা সুরে কিয়া কিয়া। কেউ ডাকে উক উক। সবগুলো পাখির ডাকই তিতলির এখন মোটামুটি চেনা হয়ে গেছে। এই চেনা সুরগুলোর মধ্যে হঠাৎ যদি কোন অচেনা সুর ঢুকে পড়ে তিতলি তা তৎক্ষণাৎ ধরতে পারে। শুধু পাখির বেলায় না। যেকোন শব্দের বেলায়ই এক তীক্ষ্ণ অনুভূতিশক্তি কাজ করে তিতলির মনে। যেমন, ডোরবেল। ডোরবেল তো একই সুরে বাজে। তার আবার চেনা অচেনা সুর কী? আসলে এই ডোরবেলও একেক লোকের স্পর্শে একেক রকম বাজে। যখন আবীর বেল বাজায়, তিতলি সাথে সাথে বুঝতে পারে এটা বাবা। যদি তানি বেল বাজায়, তিতলি ঠিকই বুঝে ফেলে এটা মামনি। আর যদি অপরিচিত কেউ বেল বাজায়, তিতলির মোটেই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এটা অপরিচিত লোক। সবাই বলে কোকিল নাকি কুহু কুহু সুরে ডাকে। কিন্তু তিতলি লক্ষ্য করেছে কোকিল শুধু কুহু সুরেই ডাকে না। অন্য সুরেও ডাকে। সেই ডাকটাও মিষ্টি। এটা যদি সে তুতনকে বলে তুতন বলবে,
"তুই কী করে বুঝলি ওটা কোকিলের ডাক? কোকিলকে তো দেখা যায় না। কোকিল লুকিয়ে থাকে।" কিন্তু সত্যি কথা হলো কোকিলকে প্রায়ই দেখে তিতলি। ঐ হিজল গাছটায় এসে বসে। আর কি সুন্দর ওদের গানের গলা। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। আর টকটকে লাল দুটি চোখ। কিন্তু সে কথা কিছুতেই তুতন বিশ্বাস করবে না। বলবে তিতলি বানিয়ে বলছে এসব কথা।
প্রায় সব গুলো পাখির ডাকই মিষ্টি লাগে তিতলির। তবে একেকটা পাখি আবার একটু কর্কশ স্বরে ডাকে। যেমন টে টে টে, কেক কেক কেক। তাও ভাল লাগে ওর। সব মানুষ কি আর এক রকম হয়? কেউ একটু ভাল হয়, তো কেউ একটু বেশি ভাল হয়। পাখিদের বেলায়ও তাই। কিন্তু সমস্যা হল কিছু কিছু মানুষের বেলায় ব্যাপারটা ধরা যায় না। সে মানুষটা একটু ভাল, না বেশি ভাল, নাকি ভালই না বোঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। যেমন তুতন। তুতনটা খুব বেশি ভাল। তুতনকে তিতলির ভীষণ ভাল লাগে। তিতলির বেস্ট ফ্রেন্ড ও। অবশ্য বেস্টও বলা যায় না। আর কোন বন্ধু থাকলে তবে না বেস্ট বলতে হয়। ওর তো ঐ একটাই বন্ধু। তুতন। আর কোন বন্ধু নেই তিতলির। বন্ধু নেই কারণ আর কারো সাথেই কথা বলতে ভাল লাগে না ওর। তুতনের তুতন নামটাও তিতলি রেখেছে। নিজের নামের সাথে মিলিয়ে। তুতনের আসল নাম রিশাদ।
আর ভাল লাগে মিশু মিসকে। এই টিচার অনেক ভাল। অনেক আদর করেন তিতলিকে। ঠিক মত টিফিন করেছে কিনা তাও দেখেন। তিতলি হোমওয়ার্ক না করলেও বকা দেন না। আর তিতলির যদি কখনো মন খারাপ হয় তাও ধরে ফেলেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা তিতলির মনের ভেতরে যে আরো একটা মন আছে সেই মন বলে মিশু টিচার খুব ভাল। আরেকটা ব্যাপার হল এই মিশু টিচার দেখতে ওর খুব আপন একজন মানুষের মত। কিন্তু সেই আপন মানুষটা যে কে তিতলি অনেক ভেবেও কিছুতেই বের করতে পারে না। মিষ্টি একটা মুখ মনের কোণে উঁকি দিয়ে হঠাৎই আবার হারিয়ে যায়। বড্ড মন খারাপ হয় তিতলির তখন।
আর ভালো লাগে ঐ বুড়িটাকে, যে প্রতিদিন ওদের গেটের পাশে এসে বসে থাকে। আর "ও কুলসুম, কুলসুম কই গেলি বুজান আমারে ফালাইয়া" বলে কাঁদতে থাকে। ঐ বুড়িকে তিতলি মায়া বুড়ি বলে ডাকে। কারণ বুড়িটাকে ওর খুব মায়া লাগে। মনে হয় যেন অনেকদিনের চেনা ঐ বুড়ি। ঐ বুড়ির সাথে অনেক কথা বলে ও।
"মায়া বুড়ি কাঁদো কেন তুমি।"
"কান্দি কুলসুমের লাইগা। কই যে গেলো মাইয়াডা।"
মায়া বুড়ির হাতে একটা লাঠি থাকে সব সময়। তিতলি জিজ্ঞেস করে,
"মায়া বুড়ি তোমার লাঠির ভেতর কী?"
মায়া বুড়ি ফোঁকলা দাতে হেসে বলে,
"শরবত।"
এই কথা শোনে ফিক করে হেসে ওঠে তিতলি। তিতলি হাসলে সাথে সাথে বুড়িও হাসে। বুড়ি হাসলে বুড়ির ফোঁকলা দাতগুলি বের হয়ে পড়ে। তিতলি তখন জিজ্ঞেস করে,
---ও মায়া বুড়ি, তোমার দাঁত নিলো কে?
---দাঁত? দাঁতগুলান সব ইন্দুরে খায়া ফালাইসে গো বইন।
---এম্মা ইঁদুর খেয়ে ফেলেছে! কী সর্বনাশ!
বুড়ি কৃত্রিম দুঃখ করে বলে,
---হ রে বইন বড়ই সব্বনাশ।
তিতলি আবার বলে,
---মায়া বুড়ি তোমার বাড়ি কই?"
---বাড়ি নাইরে মা। আগে ঐ বস্তিতে থাকতাম। অহন বাড়ি বাড়ি আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুইরা বেড়াই।
---ঘুমাও কই তুমি?
---যেইহানে জায়গা পাই ঐহানেই ঘুমাইরে বইন।
মায়া বুড়ি কখনো ওকে মা বলে ডাকে। কখনো বইন বলে ডাকে। কখনো আবার ডাকে বুজান। মোটামুটি ঐ একই ধরণের কথা হয় মায়া বুড়ির সাথে তিতলির প্রতিদিন।
সবশেষে তিতলি বলে,
---তোমার খিদে পেয়েছে মায়া বুড়ি?
মায়াবুড়ি বলে,
---হ’রে বুজান। পেটে অনেক খিদা। রাক্ষুসী পেট খালি খাওন চায়।
তিতলি তখন এক দৌড়ে ঘরের ভেতরে চলে যায়। তারপর মায়াবুড়ির জন্য বিস্কুট পাউরুটি যা পায় তাই নিয়ে, আবার এক দৌড়ে মায়া বুড়ির কাছে ফিরে আসে। খাবারটা বুড়ির হাতে দিয়ে বলে,
---মায়া বুড়ি, তোমার যখনই খিদা লাগবে তখনি আমার কাছে চলে আসবে, কেমন?
---আইচ্ছা বইন। তুমার মনটা কত্ত বড়। অনেক বড় হইবা তুমি বুজান।
বুড়ির চোখ জলে ভরে ওঠে। কেঁদে কেঁদে তিতলির জন্য দোয়া করতে করতে লাঠি ভর দিয়ে দিয়ে চলে যায় মায়া বুড়ি। তিতলি গেটে দাঁড়িয়ে যতক্ষণ বুড়িকে দেখা যায় ততক্ষণ দেখতে থাকে। বুড়ি যখন চোখের আড়ালে চলে যায় তখনো তিতলি দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ বুড়ি চোখের আড়ালে হারিয়ে গেলেও পাকা রাস্তার উপর বুড়ির লাঠির খট খট আওয়াজ তখনো তিতলির কানে আসতে থাকে। যখন আওয়াজটা মিলিয়ে যায় তখনই তিতলি ঘরের দিকে পা বাড়ায়। তিতলি বুঝতে পারে তানি ঐ মায়াবুড়িকে একটুও পছন্দ করে না। খুব বিরক্ত হয়। কিন্তু তারপরও কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। কে জানে কেন?
তিতলির ভাল লাগা মানুষগুলো এই হাতে গুণা কজন। বাকিরাও হয়তো ভাল। কিন্তু আর কারো সাথেই কথা বলতে ভাল লাগে না ওর। ওর মনের ভেতরে যে আরো একটা মন আছে সেই মন যার সাথে কথা বলতে বলে তিতলি শুধু তার সাথেই কথা বলে। আর কথা বলে গাছগাছালি পশু পাখির সাথে। এরা সবাই খুব ভাল। এরা সবাই ওর বন্ধু। এদেরকে বোঝা যায়। কিন্তু মানুষগুলোকে বোঝা বড় কঠিন। সব মানুষ না। কিছু কিছু মানুষ।
পায়ের কাছে হঠাৎ এক নরম নরম স্পর্শ অনুভূত হতেই হাসি ফুটে উঠলো তিতলির মুখে। মমতায় ভরে উঠলো দুটি চোখ। নরম নরম শরীরটা তিতলির পায়ের সাথে গা ঘষতে লাগলো। তিতলি চুপ করে রইল প্রথমে। তিতলির সাড়া না পেয়ে নরম শরীরটা বলে উঠলো,
---মিউ।
---তুই এসে গেছিস বিল্লু?
---মিউ (হ্যাঁ)।
---এতদিন কোথায় ছিলি বলতো। কত অপেক্ষা করেছি তোর জন্য।
---মিউ মিউ মিউ। (এই তো ঐ যে সামনের বাড়িটায়।)
---আমার কথা বুঝি মনে পড়ে না তোর?
---মিউ মিউ। (পড়ে তো। তাই তো এলাম।)
---এখন এসেছেন উনি। এতদিনে!
কপট অভিমানে মুখ বাঁকালো তিতলি।
---মিউ মিউ মিউ। (তো কী করবো বলো? তোমার বাড়িতে তো কেউ আমাকে পছন্দ করে না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। ঠিক মত পেট পুরে খেতেও পারি না এখানে।)
---ওখানে বুঝি অনেক খাবার দেয় তোকে?
---মিউ মিউ মিউ। (তা দেয়। অন্তত পেটটা ভরে খেতে পারি। ওখানে একটা ইয়া বড় ডাস্টবিন আছে। সেখানে খাবারের অভাব হয় না গো।)
---কী কী খেলি আজ?
---মিউ মিউ মিউ। (মুরগীর বড় বড় হাড় আর ইয়া মোটা দুইটা ইঁদুর।)
এই বিড়ালটা প্রায়ই আসে তিতলির কাছে। সাদার উপর কালো ছোপ ছোপ গায়ের রঙ ওর। বড় মায়াবতী বিড়াল ও। আর কী তুলতুলে ওর শরীর! চোখ দুটো মন কেড়ে নেয়। মনে হয় যেন গাঢ় করে কাজল টানা দুটি চোখে। বড় মায়া হয় তিতলির। পুকুর পাড়ের এই চাতালটায় যখন ও একা একা বসে পাখির ডাক শোনে, গাছের সাথে একা একা কথা বলে তখন বিড়ালটাও এসে ওর পায়ের কাছে বসে থাকে। তিতলির ভীষণ ইচ্ছে হয় ওর তুলতুলে শরীরটায় হাত বুলিয়ে আদর করতে। কিন্তু তিতলি কখনোই তা করে না। একবার বিড়ালটার গায়ে হাত দিয়ে আদর করেছিল তিতলি। আবীর দেখতে পেয়ে মানা করে দিলো। বলল, বিড়ালের লোম থেকে নাকি অনেক রোগ হয়। সেই থেকে তিতলি আর বিড়ালটার গায়ে হাত দেয় না। দূর থেকেই কথা বলে। বিড়ালটা ওর সব কথার জবাব দেয়। বিড়ালটার সব কথা তিতলি বুঝতে পারে।
তিতলিদের বাড়িটা গাছগাছালিতে ভরপুর। সারি সারি নারিকেল আর সুপারির গাছ। সেই সাথে হিজল, আকাশি, দেবদারু। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। গাছগুলোকে তিতলির বড় আপন মনে হয়। কী যেন এক মায়ার বাঁধন ওর, ওদের সাথে। পুকুর পাড়ে যে বড় হিজল গাছটা আছে, ওর সাথে তিতলির অনেক ভাব। অনেক কথা হয় তিতলির হিজল গাছটার সাথে। প্রায় প্রতিটি গাছেরই একেকটা নাম আছে। নামগুলো তিতলিই রেখেছে। হিজল গাছটার নাম রেখেছে হিজু।
---বলো তো হিজু, তোমার আর ঐ পুকুরের মাঝে মিলটা কী?
---ওমা! পুকুরের সাথে আমার আবার কী মিল থাকবে? কী যে আজব সব কথা বলো না তুমি খুকি!
তিতলি বিজ্ঞের মত গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
---আছে আছে। একটু ভেবে দেখো।
---উমমমম। নাহ, কোন মিলই তো খুঁজে পেলাম না গো। বলো না খুকি মিলটা কী?
---নাহ। তোমার মাথায় একেবারেই ঘিলু নেই। মিলটা হলো, তোমার কাছেও জল আছে, আবার ঐ পুকুরেরও জল আছে। এইবার বুঝলে বোকারাম বৎস?
---আরে তাই তো। এভাবে তো ভাবিনি। সত্যি খুকি তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি।
মাঝে মাঝে হিজল গাছটা মন ভারী করে থাকে। তখন তিতলি ওকে নানা রকমের ছড়া শুনিয়ে মন ভাল করে দেয়। তিতলিদের বাড়িতে আরো আছে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান। সেই বাগানে ফোটে কত যে বাহারী ফুল। সেই বাগানটাও তিতলির খুব প্রিয়। আর সবচেয়ে প্রিয় এই চাতালটা। এই চাতালটায় বসার জন্য সিমেন্ট দিয়ে গোল করে বাঁধানো বেঞ্চ আছে। আর উপরটা ছাতার মত করে ঢালাই দেয়া। ভারী সুন্দর এই চাতাল। এখানে এসে বসলে তিতলির আর উঠতে মন চায় না। ইচ্ছে করে সারাদিন রাত এখানেই পড়ে থাকে। সারাটা বিকেল ও এখানেই কাটায়।
বিকেলের আলো একটু একটু করে করে নিভে আসছে। সেই সাথে তিতলির মুখটাও আলোহীন হয়ে পড়ছে। এখনি চলে যেতে হবে ঘরে। মনটা খারাপ হয়ে যায় তিতলির। উদাস চোখে চেয়ে থাকে পুকুরের ঐ টলটলে জলের দিকে। মাছগুলো সব টুকর টুকর শব্দ তুলছে।
তিতলি একটা ইটের টুকরো তুলে ঢিল দেয় পানিতে। সবগুলো মাছ এক সাথে টুপ করে ডুবে যায় পানিতে। তিতলি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। মাছগুলো আবার ভেসে উঠে টুকর টুকর শব্দ তোলে। তিতলি হেসে ওঠে। আবার ঢিল দেয়। মাছগুলো টুপ করে আবার ডুবে যায়। এভাবেই তিতলির সাথে চলে মাছেদের লুকোচুরি খেলা।
---------
রচনাকাল - ১৪-০৩-২০১৮
©নিভৃতা
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:১৩