somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ শবনম কাহিনী ৪ - নূরে জেহান

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধারাবাহিক গল্পের আগের পর্বগুলি পড়ে আসুনঃ
গল্পঃ শবনম কাহিনী ১ - কুসুম কুসুম প্রেম - প্রথম পর্ব
গল্পঃ শবনম কাহিনী ১ - কুসুম কুসুম প্রেম - শেষ পর্ব
গল্পঃ শবনম কাহিনী ২ - প্রায়শ্চিত্ত!
গল্পঃ শবনম কাহিনী ৩ - ছেড়া পালে লাগে হাওয়া!



প্রকৃতির লীলাখেলা বুঝা বড় দায়! শেষবার শবনমের চোখের দিকে তাকিয়েই আমি বুঝেছিলাম শবনম আমার বুকভরা ভালোবাসার কিছুটা হলেও এখন অনুধাবন করতে পেরেছে। নিজের জীবনসঙ্গী পছন্দ করতে যেয়ে কি ভয়ংকর ভুল ও করেছে সেটার অনুশোচনা শবনম ঠিকই টের পেয়েছে। কেন আমাকে দিনের পর দিন এভাবে ও অবহেলা করত সেটা জানার খুব ইচ্ছে থাকলেও, ওকে আমি এই ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না। কেন যেন এই বিষয়ে ওকে আর কিছু বলতেও ইচ্ছে করল না। হয়তো এই জীবনে ওকে এই বিষয়ে আর কিছু বলবও না। শবনমকে আমি আবার আমার হৃদয়ে ফিরে পেয়েছি, এটাই যথেষ্ট আমার জন্য। আমি ওকে সত্যই ভালোবাসি, একদম পাগলের মতো। আমার প্রতিটা নিশ্বাস যেমন সত্য, ঠিক তেমনি শবনমের জন্য আমার বুকভরা ভালোবাসার প্রতিটা বিন্দুও সত্য।

সেদিনের পর থেকে বেশ কয়েকবার আমরা দুইজন বসে জীবনের বাকি সময়গুলি নিয়ে কি করব, কিভাবে কাটাবো সেটার খোলামেলা আলোচনা শুরু করলাম। শবনমের আগ্রহই বেশী দেখলাম। ও আমাকে বুঝতে চাইছে। নিজের ভুলে ফেলে আসা জীবনের সোনালী সময়গুলির নষ্ট করে ফেলার ক্ষতিটা কিভাবে আবার পুষিয়ে নেয়া যায় সেটার চেস্টা করতে চাইছে। ভালোবাসার স্বপ্নের সিড়িতে আমার হাত ধরে আবার হাঁটতে শিখতে চাইছে।

কি লাভ অতীতের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে বর্তমান আর অনাগত ভবিষ্যতগুলিকে নোংরা আর কলুষিত করার! বরং এতে ফেলে আসা পুরানো কষ্টগুলি আবার পানি-আলো-বাতাস পেয়ে তরতাজা হয়ে উঠে, বিভীষিকাময় করে তুলে আবার নতুন করে সাজান গুছানো জীবনটাকে!

তাই হুট করেই আবার ফিরে আসা আমার হৃদয়ের সবচেয়ে আপন প্রণয় পাখীটাকে অতীতের সবকিছু ভুলে যেয়ে বুকের মাঝে সাদরেই আমি গ্রহন করে নিলাম। শবনম এসেই যেন আমার হৃদয়ের শুষ্ক মরুভুমিতে বহুদিন পরে ভালোবাসার উষ্ণ প্রস্রবণ বইয়ে দিল!

দুই

রাপা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে হাতঘড়িতে সময় দেখলাম আবার। ঠিক সকাল দশটা বাজে। পারফেক্ট টাইমিং। মোটর সাইকেল থেকে নেমে এসে আয়েস করে একটা সিগারেট ধরালাম। আজকে আমার ভালোবাসার জন্মদিন এবং ঠিক সেই উপলক্ষে আজকে আমি ছুটি নিয়েছি। সারাদিনের পরিকল্পনা একটাই, শবনমের সাথে পুরোটা সময় কাটাবো। সহজ ভাষায় যেটাকে বলে ডেটিং। মনের ভিতর পুষে রাখা অনেকদিনের এই সুপ্ত ইচ্ছেটা আজকে আমি পুরণ করবোই করব। যেখানে ইচ্ছে সেখানে আমার প্রণয়ের পাখীটাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াব। আর ঠিক সেজন্যই একটা মোটর সাইকেল নিয়ে এসেছি।
-এটা কি নিয়ে এসেছেন?

শবনম প্রায় সময় মতোই চলে এসেছে আর আমার নিরহ গোবেচারা মোটর সাইকেলটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল।
-মোটর সাইকেল। আজকে সারাদিন এটা নিয়ে ঘুরব আমরা।
-আপনার উদ্দেশ্য তো আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না, শুভ। এত কিছু থাকতে এটা কেন?

শবনমের দিকে তাকিয়ে আমি মিষ্টি মধুর একটা হাসি উপহার দিলাম। এই রাপা প্লাজার সামনেই শবনম আমাকে ট্রাকের নীচে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার ভয় দেখিয়েছিল। এটার শোধ এখনও নেয়া হয় নি। আজকে এর উসুল তুলব এবং অবশ্যই এতদিনের বকেয়া সুদ সহ। এক্সট্রা হেলমেটটা শবনমের মাথায় নিজের হাতেই পড়িয়ে দিলাম। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে পিছনে বসতে বলতেই কড়া হুমকি শুনতে পেলামঃ
-শুভ, আমার এটাতে উঠার অভ্যাস নেই। আমার খুব ভয় ভয় লাগছে। আপনি অবশ্যই আস্তে আস্তে চালাবেন। কোন রকম শয়তানি বুদ্ধি মাথায় থাকলে এখনই ঝেড়ে ফেলুন। উল্টা পাল্টা কিছু করলে আমি কিন্তু আপনাকে ছাড়ব না।

শবনমের ভয় লাগছে শুনে মনে সেইরকম শান্তি পেলাম। চলা শুরু করতেই স্পীড সাথে সাথেই ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দিয়ে শবনমকে বললামঃ
-শবনম, আমাকে ভালো করে ধরে বসুন। আপনাকে তখন বলতে ভুলে গেছি যে আমি এটা কোনভাবেই আস্তে চালাতে পারব না। আস্তে চালালে কেন জানি এটার ব্রেক ঠিকমতো কাজ করে না।
ভয়ে শবনম আমাকে সাথে সাথেই বেশ জোরে জড়িয়ে ধরল। আহ, এটাই তো চাইছিলাম আমি! শবনম আমার কানের কাছে মুখ এনে বললঃ
-শুভ, ইচ্ছে করেই এটা আপনি এনেছেন আজকে, তাইনা? এটা থেকে নামার পর আপনার খবর আছে। আপনার একদিন কি আমার একদিন আজকে!
আজকে কেন জানি শবনমকে একফোঁটাও ভয় পেলাম না। আমি ওর এই ভয়ংকর হুমকি পাত্তাও দিলাম না। মনের আনন্দে স্পীড আরও বাড়িয়ে দিয়ে যাওয়া শুরু করলাম। শবনম আরও জোরে আমাকে জড়িয়ে ধরল। এখন পুরো মিশে আছে আমার শরীরের সাথে। আহ, উসুল ইতিমধ্যেই উঠে গেছে। বাকি সারারাস্তা এখন আমি সুদ পেতে থাকব। ইস, মোটর সাইকেলে গান বাজানোর ব্যবস্থা থাকলে দারুন হতো!
"আজকে আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা"

ইচ্ছে করেই ওকে নিয়ে পুরো ঢাকা শহরের বড় রাস্তাগুলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কি যে ভালো লাগছে! মনে কত ইচ্ছে ছিল ওকে নিয়ে ঠিক এভাবে ঘুরে বেড়ানোর, গভীর আবেগে আমার প্রায় চোখে জল চলে আসার উপক্রম! শবনমের কোন সাড়াশব্দ নেই দেখে মাথা ঘুড়িয়ে পিছনে ফিরে দেখলাম বেশ ভালো করে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধের উপর মাথা রেখে চুপ করে বসে আছে! আহ, এই রকম লক্ষী মেয়েই তো চাই আমি!
অনেকক্ষন ঘুরাঘুরি করার পর ওকে নিয়ে ধানমন্ডি লেকের পাশে এসে মোটর সাইকেল থেকে নেমে দাড়ালাম। শবনম মোটর সাইকেল থেকে নামার পর থেকেই কেন যেন চুপচাপই রইল। মাথা নীচু করে আমার সাথে হাঁটছে।

পরিচয়ের প্রথম মূহুর্তের মত করে মুগ্ধ হতে চাই!
মৌনতা মাখা কবিতার সন্ধ্যা বয়ে চলুক অবিরাম;
অসময়ের চৈতালি মেঘের ঢলে ভাসুক তিক্ত প্রহর সব
আলগোছে সাজানো চুপচাপ চাপারঙ পারুলে
আর রোদের লুকোচুরিতে চলুক টুকটাক আলাপন!
@ দ্বৈরথ - মনিরা সুলতানা


ভালো করে তাকিয়ে দেখি উনি লজ্জার রক্তিম আবীরে মাখামাখি হয়ে আছেন। এতদিন তো আমার সামনে যুদ্ধেংদেহী হয়ে ইচ্ছেমতো ভাব নিয়েছে, ঝাড়ির পর ঝাড়ি মেরেছে, এখন আর কিছুতেই আমার সাথে সহজ হতে পারছে না। শবনম ওর মনে ষ্টিলের যে বাউন্ডারির কথা বলে আমাকে বিশাল ভয় দেখাতো, সেটাতে এখন প্রায় সব জায়গায়ই মরিচা ধরে ক্ষয়ে গেছে। আর তার ফাঁকফোকর গলে শবনমের রমনীয় কোমল রূপটা আজ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। এখন কেমন যেন ওকে কিছুটা বোকা বোকা লাগছে। ওর পিঠের উপর মাঝ বরাবর ঘন কালো চুলের লম্বা বেণীর দিকে তাকিয়ে আমার মন কেমন যেন উথাল পাথাল করে উঠল। হঠাৎ করেই আমার দিকে ফিরে তাকালো শবনম। শবনমের শান্ত আর স্থির মনোহরিনী চোখের চাহনি দেখে আমার বুকের ভিতরে হঠাৎ অজানা এক মোচড় দিয়ে উঠল। এ যেন আজ আমি একদম নতুন করে চিনছি ওকে। এ যেন চঞ্চলা চপলা এক বন্য হরিণীকে আমি হুট করেই পোষ মানিয়ে নিয়েছি। এ যেন ডানা মেলে উড়ে বেড়ান একটা দুরন্ত রঙ্গীন প্রজাপতিকে পোষ মানিয়ে হৃদয়ের খাঁচায় হুট করেই ভরে ফেলেছি। ইচ্ছে হচ্ছে এই প্রজাপতি থেকে রঙ নিয়ে আমার সমস্ত কিছু আবার নতুন করে রাঙিয়ে নেই।

একটা বাচ্চামেয়ের কাছ থেকে বেশ বড় একটা রক্তলাল গোলাপ ফুল কিনে ওকে উপহার দিলাম। শবনম চুলের বেণীটাকে খুব সুন্দর করে খোঁপা বানিয়ে ফুলটা আমার কাছ থেকে নিয়ে খোঁপায় গুঁজে দিল! কি যে অপূর্ব লাগছে ওকে এখন! আমার দিকে তাকিয়ে শবনম অচেনা অপূর্ব এক মিষ্টি হাসি উপহার দিল, যেটা দেখার সাথে সাথেই আবার নতুন করে ওর প্রেমে পড়লাম! আচ্ছা, এই মেয়েটা এত সুন্দর কেন?

সেদিন ফিরে আসার সময় শবনমের হাত ধরে হাঁটছি আমি। তাকিয়ে দেখি নীল আকাশের দূর দিগন্তে সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে। হালকা নরম শেষ বিকেলের মোলায়েম রৌদ্রে শবনমকে খুব করে যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। যেমন করে এই রৌদ্র ওকে চারপাশ থেকে জড়িয়ে রাখছে, ঠিক সেভাবেই যেন ও আমার হৃদয়টাকেও জড়িয়ে রেখেছে। আর শবনম ওর দুইহাত দিয়ে আমার একটা হাত খুব করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে পরম আস্থায় আর ভরসায়।

তিন

সেদিন ফিরে আসার পর থেকেই শবনম একদম অন্যরকম হয়ে গেল। আগের সেই হইচই করা রাগী মেয়েটা যেন খুব মিষ্টি একটা লক্ষী মেয়ে হয়ে গেল। এরপর এক ছুটির দিনে ওকে নিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরতে গেলাম। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল ওকে নিয়ে এখানে আসার। সেদিন দুইজন গল্প করতে করতে সময় কোনদিক দিয়ে যে পার হয়ে গিয়েছিল টেরও পাইনি। আজকে বিকেলে ভিতরে ঢুকে বড় একটা গাছের নীচে ঘাসের বিছানায় বসে পড়লাম পড়লাম দুইজন।

-আমার নূরে জেহান আজকাল বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে দেখছি! ঘটনা কি?

লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলল শবনম। হুট করে শুভ এমন সব কথা বলে বসে যে ওর লজ্জায় মরি মরি অবস্থা হয়! শুভ সেই তখন থেকে ওর হাতদুটি ধরে আছে, কেন জানি ওর নিজেরও ছাড়াতে ইচ্ছে করছে না। একবুক ভরা ভালোবাসা চোখে নিয়ে শুভ চাতক পাখির মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কত অবহেলা আর অনাদর করেছে ও শুভ’কে, শুধু শুধুই বকাঝোকা করত, শুধুমাত্র একটু ওর কন্ঠস্বর শুনার জন্য কিছুদিন পরপর ফোন করলে দেখেও ধরত না, আবার ধরলেও যা ইচ্ছে তাই বলে লাইন কেটে দিত। শুভ'র দিকে তাকিয়ে সহসাই যেন ওর বুকের ভেতরে জমাট বাঁধা প্রণয়ের লাভার বিস্ফোরণ হলো। শবনমের বুকের ভিতরে এখন কালবৈশাখীর সুতীব্র ঝড় বইছে। শুভ'র সাথে কিভাবে সর্ম্পকটা আরও সহজ করা যায়? কিভাবে শুভর বুকে জমে থাকে এতদিনের সব মান অভিমান ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়া যায়? তা না হলে নিজের বুকের ভিতর ঝড়ের এই তান্ডব কোনোভাবেই থামাতে পারবে না ও। কিছুতেই নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারছে না ও, কিছুতেই না। হঠাৎ করেই ওর চোখে বাঁধভাঙ্গা জল চলে আসল। চোখের জল না মুছে শবনম অন্যদিকে তাকিয়ে রইল!

দূরে সূর্য যেন পাটে বসেছে। শেষ বিকেলের কনে দেখা মিষ্টি আলোতে চোখের জলে ভেজা শবনমকে দেখতে অসম্ভব হৃদয়মোহিনী লাগছে আমার কাছে। একটু সাহস করে এগিয়ে এসে শবনমের কাছে বসলাম। জলে ভেজা চোখগুলি ভালো লাগলেও শবনমের কান্না সহ্য করতে পারলাম না। হাত দিয়ে শবনমের চিবুক ধরে উঁচু করে চোখের জল ভেজা মুখটা আমার দিকে ফেরালাম। শবনমের কষ্টটা কিছুটা হলেও আমি এখন বুঝতে পারছি। যে মানুষটা তার আবেগের অনুভূতি প্রকাশ করছে আমার সামনে, সেই অনুভূতি যদি বুঝতেই না পারি তাহলে কিসের ভালোবাসি আমি ওকে?

শবনমের চোখ তখন জলে ভেজা ভেজা। ওর ভেজা চোখগুলি আস্তে করে আমার হাত দিয়ে মুছে দিলাম। আজকেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠদিন। শবনমের এই আবেগ ভরা অনুভুতি, এই ভালোবাসা এর আগে আমার কাছে ও কখনই দেখায় নি। এখন শবনমের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই যেন আমার কাছে মনে হতে লাগলো এক স্বপ্নময় অনুভুতি যা কখনই কোন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। শবনমকে পুরোপুরি পাবার জন্য মন আমার ছটফট করতে লাগলো। আর কোন বাঁধ মানছে না এখন!
-আর কতদিন অপেক্ষা করে থাকব আমি? আমার প্রতীক্ষার প্রহর কি কখনই শেষে হবে না শবনম?
আর সহ্য করতে পারল না শবনম, জাগতিক সকল নিয়ম ভেঙ্গে আমার বুকে আশ্রয় চাইল ও!

জানি আমি জানি জানি প্রতীক্ষা কতখানি!
র’য়ে যায় রোজ রোজ চা'য়ে
মুঠোফোনে টুক করে ভেসে আসে,
মন ভেজে কোন সুর তাল আর ল’য়ে !
ইশকুল আপিসে ধুরছাই প্রহর-
টেনে আনে নিয়ন আলোর সন্ধ্যা
সাথে মনের ঢাল বেয়ে নেমে আসা সান্ধ্যসোহাগ।
@ দ্বৈরথ - মনিরা সুলতানা আপু


আমিও শবনমকে আমার বুবুক্ষু হৃদয়ে ভালোবেসে কাছে টেনে নিলাম, শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। শবনমের খোলা চুলের ভিতর হাতের আঙ্গুল দিয়ে ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দিতে লাগলাম। শবনম একটা শব্দও করল না, শুধু নিরবে পুরোটা সময় আমার বুকের ভিতর থেকে এতদিনের ওর জন্য জমানো সব নিঃস্বার্থ ভালোবাসার একান্ত পরশগুলি কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নিতে লাগলো।

অনেকক্ষন পরে পাখিদের কলকাকলীতে আমি মুখ উঁচু করে দেখি প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। প্রণয়ের সাম্পানে ভেসে এতক্ষন আমরা এতই নিমগ্ন ছিলাম যে সময় কোনদিক দিয়ে চলে গেছে টেরও পাইনি। আকাশে মেঘের নীচ দিয়ে ফিরে যাচ্ছে অচেনা পাখির দল। লাল রক্তিম আভায় উজ্জল হয়ে উঠেছে গোধূলির নীল আকাশ। চিরচেনা এই প্রকৃতির স্বাভাবিক দৃশ্যটাও অপার্থিব এক মায়াময় দৃশ্যের মতো লাগছে আজ আমার কাছে। আমার বুকের মাঝে আশ্রয় নেয়া শবনম একবার মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে। শবনম মাথা নীচু করে ঠোঁট কামড়ে হাসছে। শবনমের না বলা কথাগুলি এখন এমনিতেই বুঝতে পারছি আমি। আমার এতদিনের মনের ভেতরে চেপে রাখা সব হাহাকার আর না পাওয়ার অভিমানের তীব্রতা মুহূর্তেই হারিয়ে গেল শবনমের ছোট্ট করে দেয়া সেই হাসিতে। একটু ঝুঁকে আমার অনভিজ্ঞ ঠোঁটগুলি স্পর্শ করালাম আমার প্রেয়সীর বহুদিনের প্রতীক্ষিত সেই ঠোঁটদুটোকে। প্রথমে ওষ্ঠ, তারপর মিলিত অধর, ভালোবাসার নিবিড় স্পর্শে যেন এক লহমায় হারিয়ে গেলাম আমরা দুইজন!

-আপনি দিন দিন অনেক দুষ্ট আর বদছেলে হয়ে উঠছেন শুভ! আগে আমাকে ভয় পেতেন সেটাও অনেক ভালো ছিল। ভয় ডর কেটে যাবার পর এখন যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছেন! সাহস খুব বেড়ে গেছে, তাইনা?

একটু আগেই বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে আমার বুকে মাথা রেখে বসেছিল শবনম, সেটার কোন দোষ নেই! আমি অবুঝের মতো না হয় একটা চুমুই দিয়েছি, তাই বলে আমার চরিত্র নিয়ে এত কথা! সোজা হয়ে বসে আমার মুখোমুখি এখন শবনম। বেশ ক্ষেপে গেছে আমার একটু আগের কান্ড দেখে। দাঁত বের হাসি দিলাম আমি। ক্ষেপে গেলে ওকে আরও বেশি সুন্দর লাগে। ইচ্ছে করছে ওকে আরেকটু রাগাতে! দেখি না কতটুকু আর রাগানো যায়! যত রাগবে ততই সুন্দর লাগবে।
-রাগ করছেন কেন শবনম, এইগুলি হচ্ছে ভালোবাসার অত্যাচার।
-পিট্টি চেনেন। এর পরেরবার ধরে সোজা পিট্টি দেব!

শবনমের কথায় আমি মোটেও পাত্তা দিলাম না। ভালোবাসায় গনতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোন জায়গাই নেই। ভালোবাসা সবসময়ই স্বৈরাতান্ত্রিক! সবার মতামত আর গনভোট নিয়ে তো আর প্রেম ভালোবাসা করা যাবে না। ভালোবেসে কাছে আসার সুন্দর অনুভূতিগুলি খুব কমই আসে এক জীবনে। আর এই ভালোবাসার মূহুর্তগুলো ক্ষনিকেই শেষ হয়ে যায়। সুযোগ আসলে এইগুলি হাতছাড়া করা ঠিক না!

চারপাশে ক্রমেই সন্ধ্যা নেমে আসছে। আশেপাশের ফুটে থাকা সাদা কাশফুলগুলি যেন হালকা ঘোলাটে হয়ে আসছে। আর আমার জীবনের এতদিনের জমাট বাধা সব অন্ধকার যেন দ্রুতই সরে যেয়ে সবকিছু স্বচ্ছ আর পরিষ্কার হয়ে উঠছে। আমি আবার সাহস করে আবার শবনমের হাতদুটি আমার দুইহাতের মাঝে এনে রাখলাম। আমার প্রতিটা আঙুল শবনমের প্রতিটা আঙুলকে স্পর্শ করে আছে। লজ্জাবনত হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে ও। কুসুম কুসুম প্রণয়ের উষ্ণতা যেন ছড়িয়ে পড়ছে আঙুল থেকে আঙুলে। শবনমের কাজল কালো চোখে ক্ষণিকের জন্য চোখ পড়তেই ওর চোখে ভালোবাসার স্পস্টতা দেখতে পেলাম। হঠাৎ করেই পৃথিবীটা খুব ছোট মনে হলো আমার কাছে। এই ছোট্ট পৃথিবীর পুরোটা জায়গা নিয়েই যেন শবনম আমার কাছে বসে আছে। আর আমি বসে বসে শবনমের ফর্সা গালে লাজুক রংয়ের খেলা মন ভরে দেখতে লাগলাম।

চার

বিরহে কাপুরুষরা অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে
প্রেমিক সিংহপুরুষরা বুকে বিরহ নিয়েই-
নিরন্তর জীবনের পথে এগিয়ে চলে, আর
হৃদয়ের উথালপাতাল জোৎস্নাগুলিকে ধরে
অব্যক্ত স্বপ্নগুলি নতুন করে আঁকতে শুরু করে!


এই পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষের জীবনই একটা করে মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের সব স্তবকই কিন্তু ছন্দ মিলিয়ে লেখা থাকে না। কিছু কিছু জায়গায় তাকদীরের রহস্যময় খেলায় অছন্দের কারূকাজ না চাইতেও লেখা হয়ে যায়। এই অবাধ্য কারূকাজ ঠেকিয়ে রাখে সেই সাধ্য কার?
শবনমকে সেদিন পৌছে দিয়ে বাসায় ফিরে জীবনের জাবেদা খাতা খুলে আমি অবাক! কিভাবে কিভাবে যেন ডেবিটের ঘরটা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে! চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল আজকে চলে আসার আগের সেই ঘোরলাগা এক দৃশ্য-

শবনম আমার দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে কি জানি দেখল কিছুক্ষন। তারপর দুইপাশে মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ল। মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না আমি! হঠাৎ করেই ও বলে উঠলঃ
-আর তর সইছে না! আচ্ছা ঠিক আছে। আমার খোকাবাবুটাকে আর বিরহের সাগরে ডুবিয়ে রাখব না। তোমার আব্বু আম্মুকে আমার বাসায় পাঠাও! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব!

জীবনে কি কারও এমন হয় যে নিজের কান'কেও ঠিক বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়! আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এ যেন এক অবিশ্বাস্য অনুভূতি। জীবনের সব চাওয়া, পাওয়া, হারিয়ে ফেলা, ফিরে পাওয়া সবকিছু যেন বড্ড তালগোল পাকিয়ে গেল। আর সেই তালগোলের ছন্দমাত্রা এতই সুতীব্র যে আমি নির্বাক বিমূঢ় হয়ে শুধুই শবনমের দিকেই তাকিয়ে রইলাম।

আচ্ছা এটাই কি ভালোবাসা? আমি জানি না। তবে ঠিক করে ফেললাম, বাকি সারাটা জীবন ধরে আমি শবনমের খুব কাছে থেকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে যাব। এই প্রশ্নের উত্তর যে আমাকে পেতেই হবে…….



*** ব্লগে শবনম সিরিজের আপাতত এখানেই পরিসমাপ্তি ঘোষনা করছি। এই সিরিজের সাথে যারা ছিলেন তাদের সবাইকে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং শুভ কামনা রইল!!!


কৃতজ্ঞতাঃ শবনম সিরিজের এই পর্বের পুরো কৃতিত্ব শায়মা আপুর! আপুর লেখা “বসন্তদিন” বইটা উনার কাছ থেকে উপহার পাবার পরই খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে বসেছিলাম। বইটা পড়ার পর একটা নিখাদ প্রেমের গল্প লেখার জন্য মন খুব আইঢাই করছিল। শবনম শুভ’র প্রেমকাহিনীর জন্য অনেকবার অনুরোধ পেয়েছি। এবার আর তাই সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। শবনমের জন্য এত সুন্দর একটা ছবিও প্রিয় শায়মা আপুই এঁকে দিয়েছেন।

পুনশ্চঃ যারা প্রেমের গল্প লিখতে চান কিন্তু লিখতে বসলে লিখতে পারছেন না, তাদের জন্য “বসন্তদিন” হচ্ছে “ভল্টারিন ইঞ্জেকশন”। বিশ্বাস না হলে একবার পড়ে দেখুন! আমি মাত্র অর্ধেক পড়ার পর আর থাকতে পারি নি, ফলাফল এই পর্ব!!!

ব্লগের জনৈক অর্বাচীন ব্লগারকে বলছিঃ সাড়ে সর্বনাশ! আরেকট পর্ণ সাহিত্য লিখে ফেলেছি। এখন কার কার কাছে নালিশ দেবেন সেটার লিস্ট করে ফেলুন!

সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, সেপ্টেম্বর, ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:২১
২৬টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×