somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ নাবিলা কাহিনী ৪ - অচেনা হৃদয় (দ্বিতীয় পর্ব)

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
ধারাবাহিকতার জন্য আগে প্রথম পর্ব পড়ে আসুন, নাবিলা কাহিনী ৪ - অচেনা হৃদয় (প্রথম পর্ব)



তিন

লাবীবের চেহারা দেখেই নাবিলা বুঝল কতটা হতাশা আর বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা বুকের ভিতর নিয়ে চরম এক নৈরাশ্য ভরা দুইচোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। লাবীবের বর্তমান অবস্থার জন্য ওকে কোনভাবে দোষ দেয়া যায়না। গত পরশুদিন লাবনী নাবিলার উপদেশ মতো লাবীবকে আলাদা ঘরে ডেকে এনে রাতেরবেলা মীরাকে নিয়ে পুরো ঘটনার আদ্যপান্ত্য বলে দিয়েছে। লাবীব এতটাই শকড হয়েছে যে গতকালকে থেকে অফিসেই যাচ্ছে না। বেচারা, এত পছন্দ করে কোন মেয়েকে বিয়ে করার পর যদি হুট করেই শুনে মেয়েটা সমকামি, তাহলে সেটা সহ্য করা আসলেও কঠিন। বাসায় কাউকে বলতেও পারছে না। বাসায় নাকি প্রায় জোর করেই ও লাবনীকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল! আজকে নাবিলা নিজে ফোন করে লাবীবকে সন্ধ্যার সময় দেখা করার জন্য আসতে বলেছে। লাবীবকে আবার শক্ত হয়ে ঘুরে দাড়াতে ও সাহায্য করতে চাইছে। তাছাড়া লাবনীর চিকিৎসা জন্যও লাবীবের সাহায্য অবশ্যই লাগবে।
-লাবীব, আমি জানি আপনি প্রচন্ডভাবে শকড হয়েছেন। এটাই খুব স্বাভাবিক। আপনার জায়গায় যে কোন পুরুষ ঠিক একই আচরন করত। বৈবাহিক জীবনে বিশ্বাসভঙ্গতা খুব মারাত্মক অপরাধ। আপনি নিজের মন শক্ত করুন। লাবনী যে অপরাধ করেছে অথবা যার প্ররোচনায় করেছে তাকে আপনার উপযুক্ত শাস্তি দিতেই হবে। এটা আপনার নৈতিক অধিকার।
-ওর সাথে আমি এখন কিভাবে আর সংসার করব?
-সমস্যা কোথায়? লাবনী যে একজন নারী, সম্পূর্ণভাবেই নারী সেটা আপনি সবার চেয়ে অনেক ভালো করে জানেন। ও যদি এই সত্যটা আপনাকে না বলতো, আপনি কি এত কিছু টের পেতেন? আপনার সাতমাসের বৈবাহিক জীবনে কখন কোন উলটা পালটা কিছু কি মনে হয়েছে?
-না। আর এটার জন্য আমার সবচেয়ে বেশী ভয় লাগছে। যে এভাবে লুকিয়ে এই ভয়ংকর অপরাধ করতে পারে, সে সুযোগ পেলে আবারও করবে।
-একদম ঠিক বলেছেন। লাবনীকে কোনভাবেই এইধরনের সর্ম্পকে আর জড়াতে দেয়া যাবে না।
-তাতে কি লাভ হবে? ও তো বাকি সব মেয়েদের থেকে ভিন্ন। ঠিকই আমাকে ফেলে এই মীরা নামের নষ্ট মেয়েটার কাছে চলে যাবে।
-কে বলেছে আপনাকে লাবনী ভিন্ন মেয়ে? আপনি কি জানেন না, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে সুরা রুমে বলেছেনঃ ‘‘এবং তার নিদর্শন সমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন হচ্ছে - তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন। যেন তোমরা তার কাছে মানসিক শান্তি লাভ করতে পারো। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও আন্তরিকতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’’ (সূরা রুম, ২১)। তিনি আবারও সুরা আরাফে বলেছেনঃ “তিনি আল্লাহ যিনি তোমাদেরকে জোড়া হিসেবে তৈরি করেছেন যেন তোমরা একে অপরের কাছ থেকে শান্তি ও আরাম পাও।’’ (সূরা আরাফ, ১৮৯)। সাথী বা জোড়কে পবিত্র কুরআন শরীফে ‘আযওয়াজ' নামে অভিহিত করা হয়েছে।
-লাবনী কিভাবে আমার জোড় হবে? ও তো প্রেম করে বেড়ায় ঐ মেয়েটার সাথে!
-নারী ও পুরুষের মধ্যকার যে স্বাভাবিক সর্ম্পক সেটাই প্রেম। অন্যভাবে যদি বলি, বিপরীত লিঙ্গধারী একজন আর একজনের জন্য নিজের মন, নিজের বিশ্বাস ও নিজস্ব অস্তিত্ব সঁপে দেয়ার নামই প্রেম বা ভালোবাসা। একটা মেয়ের সাথে আরেকটা মেয়ের সর্ম্পক কখনই প্রেম বা ভালোবাসা হতে পারে না। এটা একধরনের অস্বাভাবিক সর্ম্পক।
-কেন হতে পারে না ম্যাডাম? লাবনী তো আমাকে বলেছে ও মীরা’কে প্রচন্ড ভালোবাসে?
-যে সম্পর্ক সৃষ্টিকর্তা নিজেই বলেছেন সৃষ্টি করেন নি, সেখানে সামান্য মানুষ কিভাবে এই সম্পর্ক সৃষ্টি করবে, আপনিই বলুন?
-কিন্তু সবকিছুর পরেও আমার ভয় লাগছে, ও যদি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চায় বা চলে যায়?
-আপনি যে ওকে প্রচন্ড ভালোবাসেন সেটা লাবনী খুব ভালো করে জানে এবং বুঝে। আমি ইচ্ছে করেই বলেছিলাম, তুমি লাবীব’কে একবারে ছেড়ে দাও, ডিভোর্স দিয়ে দাও, দিয়ে মীরার কাছে পুরোপুরি চলে যাও। লাবনী আমাকে যে উত্তর দিয়েছিল সেটা হলোঃ “আমি লাবীব’কে ডিভোর্স দিব বললেই ও সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে যাবে। আমি ছাড়া ও একদিনও সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারবে না। ওর এত কষ্ট হবে যে সেটা আমি কোনভাবেই সহ্য করতে পারব না। আপনি আমাকে এই ভয়ংকর প্রস্তাব আর দিবেন না। এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। এটা আমি পারলে আপনার কাছে আর আসতাম না”।

লাবীব যেন নিজের কানকেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না লাবনী এই কথাগুলি বলেছে! ওর বুকভরা একতরফা ভালোবাসা তাহলে পুরোপুরি বৃথা যায়নি! লাবনীকে শতভাগ ওর জীবনে ফিরে পাবার সম্ভাবনা কি আদৌ আছে!

দ্বিধাগ্রস্থ চোখে লাবীবকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাবিলা আবার বলা শুরু করলঃ
-লাবীব, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে সূরা কাহাফে বলেছেনঃ "মানুষ বড়ই তাড়াহুড়ো করে” (সূরা কাহাফ, ৫৪)। আর তাড়াহুড়ো করতে যেয়েই মানুষ ভুল করে। আপনি লাবনীকে নিয়ে দ্রুতই কোন সিদ্ধান্ত নিবেন না। আমি আপনাকে অনুরোধ করব নিজের মনকে খুব ভালো করে জিজ্ঞেস করুন, আপনি কি লাবনীকে সত্যই খুব ভালোবাসেন? আপনি কি ওকে ফিরে পেতে চান একদম আপনার মতো করে? সারাজীবনের জন্য?
-সেটা কি আসলেও সম্ভব?
-সম্ভব, তবে সেটা একান্তই আপনার উপর নির্ভর করবে। দরকার হলে কয়েকদিন সময় নিয়ে ভাবুন, ভালো করে ভেবে আমাকে জানান। মনে রাখবেন, আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপরই লাবনীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা অনেকাংশেই নির্ভর করছে। হয়ত আপনার চমৎকার একটা সিদ্ধান্তই আপনাদের দুর্দান্ত একটা দাম্পত্যজীবন উপহার দেবে, আর ভাবুন লাবনী কতটা কৃতজ্ঞতা নিয়ে বাকি সারাটা জীবন আপনার কাছে থাকবে।

লাবীব কিছুটা সময় চেয়ে নিয়ে নাবিলার কাছ থেকে চলে আসল। বিষয়টা গুরুতর, হুট করে এতবড় সিদ্ধান্ত ওর নেয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া বাসায় ফিরে ওর আগে লাবনীর সাথে ভালো করে কথা বলতে হবে!

চার

-রূপম, লাবনী মেয়েটা আমাকে দারুন ভাবে কনফিউশনে ফেলে দিয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব যে একটা মেয়ে একই সাথে একটা ছেলে আর একটা মেয়ের সাথে সমান তালে সর্ম্পক বজায় রাখবে? হয় সে বিষমকামি হবে, না হয় সমকামি হবে। কিন্তু একই সাথে ও দুইটা জায়গায়ই সমানভাবে আনন্দ উপভোগ করবে এটা তো স্বাভাবিক হতে পারে না। হয় সে আমাকে মিথ্যা কথা বলছে, না হয় আমার কাছে কোন ভয়ংকর তথ্য গোপন করছে।
-ম্যাডাম, ভালোবাসা তো দুইজনের মধ্যে সর্ম্পককেই বুঝায়। কিন্তু এটা কি হতে পারে না, যে তার প্রকাশভঙ্গিটা খুব ভিন্ন ভিন্ন, একেকজনের কাছে তা একেক সময় একেক রকম।
-রূপম এটা সম্ভব। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি কাকে কার কিভাবে ভালো লাগবে সেটা অন্য কেউ ঠিক করে দেয়া প্রায় অসম্ভব। কাউকে জোর করে কোন সর্ম্পকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে সে হয়ত আস্তে আস্তে সেটাতে হয়ত অভ্যস্ত হয়ে যাবে কিন্তু কখনই সেটা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হবে না। জোর করে আর যাই হোক ভালোবাসা হয় না।
-এমন কি হতে পারে না ম্যাডাম, লাবনী আসলেই সমকামি কিন্তু লাবীবের প্রচন্ড ভালোবাসা ওর নিজের ভিতরেই সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
-তুমি যেটা বলেছ সেটা একটা পসিবিলিটি হতেও পারে। আবার আমি কিন্তু তোমাকে উল্টাটাও বলতে পারি। লাবনী আসলে কখনই সমকামি ছিল না। মীরার সাথে যা হচ্ছে সেটা আসলে কোন একটা পরিস্থিতির স্বীকার যেটা থেকে ও আর এখন নিজে বের হতে পারছে না!

রূপম কিছুক্ষন চুপ করে নাবিলা দিকে তাকিয়ে রইল। নাবিলা আসলে ঠিক কি বলতে চাচ্ছে ওর কাছে সেটা বুঝার চেস্টা করছে ও।
-সেক্ষেত্রে ম্যাডাম, শুধু লাবনী কেন মীরা’কে নিয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা করা উচিৎ।
-অবশ্যই উচিৎ। তবে আমরা এই কেসে ওয়ান বাই ওয়ান আগাবো। তুমি লাবনীর ব্যাপারে খুব ভালোমতো খোঁজ নাও আর আমি দেখি কিভাবে মীরাকে আমার কাছে ডেকে এনে কথা বলা যায়। কিভাবে এদের মধ্যে সর্ম্পকটা হলো সেটা মীরার মুখ থেকেও শুনা দরকার। লাবনীকে নিয়ে তোমার সার্চ ক্রাইটেরিয়া আমি ছোট করে দিচ্ছি। এই কাগজে লেখার ঘটনাগুলিই শুধু তুমি ভালো করে খোঁজ নেবে। যদি কিছু না পাওয়া যায় তারপরই আমরা মীরা'র ব্যাপারে খোঁজ নিব। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, ডাল মে কুছ ক্যালা হ্যায়।
-ঠিক আছে ম্যাডাম। কিন্তু লাবনী যদি সত্যই সমকামি হয় তাহলে আপনি কি করবেন?
-রূপম মনে রাখবে, সমকামিতা মূলত একটি মানসিক রোগ। তবে অনেকেই এটাকে মানসিক রোগের জায়গায় মানসিক বিকৃতিও বলে থাকেন। আমাদের কাছে মানসিক রোগও যা, মানসিক বিকৃতিও তা। এই দুইটা ক্ষেত্রেই চিকিৎসা আমাদেরই দিতে হয়। আমি খুব করে জানতে চাইছি ঠিক কবে থেকে আর কি কারনে লাবনী কিংবা মীরা এই মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অসুখের কারন যদি বের করা যায় ওদের সুচিকিৎসা অবশ্যই করা যাবে।

-আপনি কি লাবনীর ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন?
-না। আমার হাতে এখন উপযুক্ত উপাত্তের অভাব। আর ঠিক এই কারনেই তোমাকে ডেকেছি।
-ধরুন, লাবনীকে আপনি ওর আসল পরিচয় দেখিয়ে দিলেন কিন্ত মীরাকে কিভাবে আপনি সামলাবেন?
-মীরার সাথে আগে কথা বলে নেই। প্রতিটা মানুষেরই কোন না কোন জায়গায় দূর্বলতা থাকে। মীরার যদি কোন দূর্বলতা থাকে সেটা বের করতে আমার বেশী সময় লাগার কথা না। আমার ইচ্ছে আছে এই মেয়েটাকেও যদি সম্ভব হয় কিছু করার। চোখের সামনে এই বয়সী একটা মেয়ে অস্বাভাবিক ভাবে জীবযাপন করে বেড়াবে সেটা তো হতে পারে না।

রূপম আর কথা না বাড়িয়ে নাবিলার বাসা থেকে বের হয়ে আসল। বাংলাদেশে হুট করেই একজনের সব অতীতের ইতিহাস বের করে আনা খুব কঠিন। তবে মীরা এবং লাবনীর অতীতের ইতিহাস এখন বের করে আনতেই হবে। এই কেসের গ্রহনযোগ্য সমাধানের জন্য এইগুলি জানা এখন খুব জরুরী হয়ে পড়েছে……..

পাঁচ

ভার্সিটিতে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির উপর একটা ট্যিউটোরিয়াল শেষ করে নাবিলা ওর অফিস রুমে ফিরে আসতেই দেখে একটা অল্পবয়সী মেয়ে রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই দেখল মেয়েটা কান্নাকাটি করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। মেয়েটা ওর কোন স্টুডেন্ট নয়, তবে কে হতে পারে সেটা সহজেই চিনতে পারল ও।
-মীরা, ভিতরে আস।
মীরাকে ডাকার সাথে সাথেই ওর রুমে ঢুকে ওর মুখামুখি একটা চেয়ারে বসল। মীরা'র ওর কাছে আসা মোটেও আনএক্সপেক্টেড নয়। নাবিলা লাবনীকে ওর পারমিশন ছাড়া মীরার সাথে দেখা, এমনকি কথা বলতেও নিষেধ করে দিয়েছিল।
-ম্যাডাম, আপনি কি লাবনীকে আমার কাছে আর আসতে দিবেন না?
-না।
-ম্যাডাম, আমি লাবনীকে ভালোবাসি, প্রচন্ডভাবে ভালোবাসি। আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না। ও ছাড়া আমার জীবনে আর কেউ নেই, আমি মরে যাব ম্যাডাম।
-টিনএজ বয়সে মেয়েরা অনেক সময়ই ভয়ংকর সব ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। নিজেকে জানতে ও বুঝতে শিখো, হুট করে ঝোঁকের মাথায় জীবনের সিদ্ধান্ত নিও না। এখনও জীবনের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার মতো বয়স তোমার হয়নি, মীরা। অনেক লম্বা একটা জীবন পড়ে আছে তোমার সামনে। এই রকম একটি ভুল সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে নিজের জীবনটা আরও জটিল করে ফেলো না।

কথাগুলি শুনে মীরা কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে দেখে নাবিলা অন্য বিষয়ে কথা শুরু করল।
-মীরা, লাবনী আমাকে জানাল যে তুমি নাকি কোন এক ডাক্তারের কাছে জেনেছে যে, সমকামিতা জ্বিনগত ব্যাপার এবং এটা জেনেটিক কারনেই হয়। তুমি কি এটা আসলেও বিশ্বাস করো?
-জী, উনি বলেছেন এটা নিয়ে ভয় পাবার কোন কারন নেই। খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার এটা!
-উনি তোমাকে সর্ম্পুন ভুল তথ্য দিয়েছেন। কোন কিছু জেনেটিক কারণে হয়, না পরিবেশ বা পরিস্থিতির কারণে হয় তা নির্নয় করার জন্য বিজ্ঞানের সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হলো “মনোজাইগোটিক” বা যমজদের নিয়ে গবেষণা। কারণ তারা একই ভ্রূণ থেকে জন্ম হয় বলে তাদের জেনেটিক কোড একদম বা প্রায় ঠিক একই রকম। সমকামিতা হওয়া যদি জেনেটিকই হয়, তাহলে তো একজোড়া যমজের মধ্যে যদি একজন সমকামি হয় তাহলে তো আরেকজনও সমকামি হবে। আর একজন সমকামি না হলে আরেকজনও হবে না। যেহেতু দুজনের জেনেটিক কোড একদম একই, তাই না? অন্ততঃ ১০০% ক্ষেত্রে না হলেও তার মধ্য থেকে ৮০-৯০% ক্ষেত্রে তো এমন হওয়ার কথা? আমেরিকার বিখ্যাত Columbia University-এর গবেষক, Peter Bearman এবং Yale University-এর গবেষক, Hannah Brockner আবিষ্কার করলেন ছেলে যমজদের ক্ষেত্রে এই রেট মাত্র ৭% আর মেয়ে যমজদের ক্ষেত্রে মাত্র ৫%! (American Journal of Sociology. Volume 107 (5): Page 1179–1205)। তাহলে এটা কি জেনেটিক্যাল কারণে? নিজেকে জিজ্ঞেস কর? তাহলে এইক্ষেত্রে সেটা ৮০-৯০% হওয়ার কথা ছিল। আর সেখানে ৫-৭% দেখা যাচ্ছে! তার মানে বোঝা গেল, “সমকামিতা প্রাকৃতিক” এই দাবি পুরাটায় অযৌক্তিক। উনি তোমাকে ভুল তথ্য দিয়ে সর্ম্পূনভাবে বিভ্রান্ত করেছে।
-কিন্তু ম্যাডাম, ইন্টারনেটে অনেক জায়গায়ই তো প্রায় এই কাছাকাছি জিনিসই বলা আছে?
-তুমি সম্ভবত, LGBT সাইটগুলিতে এই বিভ্রান্তমূলক তথ্যগুলি পেয়েছ। এইসব সাইটে ইচ্ছে করেই এই সব ভুল তথ্য দেয়া হয়। অনেকটাই যেন লেজকাটা শিয়ালের মতো, যে বাকি শিয়ালদের লেজও কাটা দেখতে চায়! তুমি চাইলে আমি আরও প্রমান তোমাকে দিতে পারব। তুমি কি শুনতে চাও?
-জী, আমি শুনতে চাই! আমি কি এতদিন এতবড় ভুল ধারনার মধ্যে ছিলাম? এটা কিভাবে সম্ভব?
-এখনও বিশ্বাস করতে পারছ না। ঠিক আছে, বড় বড় দুইটা প্রমান দিচ্ছি তোমাকে।
মনোযোগ দিয়ে শোনঃ-
(এক) মানবজাতি জেনেটিক্সের ফিল্ডে এক বিরাট সাফল্য অর্জন করে যখন তারা 'The Human Genome' প্রজেক্ট কমপ্লিট করে। এই প্রজেক্ট শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালে এবং শেষ হয় ২০০৩ সালে। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে মানুষের জেনেটিক কোডের সিকুয়েন্সগুলোকে নিখুত ভাবে ম্যাপিং করা হয়। কিন্তু এই প্রজেক্ট দিয়ে সেই কালপ্রিট তথাকথিত 'Gay gene' কে কোনভাবে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি।
(দুই) X ও Y হল মানুষের সেক্স ক্রোমোসোম। X ক্রোমোসোম ১৫৩ মিলিয়ন base pairs এবং ১১৬৮টি জিন ধারণ করে। X ক্রোমোসোমের থেকে ছোট ক্রোমোসোম Y তে আছে ৫০ মিলিয়ন base pairs এবং ২৫১টি জিন। এই ক্রোমোসোমগুলোকে নিয়ে গবেষণা করেছে Baylor University, The Max Planck University, The Sanger Institue, Washington University মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার এবং প্রচুর সময় খরচ করে এবং তাদের রিসার্চে তারা আজ পর্যন্ত 'Gay gene' এর কোন অস্তিত্ব X ক্রোমোসোমেও পায়নি, Y ক্রোমোসোমেও পায়নি।
-এবার বলো তোমার ঐ ডাক্তার কিভাবে ঠিক কথা বলেছেন?

মীরা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে নাবিলা দিকে তাকিয়ে আছে। এত বড় একটা ভুল ধারনা মনের ভিতর নিয়ে ও এই পৃথিবীতে বেঁচে ছিল? কতবার নিজের এই বিকৃতকামিতার জন্য প্রচন্ড ঘৃণায় আত্মহত্যা করার কথাও চিন্তা করেছিল ও!
-আমি তোমার আর লাবনীর জন্য “লেসবিয়ানিসম, এদের কমন প্যার্টান এবং কিউর” উপর একটা নোট রেডি করেছিলাম। লাবনীকে ইতিমধ্যেই এটা পড়তে দেয়া হয়েছে। আর আজকে যাওয়ার সময় তুমিও অবশ্যই এটা বাসায় নিয়ে যেয়ে খুব ভালো করে পড়বে।
-ঠিক আছে ম্যাডাম।
-অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা একসাথে দুষ্টামি করে এ্যাডাল্ট সিনেমা দেখে, পর্ণসাইট ভিজিট করে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। নিষিদ্ধের প্রতি তীব্র আকর্ষন এই বয়সে সবারই থাকে। কিন্তু আমি তোমার কাছে জানতে চাই, এইসব পর্ণসাইটে ঢুকার পর গার্ল-টু-গার্ল, লেসবিয়ান সেক্স এইসব জায়গায় ঢুকার আইডিয়া প্রথম কার মাথা থেকে এসেছে? নিশ্চয় তোমার, তাইনা?

মীরা কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে আছে। মীরা’র এই নিঃস্তব্ধ নিরবতা দেখে নাবিলা’র মনে একই সাথে আরও অনেক প্রশ্ন এসে ভিড় জমাল।
-আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, লাবনীর সাথে এই ধরনের সর্ম্পকের বুদ্ধি তোমার মাথা থেকেই এসেছে। তোমাদের মধ্যে শারীরিক সর্ম্পকের সময় টপ পজিশনে কে থাকত? তুমি, তাই না?

মীরা আগের মতোই কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে বসে আসছে।
-যেদিন তোমাদের প্রথম ফিজিক্যাল রিলেশনশীপ হয়, তুমি বাথরুমে ঢুকার আগে তোমরা একসাথে নিশ্চয় এইসব পর্ণসাইটগুলি ভিজিট করছিলে এবং তুমি ইচ্ছাকৃত ভাবেই লাবনীর সাথে এইসব দেখছিলে। আমি কি ঠিক বলেছি?

মীরা হালকা ভাবে মাথা উপর নীচ করে নাবিলার কথায় সায় দিল।
-লাবনীর আগেও নিশ্চয় আর কোন মেয়ের সাথে তোমার এই ধরনের সর্ম্পক ছিল?
-জী।
-সেই মেয়েটা কোথায় আছে এখন?
-ওর বাসায় জানার পর একটা ছেলের সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় আর তারপর আর ওর সাথে কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি।

নাবিলা মীরার অবস্থা কিছুটা হলেও এখন আন্দাজ করতে পারছে। এই মেয়ের সাথে আরও বেশ কিছু সেশন করতে হবে তবে সেটা এখানে হবে না। রূপমের কাছ থেকেও মীরাকে নিয়ে রির্পোটে এই মেয়ের আগের কাহিনী খুব ভালো করে জানা দরকার। লাবনীর সমস্যার সমাধান এই মেয়ের সুস্থতার উপরই অনেকাংশে নির্ভর করছে।

-মীরা, মানুষের ব্রেনের Adaption ক্ষমতা প্রবল। শৈশব ও কৈশোরে যে কোন বিকৃত যৌন আচরণের সাথে ব্রেন নিজেকে দ্রুতই খাপ খাইয়ে নেয়, ফলে পরবর্তীতে সেই আগ্রাসী এবং বিকৃত রূচির মানুষটার লিঙ্গের প্রতি একটা চরম বিতৃষ্ণা নিজের অজান্তেই তৈরী হয়। তোমার কি শৈশব কিংবা পরবর্তি জীবনে তোমার সাথে কি কোন রকম অসুস্থ কিংবা বিকৃত যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল?

মীরা প্রচন্ড অবাক হয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে নাবিলার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে কিছু না বললেও নাবিলা মীরার চোখের দৃষ্টিতে যা দেখল তাতে ওর ধারনা যে নিতান্তই ভুল নয় সেটা বুঝে ফেলল।
-মীরা, আমি তোমাকে সত্যই সাহায্য করতে চাই। যদি তুমি সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে জীবনযাপন করতে চাও এবং স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরে আসতে চাও তাহলে আমি তোমাকে একদম ফ্রী ট্রীটমেন্ট করব।

মীরা সেদিন আর কোন কথা না বলে ওর জন্য তৈরী করা নোটটা নিয়ে সোজা উঠে চলে আসল। কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া ওর এখানে ঝোকের মাথায় চলে আসা যে মোটেও ঠিক হয়নি সেটা ও হাড়ে হাড়েই টের পেয়েছে। এখন কি করবে ও?

দ্বিতীয় পর্ব এখানেই শেষ


কৃতজ্ঞতাঃ
১. বই – “সমকামিতা বিজ্ঞান এবং ইসলাম”
২. ইন্টারনেটে এই বিষয়ে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যসমূহ
৩. Book – “Hadith Sahih on behaviour of LGBT”

এই ব্যাপারে যারা আরও কিছু বিস্তারিত ভাবে জানতে চানঃ
https://www.focusonthefamily.com/socialissues/citizen-magazine/can-you-love-thy-neighbor-and-defend-marriage/love-thy-neighbor-part-1
https://rosariabutterfield.com/
http://www.oneby1.org/testimony-maria.cfm
https://www.amazon.com/All-Things-New-Lesbians-Lifelong/dp/1935769324
https://www.amazon.com/Free-Indeed-Womans-Victory-Lesbianism/dp/0931593581

না বলা কথা:
আমার আগের গল্পটাতে জনৈক মূর্খ এবং অর্বাচীন ব্লগার ব্লগার প্রশ্ন তুলেছিলেন আমার লেখার যোগ্যতা আর বিষয় নিয়ে। আমার শ্রদ্ধেয় পাঠকরা তাকে খুব ভালো বুঝিয়ে দিয়েছেন আমি কে আর আমি কি ধরনের লেখা লিখি। তারপরও নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেই এই গল্পটা লিখতে বসেছিলাম। এটার জন্য আমাকে কি পরিমান স্ট্যাডি করতে হয়েছে সেটা শুধু আমি আর আমার সৃষ্টিকর্তাই জানেন। প্রতিটা গল্পেই আমি আমার সম্মানিত পাঠকদেরকে একটা মেসেজ দিয়ে যাই। আশা করছি এই গল্পের মেসেজটাও সবাই উপলব্ধি করতে পারবেন!

সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, সেপ্টেম্বর ২০১৯

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:১৩
২৬টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×