ছবি: ইন্টারনেট
এক
স্টেশনে পা রাখতেই কোত্থেকে একটা ঢিল এসে লাগলো কপালে। ব্যথায় কুঁকড়ে কপালে হাত দিতেই হাতে ভেজা ভেজা কিছু অনুভূত হলো। কপাল থেকে হাতটা চোখের সামনে ধরতেই দেখলাম হাতে রক্ত লেগে আছে। বোধহয় কেটে গেছে কপালটা। যেদিক থেকে ঢিলটা এসেছে সেদিকে তাকিয়ে দেখি একটা লোক আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। যেন খুব মজা পেয়েছে। পাগল হবে হয়তো। লম্বা চুল আর দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে মুখটা ঠাওর করা যায় না। পরনে শতচ্ছিন্ন নোংরা শার্ট আর প্যান্ট। ওর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে পাগলটা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটতে লাগল। বুঝতে পারলাম এই পাগলটাই আমাকে ঢিল মেরেছে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে একটা রিকশা ডেকে রিকশায় উঠে পড়লাম। রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করলো
-স্যারের কপালে কী হইসে? ঐ পাগলটা ঢিল মারসে মনে হয়।
-হ্যাঁ। তুমি কিভাবে বুঝলে?
-এইটা না বুজার কী হইলো?পাগলটা দিনরাত ঐ স্টেশনেই পইড়া থাকে। এমনিতে চুপচাপ কিছু করে না। খালি বইয়া থাকে নইলে শুইয়া থাকে। কিন্তু হঠাৎ কী হয় কে জানে, আচমকা মানুষরে ঢিল মারে। কারোর মাথা কাইটা যায় আবার কারোর ফাইটা যায়। মাজেমইদ্দে মাইনষের পিডা খাইয়া ভাগে। আবার এইহানেই ফিইরা আসে।
আমি আর কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। মনের ভেতর নানা চিন্তা ঘোরপাক খাচ্ছে। পাগল নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। এই রকম মফস্বল এলাকায় ভাল কোন হোটেল থাকে না। মোটামুটি দেখে একটা হোটেলে উঠলাম। কপালটা অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করলাম। এখানে কোন আত্মীয় স্বজন নেই আমার। কত দিন পর এই সোমনগরে এলাম! প্রায় ত্রিশ বছর। কত পাল্টে গেছে সব কিছু। অনেক উন্নত হয়ে গেছে শহরটি। আমার জীবনের তিনটি বছর কেটেছে এখানে। বাবার ছিল বদলির চাকরি। সেই সূত্রেই তিনটি বছর এখানে থাকা হয়েছিল। এস এস সি পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েকদিন পরই আমরা এখান থেকে চলে যাই। এখানে যত বন্ধু হয়েছিল তাদের সাথেও বিচ্ছেদ ঘটে যায়। বিবেকের দহনে পুড়তে পুড়তে এতদিন পর আজ ফের আসতে হল এই সোমনগরে। কে জানে রতনরা সেই আগের বাসায় আছে কি না। যে করেই হোক রতনকে খুঁজে বের করতেই হবে।
আজ আমি প্রতিষ্ঠিত। বাড়ি, গাড়ি, টাকাপয়সা কোন কিছুরই অভাব নেই। প্রভাব আর প্রতিপত্তির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে এতদিন ভাবার অবকাশ হয়নি। অপরাধবোধটাও সময়ের সাথে সাথে প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কদিন ধরে সেই অপরাধবোধটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম আমার সারা জীবনের সঞ্চয় আসলে শূন্য। আমার যা কিছু এখন আছে সবই তো দাঁড়িয়ে আছে একটা ভুলের উপর। গণিতের ক্ষেত্রে ভুল মানেই শূন্য। শূন্যকে যত বড় অংক দিয়েই গুণ করা হোক না কেন ফলাফল তো শূন্যই আসে। শূন্যের সাথে আমার এতসব প্রভাব প্রতিপত্তি সব গুণ করে আমি শেষ পর্যন্ত দেখলাম আমার ফলাফলের ঘরে তো সেই শূন্যই পড়ে আছে। হায়! এতদিন আমি তবে কীসের পেছনে ছুটলাম! আমি তো সেই শূন্যতেই পড়ে আছি। উঠতে বসতে বিবেকের দংশনে দংশিত হতে লাগলাম আমি। সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে, দংশন থেকে কিছুটা হলেও যদি নিস্তার পাওয়া যায় সেই আশায় আজ এই সোমনগর আসা।
দুই
রতনদের সেই আগের বাসাটা এখনো আছে। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে পরিত্যক্ত কোন বাসা। পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। দেখে মনে হয় না এই ঘরে কেউ থাকে। মনটা একটু দমে গেলো আমার। রতনরা আদৌ এখানে থাকে কী? নিশ্চয়ই না। ওর মত একটা উজ্জ্বল মেধাবী ছেলে এই জরাজীর্ণ ঘরে পড়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তবু দরজার কড়াটা নাড়লাম আমি। যদি রতনদের কোন খবর পাওয়া যায়। দুই তিনবার কড়া নাড়ার পর দরজা খুললেন এক বৃদ্ধা মহিলা। পরনে অনেক পুরনো, শীর্ণ কিন্তু পরিষ্কার একটা শাড়ি। অনেকক্ষণ তাকানোর পর চিনতে পারলাম। রতনের আম্মা। কিছুটা অবাক হলাম। এই জীর্ণ ঘরেই এখনও আছেন ওরা? পা ধরে সালাম করতেই খালাম্মা বললেন,
-কে তুমি বাবা?
-আমি পলক। রতনের বন্ধু। এক সাথে পড়তাম আমরা। রতনের সাথে প্রায়ই আসতাম আপনাদের বাসায়। আপনি কত রকমের পিঠা বানাতেন। আদর করে কত কী খাওয়াতেন।
বৃদ্ধার চোখ ছলছল করে উঠলো।
-রতনের বন্ধু! আজকাল কোন কিছুই মনে থাকে না, বাবা। পুরোনো কত কথা ভুলে গেছি। আসো, আসো। ভেতরে আসো। বস।
আমি ভেতরে ঢুকলাম। সব দিকেই জীর্ণতার ছায়া। তবু পরিষ্কার পরিপাটি করে রাখা সবকিছু।
-খালাম্মা, রতন এখন কোথায় থাকে?
খালাম্মা কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন
-রতন তো সেই কবেই শেষ হয়ে গেছে, বাবা।
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-শেষ হয়ে গেছে মানে? কী বলছেন বুঝতে পারছি না?
-শেষ হয়ে গেছে মানে পাগল হয়ে গেছে। আগে ঘরে বেঁধে রাখতাম। কিন্তু রতনের আব্বা মারা যাওয়ার পর তাও এখন সম্ভব হয় না। আমি একা কী করে ওকে সামলাই বল? আত্মীয় স্বজন কিছু আছে। কিন্তু কে আর সাধ করে পাগলের বোঝা বয়, বলো?
আমার বিস্ময়ের পরিধি বেড়ে গলো। জিজ্ঞেস করলাম,
-কী করে এমন হলো?
-সেই মেট্রিক পরীক্ষার পর থেকেই ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যায় রতন।
আমি স্তব্ধ বিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। আমার গলাটা হঠাৎ করেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। শূন্যগুলো যেন আকারে আরো বড় হয়ে চোখের সামনে দুলতে লাগলো।
-কেন যে ওর সাথেই এমনটা ঘটলো? এই কষ্ট ছেলে আমার সইতে পারলো না। কী লক্ষ্মী ছেলে ছিল রতন, কত মেধাবী। রতন যেন একটা রত্নই ছিল। সবাই ওকে নিয়ে কত গর্ব করতো। মাস্টাররা বলতেন, রতন গ্রামের নাম উজ্জ্বল করবে। তুমি তো সব জানোই। যেমন লেখাপড়ায় তেমন ব্যবহারে। সেই হীরার টুকরো ছেলেকে আমার, শেষ করে দিল ওরা।
আমার বলতে ইচ্ছে করল, "আপনার ছেলেকে ওরা শেষ করেনি খালাম্মা। শেষ করেছি আমি। সেই সাথে চুরমার করেছি আপনাদের সব স্বপ্ন, আশা-ভরসা।"
কিন্তু আজও আমি কিছুই বলতে পারলাম না, যেমন পারিনি সেদিন। আমার সব কথা যেন দলা বেঁধে আটকে রইলো গলায়। নিজেকে একটা কাপুরুষ ছাড়া কিছুই মনে হলো না।
খালাম্মা বলে যান,
-একমাত্র ছেলে ছিল রতন। আমাদের সব আশা ভরসা। ছেলে পাগল হল সেই সাথে আমরাও মরলাম। মরে মরেই বেঁচে ছিলাম। ইচ্ছে হত তিনজন একসাথে গলায় ফাঁস দিয়ে মরে যাই। শেষ পর্যন্ত রতনের বাবা মরে বেঁচে গেলেন। এতদিন তাও কষ্টটাকে দুজনে ভাগ করে বেঁচে ছিলাম। এখন তো একেবারেই একা। বড় কষ্ট! বড় ভারী এ কষ্টের বোঝা। আর যে সইতে পারি না বাবা!
ঘৃণায় মনে মনে থু থু দেই নিজেকে। নিজেকে একটা খুনি মনে হয়। তিনটি মানুষকে খুন করেছি আমি। ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে বিবেকের দংশন থেকে বাঁচার জন্য এসেছিলাম এখানে। কিন্তু জানা ছিল না, আমি আসলে কোন ভুল করিনি। করেছি পাপ। মহাপাপ। যে পাপের কোন ক্ষমা নেই। কোন রকমে শক্তি সঞ্চয় করে কথা বের করলাম মুখ দিয়ে,
-খালাম্মা রতন এখন কোথায়?
-কোথায় আর থাকবে বলো? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। বেশিরভাগ সময় স্টেশনটার পাশে বসে থাকে। আর মানুষকে ঢিল মারে। মাঝেমাঝে মানুষেরা অতিষ্ঠ হয়ে দৌড়ানি দেয়।
আমি আর সইতে পারছিলাম না। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ঐ পাগলটার চেহারা। ঐ পাগলটাই তবে রতন! কী দশা করেছি আমি ওর! নিজের অজান্তেই হাত দুটো চলে যায় চুলে। খামচে ধরি নিজের চুলগুলো। টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে সব চুল।
-কী হয়েছে বাবা? এমন করছো কেন? রতনের কথা শুনে খারাপ লাগছে?
আমি নীরবে মাথা নাড়ি। ভেতরটা অবিরত ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। জানি, এই দহন থেকে আমার আর মুক্তি নেই। মুক্তি আমি চাইও না। এভাবেই ক্ষতবিক্ষত হতে থাকুক আমার হৃদয় আমৃত্যু।
তিন
আমি ভাল ছাত্র ছিলাম ঠিক, কিন্তু রতনের মত ভাল কোনদিনই ছিলাম না। রতনের মত মেধাবী খুব একটা দেখা যায় না। রতনের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হবে। মানুষের সেবা করবে। বিনামূল্যে গরীব মানুষের চিকিৎসা করবে।
এস এস সি পরীক্ষা চলছিল আমাদের। সেদিন ছিল ইংরেজী দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা। রতন ক্লাসের ফার্স্ট বয়। আর আমি সেকেন্ড। সেই সূত্রে দুজনের আসন কাছাকাছি পড়েছিল। আমি জীবনে কোনদিন নকল করিনি। কিন্তু ইংরেজি একটা বড় কোটেশান কিছুতেই মুখস্থ না হওয়াতে সেটা টুকে এনেছিলাম। কোটেশানটা যেই খাতায় টুকতে যাবো ঠিক তখনই পরীক্ষক কাছে আসতে শুরু করলেন। একে তো নকল করায় অনভ্যস্ত, তার উপর ভয়। পরীক্ষককে দেখেই আমি টোকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। টোকাটা গিয়ে পড়লো রতনের উপর। রতন টোকাটা হাত দিয়ে ফেলতে যাবে ঠিক তখনই পরীক্ষক কাছে এসে দাঁড়ান এবং রতনের হাত থেকে টোকাটা নিয়ে সাথে সাথে ওকে পরীক্ষা থেকে বহিষ্কার করেন।
রতন অনেক কান্নাকাটি করলো। পরীক্ষকের পা ধরে অনুনয় বিনয় করলো। বারবার বলতে থাকলো ঐ টোকাটা ওর না। কিন্তু পরীক্ষক তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।
তারপর রতন চুপচাপ হল থেকে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু একবারও বলল না টোকাটা আসলে আমার। আমি শুধু কাপুরুষের মত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম রতনের বেরিয়ে যাওয়া। কিছুই বলতে পারলাম না একটি বছর হারিয়ে ফেলার ভয়ে।
এরপর রতনকে মুখ দেখানোর সাহসও আমার ছিল না। আমি রতনকে শেষ দেখেছিলাম অনেক দূর থেকে, একটি গাছের নিচে বসে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। লজ্জায় কাছে যেতে পারিনি। ভেবেছিলাম, এই মন খারাপ কেটে যাবে ওর। আগামী বছর আবার পরীক্ষা দিবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
কে জানতো রতনের আগামী সেদিনই মৃত্যুবরণ করেছে। বিনা দোষে দোষী রতন সেদিনই মরে গেছে। আর জন্ম হয়েছে আমার মত এক ভণ্ডের।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:০৮